মানুষের মধ্যে সম্পর্কের মূল ভিত নির্মাণ করে মানুষের মুখনিঃসৃত শব্দবেণির সংমিশ্রণের সমষ্টিগত ভাষার প্রয়োগ। ভাষা বা কথার মধ্য দিয়ে সমাজে মানুষের মাঝে গড়ে ওঠে এক সমপ্রাণের প্রীতি সম্মিলন। যে মানুষের ভাষা বা কথার ভেতর মাধুর্য, জ্ঞান ও মমতার আঁচ যত বেশি, সে মানুষ সমাজে তত বেশি নিজের চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়ে সমাজকে বর্তমান বা ভবিষ্যৎ চলক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষই ভাষার প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ। তারা মুষ্টিমেয় কিছু শব্দের বাইরে তেমন কোনো আলাদা শব্দের প্রয়োগ করতে পারে না। মনের যথার্থ ভাব প্রকাশের মতো যথেষ্ট ভাষা তাদের শব্দঝুড়িতে নেই। সে কারণে তারা তাদের জীবনব্যবস্থা ঠিক সে জায়গাতেই স্তম্ভিত করে রেখেছে, যেখানে তাদের পূর্বপুরুষরা তাদের রেখে গিয়েছিলেন। সেই পুরোনো জায়গা থেকে তারা আর বেরোতে পারেনি বরং বেরোনোর জন্য যে প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, সে চেষ্টাও তারা করেনি কখনো।
মানুষ মানুষের সঙ্গে হৃদয়ঙ্গম হয় তার প্রকাশিত ভাষার ভেতর দিয়ে। সংকীর্ণ ভাষিত মানুষের জীবনও সংকীর্ণ হয়ে থাকে।
মানুষের মনের ভাবের পরিপূর্ণ বিকাশ বা প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে সমাজে ভাষা স্বল্প কিছু শব্দের মধ্যে ঘুরপাক খায় সে সমাজে চিন্তার ব্যাপকতা খুব বেশি প্রসারিত হয় না। চিন্তার বিস্তারের জন্য ভাষার প্রচুর সুপরিবাহী বিস্তার আবশ্যক যেটা আমাদের সমাজে একদমই চোখে পড়ে না।
আমাদের দেশের মানুষ যে ভাষা ব্যবহার করে তা প্রচলিত কিছু শব্দের সমষ্টিমাত্র। এ মুষ্টিমেয় কিছু শব্দের বাইরে গিয়ে তারা নতুন কোনো শব্দের প্রয়োগের মাধ্যমে নিজের মন মহারাজের ভাবের পরিপূর্ণ প্রকাশ করতে পারে না। প্রকৃত ভাব প্রকাশের জন্য চাই ভাষার উৎকৃষ্ট ব্যবহার। ভাষার উন্নতি ছাড়া সামগ্রিক উন্নতি চিন্তা করা যায় না। কেউ যখন একটা ভালো চিন্তা করে সেটা ভাষা দিয়েই প্রকাশ করে, আকার ইঙ্গিতের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে নিজের মনের ভাব অন্যকে বোঝানো যায় না। সভ্যতা নামক যে গল্পের ঘ্রাণে আমরা বুঁদ হয়ে থাকি, সেই সভ্যতার অগ্রগতির পেছনে ভাষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষের ভাষাজ্ঞান অত্যন্ত নিম্নমানের। তারা কোথায় কোন শব্দের ব্যবহার করতে হবে, কোথায় কোন বাক্য প্রযোজ্য সে বিষয়ে অধিকাংশেরই খুব বেশি বোধগম্যতা নেই বললেই চলে। চারপাশে বাংলা ভাষা ও শব্দ সংকটের তীব্র শূন্য স্থান অথচ সেগুলো আমাদের কারও চোখেই পড়ে না। সবাই স্বল্প কিছু শব্দের ভেতর অবরুদ্ধ। কথা বলতে গেলে বেশিরভাগেরই এখন আমতা আমতা করে হাতড়াতে হয় পারিভাষিক শব্দের পুকুরে। অর্ধেক বাংলার সঙ্গে যোগ হয় অর্ধেক ইংরেজি। ফলে সৃষ্টি হয় ভাষা ও বাক্যের অপ-খিচুড়ি। ভাষার এ সংকট যে কত বড় সংকট সেটা আমরা এখনো হয়তো টের পাচ্ছি না। আমাদের মনন শব্দভান্ডারে মুষ্টিমেয় কিছু শব্দ ছাড়া তেমন কোনো শব্দ নেই, সেই কয়েকটা শব্দ নাড়াচাড়া করেই কাটে আমাদের কথা-সময়। ভাষা বা শব্দ নামক অবরুদ্ধতায় আটকে গেছি আমরা, কেউ সে অবরুদ্ধতার দ্বার ভেঙে নতুন আলোর মশাল নিয়ে এগিয়ে আসবে তেমন কোনো উদ্যোগ এখন আর চোখে পড়ে না। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, লালন ফকির, জীবনানন্দ দাশরা বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিকভাবে যেখানে নিয়ে গেছেন, পরবর্তী সময়ে তেমনটি চোখে পড়েনি। ক্রমাগত বাংলা তার গুরুত্ব হারিয়ে ডুবতে বসেছে। এ ডুবন্ত অবস্থা থেকে টেনে তোলার মতো তেমন লেখক কই আমাদের, কই সেই কালির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা জ্যোতির্ময় শব্দ ও বাক্যশিল্পীরা।
সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে মানুষের কথা বলা তিনবেলা খাবারের মতোই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মানুষ যদি মানুষের সঙ্গে যথাযথ ভাষার মধ্য দিয়ে নিজের মনের ভাব প্রকাশ না করে, তাহলে মানুষ মানুষের থেকে দূর সমুদ্রের মাছ ধরার নৌকায় মিটমিট করে জ্বলা বাতির মতো অস্পৃশ্য হয়ে উঠবে।
প্রাচীন মিশরের একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি ছিল সবাই মিলে একসঙ্গে বসে বিভিন্ন আলোচনার মধ্য দিয়ে নতুন নতুন ভাষার সৃষ্টি করা এবং সে শব্দের যথাযথ প্রচলন ঘটানো। সেই প্রাচীন সময়ে মানুষগুলো ভাষার গুরুত্ব এতটা অনুধাবন করেছিলেন, যার ফলে তারা নতুন নতুন সৃষ্টির বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ ভাষার গুরুত্বের বিষয়টি তারা সেই কত হাজার বছর আগে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, যা আমরা এ আধুনিক সময়েও পারছি না। যার থেকে আমরা মিশরীয়দের উন্নতির বা চিন্তার ঊর্ধ্বতন সৌন্দর্য সম্পর্কে আঁচ করতে পারি। তাদের তৎকালীন সময়ের সেই আধুনিক চিন্তার পরিবর্তে আজ এ আধুনিক সময়ে এসেও আমরা এমন উন্নত ভাবনা ভাবতে পারি না।
আমাদের অঞ্চলে একটা দুর্বল শব্দের প্রচলন আছে। আমরা অনেক সময়ই কোনো সৌন্দর্য বা আশ্চর্যের বিষয় দেখলে বলে ফেলি—‘বিষয়টি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতন না’। এই কথা যখন কেউ বলে তার মানে তার কাছে ওই বিষয়ের বিস্ময় দৃশ্যতা প্রকাশ করার মতো যথেষ্ট শব্দ বা ভাষার ভান্ডার নেই, যা দিয়ে সে সেটার যথাযথ বর্ণনা করবে। এজন্য আমি এই বাক্যটিকে শব্দ দুর্বলতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছি। মানুষের যদি যথেষ্ট শব্দ বা ভাষার গচ্ছিত ভান্ডার থাকে তাহলে পৃথিবীর এমন কিছু নেই যার যথার্থ বর্ণনা তার পক্ষে বর্ণিত করা সম্ভব নয়।
অনেককে দেখেছি অর্ধেক বাংলা আর অর্ধেক ইংরেজি এক পাতিলে ঢেলে মনের ভাব প্রকাশের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে কিন্তু তারপরও সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ হয় না। অর্ধেক বাংলা ও অর্ধেক ইংরেজি মিশিয়ে তারা যেটা তৈরি করে সেটা এক প্রকার অপখিচুড়ি। সে খিচুড়ি দেখতে অনেক সৌন্দর্যমণ্ডিত মনে হলেও তার স্বাদ বড়ই তিক্ত ও অভোজ্য। বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে কানেক্টে হওয়ার জন্য ইংরেজি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভাষা কিন্তু সেটা অবশ্যই নিজের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে নয়। বাংলার আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে, যেটা আমাদের চোখে এখন আর ধরে পড়ে না, কারণ আমাদের সেই চোখ এখন আর নেই। বাংলার এ সংকট সময়কে উতরানোর জন্য বাংলার যথেচ্ছ ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা তার যথাযথ গুরুত্ব হারাতে বসেছে কারণ বাংলার শব্দের ব্যবহার সীমিত হয়ে আসছে। এ শব্দ ও ভাষা সংকটকে আমাদের অতিক্রম করে ভাষার যথাযথ প্রসারের জন্য সামগ্রিকভাবে একত্রে কাজ করে যেতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক