প্রকৃত নাম লেভ ডেভিডো ভিচ ব্রোনসটেইন হলেও বিশ্বের লাখো কোটি বঞ্চিত, নিপীড়িত ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে তার পরিচয় লিওন ট্রটস্কি নামে। তৎকালীন রাশিয়া সাম্রাজ্যের (বর্তমান ইউক্রেন) খোরশান প্রদেশে এক ধনী ইহুদি পরিবারে তার জন্ম ১৮৪৭ সালের ৭ নভেম্বর। বাবা প্রচুর ধন-সম্পত্তির মালিক হলেও ট্রটস্কি মার্কসবাদের দীক্ষা নিয়ে লড়াই করেছেন সাধারণ কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের পক্ষে। প্রথম জীবনে তিনি অবশ্য মার্কসবাদের বিপক্ষে ছিলেন। তবে রাশিয়ান সুন্দরী প্রেমিকা ও পরে প্রথম স্ত্রী আলেকজান্ডা সোকোলোভস্কিয়ার প্রভাবে ক্রমেই তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বসেরা একজন বিপ্লবী, রাজনীতিবিদ ও মার্কসবাদের তাত্ত্বিক গুরু। মস্কোতে জেলে থাকা অবস্থাতেই ১৮৯৯ সালে তিনি আলেকজান্ডাকে বিয়ে করেন এবং বিয়ের পরপরই তাদের উভয়কে রাজনৈতিক কারণে চার বছরের জন্য সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। সাইবেরিয়া থেকে তিনি পালিয়ে লন্ডনে চলে যান। সেখানে রাশিয়ার রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতি পরিবর্তনের তিন দিকপাল জিওগি প্লেখানভ, ভ্লাদিমির লেনিন, জুলিয়াস মারটোভেরসহ আরও অনেকের সান্নিধ্য লাভ করেন। সেখান থেকেই পেরো (যার অর্থ পিতা বা কলম) নামে তিনি অসাধারণ সব রচনা প্রকাশ করতে থাকেন। ১৯০৪ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত সময়ের লেখা নিয়ে ট্রটস্কি তার কালজয়ী বই (তাত্ত্বিক সংকলন) ‘পার্মানেন্ট রিভলিউশন’ প্রকাশ করেন। এই সময়ে বিভিন্ন কারণে লেলিনের সঙ্গে তার মতপার্থক্য ও তিক্ততা সৃষ্টি হয়। এরপর যেসব ঘটনা ট্রটস্কির জীবনের বাঁক বারবার পরিবর্তন করেছে, তার মধ্যে রয়েছে ১৯০৫ সালে রাশিয়ার পিটার্সবার্গে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষের ধর্মঘট ও শ্রমিক বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে তার বিচার, সাইবেরিয়ায় নির্বাচন, তার দ্বিতীয় বিয়ে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বিপ্লব, ১৯১৭ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত রেড আর্মি তথা প্রতিরক্ষা বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান, বৃহত্তর ও রাশিয়া অঞ্চলে গৃহযুদ্ধ, লেলিনের মৃত্যু (১৯২৪), পদ ও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দেশত্যাগ ও তুরস্ক, ফ্রান্স, নরওয়ে, মেক্সিকো প্রভৃতি দেশে আত্মগোপন ইত্যাদি। একপর্যায়ে ট্রটস্কির সঙ্গে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের দীর্ঘতম সময়ের রাজনৈতিক নেতা ও শাসক জোসেফ স্টেলিনেরও মতপার্থক্য ঘটে। ১৯৩৬ সালে রাশিয়ার মস্কোতে স্টেলিনকে হত্যাচেষ্টা দায়ে আসামিদের অনুপস্থিতিতেই বিচার হয় এবং বিচারে দোষীসাব্যস্ত হওয়ায় ট্রটস্কিসহ মোট ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৩৯ সালে ট্রটস্কি ভিয়েনায় আশ্রয় নেন। ওই বছর মার্চ মাসে তাকে একবার হত্যাচেষ্টা করা হলেও সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান। তারপর রাশিয়ান সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এন কে ভি ডি তাকে হত্যার জন্য বেশ কয়েকজন কুখ্যাত কিলার বা এজেন্ট নিয়োগ করে। ১৯৪০ সালের ২৪ মে নিজ দেহরক্ষীর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয় রংমিস্ত্রির ছদ্মবেশে ঘরে ঢোকা এক মেক্সিকান ও আরেক রাশিয়ান এজেন্ট। অন্য দেহরক্ষীদের প্রচেষ্টায় তিনি বেঁচে গেলেও পায়ে গুলিবিদ্ধ হন তার নাতি। এ ঘটনার ৩ মাস পর ১৯৪২ সালের ২০ আগস্ট স্পেনে জন্ম নেওয়া এক রাশিয়ান এজেন্ট রেমন মার্কেভার পড়ার ঘরে বই পড়ার সময় হামলে পড়ে ট্রটস্কির ওপর। এ সময় বরফ ভাঙার কাজে ব্যবহৃত একটি ছোট কুড়াল দিয়ে তার মাথার তালুতে জোরে আঘাত করা হলে কুড়ালটি প্রায় ৩ ইঞ্চি ভেতরে ঢোকে এবং মগজ পর্যন্ত পৌঁছায়। তারপরও আক্রমণকারীকে পাল্টা আক্রমণ করে তার হাত ভেঙে দেন তিনি। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে হাসপাতালে নিয়ে মাথায় অপারেশন করা হয়; কিন্তু আর সুস্থ হতে পারেননি তিনি। পরদিন ২১ আগস্ট দাপ্তরিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হয় বাম আন্দোলন ও মেহনতি মানুষের প্রবাদ পুরুষ লিয়ন ট্রটস্কিকে। পরে মেক্সিকোতে তাকে সমাহিত করা হয়।
লেখক: গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
মন্তব্য করুন