ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি ও মানবিক বিপর্যয়। এটি সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা অসুস্থ মানসিকতার প্রতিফলন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের ঘটনা ক্রমেই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে, যা নারীদের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও মানবাধিকারের জন্য এক চরম হুমকি। প্রতিটি ঘটনা পুরো সমাজের মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এমন একটি সংকটকে সমূলে নির্মূল করতে হলে শুধু কঠোর আইন বা বিচ্ছিন্ন সামাজিক আন্দোলনই যথেষ্ট নয়। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, নারীর প্রতি অবমাননাকর মানসিকতা ও শিক্ষার অভাবকে চিহ্নিত করে তার সমাধান করতে হবে। শিক্ষা, আইন এবং সামাজিক সচেতনতার মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করতে না পারলে ধর্ষণ রোধ করা কখনোই সম্ভব নয়। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র, প্রতিটি স্তরে নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সম্মিলিত উদ্যোগই হতে পারে আশার আলো।
বাংলাদেশের মতো সমাজে ধর্ষণের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। নারীকে এখনো অনেক ক্ষেত্রে ভোগের বস্তু হিসেবে দেখা হয়, যা ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের মনে গেঁথে যায়। পরিবারের মধ্যে ছেলেশিশুদের প্রাধান্য দেওয়া, মেয়েশিশুদের সীমাবদ্ধ রাখার সংস্কৃতি এ মানসিকতাকে আরও শক্তিশালী করে।
ধর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করার প্রবণতাও সমাজে ভয়াবহ রকমের প্রচলিত। পোশাক, চলাফেরা, এমনকি নির্দিষ্ট সময়ের পর ঘরের বাইরে থাকাকে অপরাধের কারণ হিসেবে দেখানো হয়, যা অপরাধীর দুঃসাহস আরও বাড়িয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবার ও সমাজের চাপের কারণে ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। সামাজিক সম্মানের দোহাই দিয়ে ভুক্তভোগীকে চুপ থাকতে বাধ্য করা হয়। এর ফলে অপরাধীরা বারবার পার পেয়ে যায় এবং অপরাধের সংস্কৃতি আরও গভীরে প্রোথিত হয়।
এ ছাড়া ভুক্তভোগীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে আরও কোণঠাসা করে ফেলে। বিচার চাইতে গিয়ে কুসংস্কার ও লজ্জার বেড়াজালে আটকে পড়ে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এ পরিস্থিতি বদলাতে হলে সমাজের মানসিকতা পাল্টাতে হবে নারীর প্রতি সম্মানবোধ ও সমতার ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
শিক্ষা সমাজ পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা ও জেন্ডার সমতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রায় অনুপস্থিত। স্কুল-কলেজে যৌন শিক্ষা নিয়ে এখনো ট্যাবু কাজ করে অথচ শিশুদের ছোটবেলা থেকেই যদি সম্মতি, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং লিঙ্গ সমতার বিষয়ে সচেতন করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তারা আরও সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে উঠবে।
এ ছাড়া পর্নোগ্রাফি এবং অবাধ ইন্টারনেট ব্যবহার কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বিকৃত মানসিকতা তৈরি করতে পারে। একদিকে যৌনতা নিয়ে পরিবারের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা নিষিদ্ধ, অন্যদিকে অনিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল কনটেন্টের সহজলভ্যতা—এ দুইয়ের ফাঁক গলেই অনেক তরুণের বিকৃত মানসিকতা গড়ে ওঠে।
তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে জেন্ডার সংবেদনশীল শিক্ষা চালু করতে হবে। শিক্ষকদেরও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা শিক্ষার্থীদের মানবিক মূল্যবোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দিতে পারেন। পাশাপাশি পিতামাতারাও যাতে সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন, সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
ধর্ষণবিরোধী আইন থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বিচারের দীর্ঘ সময়, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ এবং তদন্তের গাফিলতির কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ জানাতে গেলেই নানা ধরনের হয়রানির শিকার হন। নারী পুলিশ কর্মকর্তা বা সংবেদনশীল পরিবেশের অভাব, ভুক্তভোগীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদাসীনতা—এসব বাধা নারীদের বিচার পাওয়ার পথকে কঠিন করে তোলে।
ধর্ষণ প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধানের জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, স্কুল-কলেজে বাধ্যতামূলকভাবে জেন্ডার সংবেদনশীল ও নৈতিক শিক্ষা চালু করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে লিঙ্গ সমতা, পারস্পরিক সম্মান ও মানবাধিকারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। স্থানীয় পর্যায়ে নারী ও শিশু সুরক্ষা কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যারা ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের সহায়তা, পরামর্শ ও আইনি সহায়তা প্রদান করবে।
আইনি কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করতে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রতিটি মামলার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা উচিত, যাতে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ভুক্তভোগীদের আরও কষ্ট না দেয়। পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়াকে আরও সংবেদনশীল ও দক্ষ করে তুলতে হবে, যেন প্রাথমিক প্রমাণ সংগ্রহে কোনো গাফিলতি না থাকে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন অপরাধ করার সাহস না পায়। এ ছাড়া গ্রাম-শহর সর্বত্র ধর্ষণ প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
একটি সহমর্মিতাপূর্ণ, মানবিক ও নিরাপদ সমাজ গড়তে হলে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব নিতে হবে। ধর্ষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গণমাধ্যম এবং সর্বোপরি সাধারণ জনগণ—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নারী ও শিশুদের জন্য একটি সম্মানজনক ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এখনই সময় ন্যায়বিচার ও মানবিকতার পক্ষে দাঁড়ানোর।
হৃদয় পান্ডে, শিক্ষার্থী
মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ