মাইক্রোফাইন্যান্স তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতায়িত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, খাতটি পরিপক্ব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন মডেল অন্বেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ঋণদানের ক্ষেত্রে আরও সূক্ষ্ম ও টেকসই একটি মডেল প্রদান করতে সক্ষম। যেহেতু প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সফট মাইক্রোফাইন্যান্স নামে নব উদ্ভাবিত ধারণাটি এ ক্ষেত্রে একটি পরিবর্তন আনতে পারে, যা নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আর্থিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি আনয়ন করতে সাহায্য করে এবং ঋণের ফাঁদ থেকে তাদের মুক্ত রাখে। এটি শুধু আর্থিক রিটার্নের ওপরে নয়, বরং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপরেই বেশি গুরুত্ব দেয়। সফট মাইক্রোফাইন্যান্স একটি টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক পদ্ধতি প্রদান করে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক।
সফট মাইক্রোফাইন্যান্সের ধারণা
এক. যেখানে প্রচলিত মাইক্রোফাইন্যান্স প্রায়ই দুই অঙ্কের সুদ হার ধার্য করে, সেখানে সফট মাইক্রোফাইন্যান্স ঋণগ্রহীতাদের আর্থিক বোঝা কমানোর লক্ষ্যে একক অঙ্ক বিশিষ্ট পরিবর্তনশীল সার্ভিস ফি (সর্বোচ্চ ৮% পর্যন্ত) বা বিশেষ ক্ষেত্রে শূন্য ফি হারে ঋণ প্রদান করতে পারে। সফট মাইক্রোফাইন্যান্স মডেলে প্রচলিত নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ হারের পরিবর্তে একটি পরিবর্তনশীল সার্ভিস ফি গ্রাহকদের ওপর ধার্য করা হয়, যা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক পরিচালন ব্যয়ের ওপর নির্ভরশীল হবে। বার্ষিক অডিট শেষে মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রকৃত পরিচালন ব্যয় নির্ধারণ করবে। যদি সার্ভিস ফি হিসেবে নেওয়া অর্থ পরিচালন ব্যয়ের তুলনায় বেশি হয়, তাহলে অতিরিক্ত অর্থ গ্রাহকদের ফেরত দিতে হবে অথবা তাদের সম্মতিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চ্যারিটি ফান্ডে স্থানান্তর করতে হবে ফের ঋণ বিতরণ করার জন্য। এ ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ব্যয় বিভিন্ন রকম হবে; সুতরাং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সার্ভিস ফিও বিভিন্ন রকম হবে, এমনকি যদি কোনো ঋণ দুই বছর মেয়াদি হয়, তাহলে একই প্রতিষ্ঠানের প্রথম বছরে ধার্যকৃত সার্ভিস ফির থেকে পরের বছরের সার্ভিস ফি ভিন্ন রকম হতে পারে।
দুই. সফট মাইক্রোফাইন্যান্স শুধু ঋণ দেওয়ার ব্যাপার নয়, বরং ঋণ প্রদান ছাড়াও ঋণগ্রহীতা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য, সন্তানদের শিক্ষা, স্থায়ী সম্পদ প্রদান করা (যেমন—গবাদি পশু বা অর্থকরী ফসলের বীজ), ব্যবসায়িক প্রশিক্ষণ, সার্বক্ষণিক পরামর্শ ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে, যাতে তারা তাদের উদ্যোগে সফল হতে পারে এবং যে কোনো ধরনের অপ্রত্যাশিত ক্ষতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়।
তিন. সফট মাইক্রোফাইন্যান্সের লক্ষ্যে সমাজে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও ন্যায্যতার পরিবেশ তৈরি করবে, যেখানে ব্যক্তি ও পরিবারগুলো আর্থিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে তাদের সম্ভাবনাগুলো পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারে।
চার. এটি ঋণদানের ক্ষেত্রে নৈতিক নীতিমালা অনুসরণ করবে, যেখানে ঋণগ্রহীতাদের ওপর কোনো অতিরিক্ত বা গোপন ফি আরোপ করা হবে না। পাশাপাশি, এটাও নিশ্চিত করা হবে যে, প্রদত্ত ঋণগুলো যেন কোনো ধরনের সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বা ক্ষতিকর কার্যক্রমে যুক্ত না হয় যেমন—তামাক চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিক্রি বা জুয়া খেলা অথবা মজুতদারির ব্যবসা ইত্যাদি।
পাঁচ. সাধারণ মানুষের পাশাপাশি এটি এমন ব্যক্তিদের জন্যও, যারা নিয়মিত মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচিতেও কোনো কোনো সময় অংশগ্রহণ করতে পারেন না। ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর সুযোগ থাকতে পারে, যাতে তাদের আয়ের সঙ্গে ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। এ পদ্ধতিতে স্থাবর সম্পদ বা নথিপত্রের পরিবর্তে সামাজিক জামানতের ওপর নির্ভর করবে, যা ঋণগ্রহীতার সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং সমাজের মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
ছয়. সফট মাইক্রোফাইন্যান্স মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে বেশ কিছু ধাপ রয়েছে, যা আস্থার ভিত্তি তৈরি করতে এবং স্থানীয় সমর্থন নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। সফট মাইক্রোফাইন্যান্স নমনীয়তা, স্বচ্ছতা এবং সামাজিক সংহতির মাধ্যমে আর্থিক ক্ষমতায়নের জন্য প্রণীত হয়েছে। ঋণগ্রহীতার কল্যাণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতিকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে এই মডেল দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রকৃত ও দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের জন্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।
লেখক: উন্নয়নকর্মী