জাফরিন সুলতানা
প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:১৭ এএম
আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৩৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চারদিক

উৎপাদন বাড়লেও ন্যায্যমূল্য পান না কৃষক

ধানক্ষেতে কাজ করছেন কৃষকরা। ছবি : সংগৃহীত
ধানক্ষেতে কাজ করছেন কৃষকরা। ছবি : সংগৃহীত

‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে, কৃষি থাকলে প্রাণ থাকবে’—এই উক্তিতে বোঝানো হয়েছে যে, কৃষক ও কৃষিই একটি দেশের অর্থনীতি ও মানুষের জীবনের মূল ভিত্তি। কৃষকরা যদি টিকে থাকে এবং তাদের যথাযথ সম্মান ও ন্যায্যমূল্য দেওয়া হয়, তাহলে দেশ খাদ্য ও অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকবে। কেননা কৃষিই মানুষকে বেঁচে থাকার রসদ সরবরাহ করে। তাই কৃষক ও কৃষির সুরক্ষা সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।

২০১৮ সালের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে, কৃষি খাত মোট শ্রমশক্তির ৪০.৬ শতাংশ জোগান দিয়ে থাকে। দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৪.১০ শতাংশ। দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। যুগে যুগে কৃষি উৎপাদনের নানা প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধিত হলেও কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। একদিকে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে কৃষকদের আর্থিক দুর্দশা কাটছে না। এই বৈপরীত্য কেন? এর পেছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ। দালালের দৌরাত্ম্য, বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা, সংরক্ষণের অভাব, সরকারি নীতি বাস্তবায়নে দুর্বলতা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রতিকূলতা অন্যতম কারণ।

সম্প্রতি কৃষকরা ফুলকপি চাষ করে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে জমিতেই ফসল নষ্ট করেছেন। মাঠপর্যায়ে ফুলকপির দাম মাত্র ৫ টাকা ছিল, যা উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের খরচের চেয়েও কম। ফলে চাষিরা মারাত্মক লোকসানের মুখে পড়ছেন। অন্যদিকে, শহরের বাজারে এই ফুলকপি ২০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। কৃষকরা হাড়ভাঙা কষ্ট করে ফসল ফলান লাভের আশায়। কিন্তু মুনাফার মুখ দেখা তো দূরে থাক, বরং উৎপাদন খরচও পান না। ভোক্তা ও কৃষক—এ দুয়ের মধ্যে রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বাজারজাত না হয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত ঘুরে ভোক্তার কাছে পৌঁছে। কৃষিপণ্যের বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য পুরোনো সমস্যা। কৃষক সরাসরি ভোক্তার কাছে বিক্রি করতে পারেন না; বরং তাদের পণ্য স্থানীয় আড়তদার, পাইকার, বড় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বাজারে আসে। এই মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের কাছ থেকে কম দামে পণ্য কিনে শহরের বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে। ফলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না।

বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের বাজারব্যবস্থা বেশ দুর্বল। একদিকে কৃষক যখন মৌসুমি ফসল তুলতে থাকেন, তখন একসঙ্গে প্রচুর সরবরাহ হওয়ায় দাম কমে যায়। অন্যদিকে বাজারে একবার দাম কমে গেলে তা পুনরায় বাড়তে সময় লাগে। ফলে কৃষকরা কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন। ফসল সংরক্ষণের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় কৃষকদের বাধ্য হয়ে কম দামেও ফসল বিক্রি করতে হয়। ধান, আলু, টমেটো, পেঁয়াজ, মরিচসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় না। কারণ দেশে পর্যাপ্ত কোল্ডস্টোরেজ নেই। ফলে কৃষকরা উৎপাদিত পণ্য দ্রুত বিক্রি করতে বাধ্য হন, যা দামের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সরকার প্রায়ই কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় নীতিগত উদ্যোগ নেয়। যেমন—সরকারি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ, ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে কৃষকরা এর সুফল পান না। সরকার কৃষিপণ্য ন্যায্যমূল্যে ক্রয়ের যে ঘোষণা দেয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হয় না অথবা কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সংগ্রহ করা হয় না। ফলে কৃষকরা সুবিধাবঞ্চিত থাকেন।

বাংলাদেশে অনেক সময় কৃষিপণ্যের অতিরিক্ত আমদানি করা হয়, যা স্থানীয় কৃষকদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন—যখন স্থানীয়ভাবে পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো হয়, তখন যদি বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়, তাহলে স্থানীয় কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রিতে সমস্যায় পড়েন। আন্তর্জাতিক বাজারেও বড় দেশগুলোর প্রভাবশালী কৃষি নীতির কারণে বাংলাদেশের কৃষকরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেন না।

কৃষকরা বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম করেও ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয় না। অনেক কৃষক ফসল উৎপাদন ছেড়ে বিকল্প পেশার সন্ধান করেন। ফলে কৃষি ক্ষেত্রে জনশক্তির অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা অনেক সময় ঋণের ফাঁদে পড়েন। ব্যাংক থেকে ঋণ না পেলে তারা মহাজন বা এনজিও থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হন।

একটি সুসংগঠিত কৃষি অর্থনীতি গড়ে তুলতে হলে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য দরকার কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর নীতিমালা, উন্নত কৃষি অবকাঠামো, মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণে আনা, সার ও বীজের মূল্য সহনীয় রাখা, কৃষি ঋণের সহজলভ্যতা। বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদন বৃদ্ধির পরও ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করা দরকার। কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে—এই সত্য অনুধাবন করে পরিকল্পিত ও টেকসই কৃষি নীতির বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই কৃষি খাতকে লাভজনক করা সম্ভব।

জাফরিন সুলতানা

শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন / মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ জোরদার করতে হবে: তারেক রহমান

ফ্রি-কিকে গোল, ক্লাব বিশ্বকাপে মেসির নতুন রেকর্ড

মাইক্রোসফট অফিসের কাছে বড় বিস্ফোরণ

রাজশাহীতে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি আতঙ্ক

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলে বড় বিস্ফোরণ

মিরাজকে দ্বিতীয় টেস্টে পাচ্ছে বাংলাদেশ

৮ ছানাসহ মা পাতি সরালি ফিরেছে আপন ঠিকানায়

সন্ধ্যার মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে ঝড়

ক্লাব বিশ্বকাপে বড় অঘটন, পিএসজিকে হারিয়ে দিল ব্রাজিলের ক্লাব

দাঁত ভালো রাখতে একটি টুথব্রাশ কতদিন ব্যবহার করা উচিত?

১০

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত : গত ২৪ ঘণ্টায় যা যা ঘটল

১১

পিরোজপুরে ব্রিজ ভেঙে খালে কয়লাবোঝাই ট্রাক, যান চলাচল বন্ধ

১২

ট্রাম্পের সঙ্গে পাকিস্তানের বৈঠক কী বার্তা দিচ্ছে

১৩

ইসরায়েলি হামলা বন্ধ হলেও ভয়াবহ বিপদে পড়তে পারেন খামেনি

১৪

জেনেভা বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন কারা, উদ্দেশ্য কী

১৫

নিজ বাড়িতে মিলল ইসরায়েলি ২ নারীর গুলিবিদ্ধ মরদেহ

১৬

বারবার ন্যাড়া হলে কি সত্যিই চুল ঘন হয়?

১৭

২ কোটির বরাদ্দ রাস্তায় হাঁটতে হচ্ছে কাদায়!

১৮

ইরান পারমাণবিক বোমা বানাতে পারে দুই কারণে

১৯

খামেনিকে হত্যার শঙ্কা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পুতিন

২০
X