বাংলাদেশে নারীদের জন্য টোকেনিজমের ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৪৭ সালের পর থেকে নারীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি এক প্রকার দৃশ্যমান হলেও তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিম্বলিকভাবে বা সীমিত অবস্থানে রাখা হয়। এটি এক ধরনের সাংকেতিক অন্তর্ভুক্তি, যেখানে নারী কিংবা সংখ্যালঘুদের শুধু উপস্থিতি দেখানোর জন্য তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে তাদের প্রকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা নেতৃত্বের সুযোগ দেওয়া হয় না। শিক্ষা, সংস্কৃতি, পেশা ও রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও অনেক ক্ষেত্রেই তা আংশিক এবং গঠনমূলক পরিবর্তন নয়। বর্তমানে বিভিন্ন সংগঠন, মিছিল ও পরিবারে নারীরা যদিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা তাদের হাতে থাকে না। এটি টোকেনিজমেরই পরিচায়ক। মিডিয়া ও রাজনৈতিক পদে নারীদের উপস্থিতি হলেও তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সীমিত।
কোথায় নেই টোকেনিজম!: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও ভূমিকা প্রায়ই প্রতীকী। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের উপস্থিতি দেখা গেলেও তা বাস্তবে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ। মিডিয়ায় নারীর উপস্থিতি বৃদ্ধি পেলেও ভূমিকা প্রায়ই পুরুষদের সহায়ক বা সজ্জার অংশ হিসেবে সীমিত থাকে। নারীদের প্রগতিশীল চিত্রায়ণ না করে ঐতিহ্যবাহী ভূমিকায় দেখানো হয়। এটি তাদের সামগ্রিক ক্ষমতায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীরা উচ্চপদে স্থান পেলেও তা প্রায়ই টোকেনিজমের উদাহরণ। তাদের সামর্থ্য ও দক্ষতার পরিবর্তে নমনীয়তার ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশ নারীর পেশাগত উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করে এবং প্রকৃত ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ সীমিত রাখে। পারিবারিক ক্ষেত্রেও নারীরা অনেক সময় সীমিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং অধিকাংশ কাজ প্রথাগতভাবেই পুরুষদের সহায়তাকারী হিসেবে দেখা যায়।
বিভিন্ন সামাজিক ও উন্নয়নমূলক সংগঠনগুলোতে নারীরা শুধু সদস্য হিসেবে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মূলত পুরুষরাই প্রাধান্য পান। নারীদের ব্যানারের সামনে রাখা হলেও কিংবা মিছিলে অংশগ্রহণ করলেও অনেক সময় তাদের ভূমিকা শুধু দর্শনীয় বা প্রতীকী হয়। তারা নেতৃত্বে উঠে আসতে পারেন না। সংগঠনগুলো ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টা চালালেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের কার্যকারিতার অভাব থাকে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, অনেকেই টোকেনিজমের সঙ্গে আপত্তি করেন না। কারণ এটি অন্তর্ভুক্তির কাছাকাছি একমাত্র সুযোগ হতে পারে। কিছু সংগঠন এ পরিস্থিতির সুবিধা নিয়ে নিজেদের অন্তর্ভুক্তির উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে চায়।
গত বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের থিম ছিল ‘ইনস্পায়ার ইনক্লুশন’। তবে অন্তর্ভুক্ত হতে চাওয়ার জন্য অনেক সময় টোকেনিজমের সৃষ্টি হয়। টোকেনিজম হলো এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে কেউ দেখতে চায় যে, তারা অপ্রতিনিধিত্বকারী সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য সমান সুযোগ প্রদান করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা করা হয় না। অন্তর্ভুক্তি ও টোকেনিজমের মধ্যে সীমা অনেক সময় মিশে যায়, এমনকি যারা উন্নয়ন বা সামাজিক ন্যায্যতার কাজে যুক্ত তাদেরও।
রাজনীতির টোকেনিজম: বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের ৩৫০টি আসনের মধ্যে ৫০টি আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত। যদিও আসনগুলো নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত, কিন্তু সরাসরি নির্বাচনের অনুপস্থিতি নারীদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি করে। রাজনৈতিক দলের মনোনয়নের মাধ্যমে সংসদে প্রবেশ করায় এ নারীরা প্রায়ই দলীয় আনুগত্য প্রদর্শনে সীমাবদ্ধ থাকেন এবং স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা নেতৃত্বের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
অন্যদিকে কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিরা শুধু কোটা পূরণের জন্য মনোনীত হন, কিন্তু তাদের দায়িত্ব পালন করেন স্বামী বা কোনো পুরুষ অভিভাবক। যদিও প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে রয়েছেন নারী, দলের সামগ্রিক চিত্রে নারী নেতৃত্বের অভাব স্পষ্ট।
জুলাই ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। নারীরা শুধু সমর্থক হিসেবে নয়, নেতৃত্বের ভূমিকায়ও ছিলেন। তাদের উপস্থিতি আন্দোলনের সফলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও তা টোকেনিজমের ধারণাকে পুরোপুরি চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে নারীর নেতৃত্ব ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দুর্বল উপস্থিতি টোকেনিজমের ধারণাকে আরও প্রকট করেছে। নাগরিক কমিটি বা বৈষম্যবিরোধীদের আহ্বায়ক কমিটির মুখপাত্র হিসেবে দুজন নারীর উপস্থিতিও কিন্তু চমৎকার উদাহরণ।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর প্রতি টোকেনিজম একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা। রুয়ান্ডার পার্লামেন্টে নারীদের অংশগ্রহণের হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। সেখানে ৬০ শতাংশেরও বেশি আসনে নারী সদস্য রয়েছেন। তবে এ উচ্চ প্রতিনিধিত্ব সত্ত্বেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাদের ভূমিকা প্রায়ই প্রতীকী বলে সমালোচনা রয়েছে। অনেকের মতে, নারীদের এ উপস্থিতি মূলত সংখ্যাগত এবং প্রকৃত ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের প্রভাব সীমিত। এটি নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে প্রকৃত অর্থে বাধাগ্রস্ত করে এবং টোকেনিজমের উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়।
ভারতে লোকসভা ও রাজ্যসভায় নারীর জন্য ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের প্রস্তাব বারবার উঠলেও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। সর্বশেষ ২০২৩ সালে নারী সংরক্ষণ বিল সংসদে উত্থাপন করা হলেও সেটি এখনো পাস হয়নি। ফলে নারী নেত্রীদের অংশগ্রহণ প্রায়ই প্রতীকী পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে। ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মণিপুরের কাংপোকপি জেলায় বিজেপি সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে একমাত্র নারী মন্ত্রী নেমচা কিপগেনকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে স্থানীয় নারী সমাজ উত্তাল হয়ে ওঠে। এই সময় BJP’s ‘Nari Shakti’ is only ‘tokenism and gimmickry’ ধারণাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন রয়েছে। তবে এ আসনগুলোতে মনোনীত নারীদের অধিকাংশই রাজনৈতিক পরিবার থেকে আসেন, যা তাদের স্বাধীন অবস্থানকে বাধাগ্রস্ত করে। রাজনৈতিক দলের মনোনয়নের মাধ্যমে আসার কারণে তারা প্রকৃত ক্ষমতায়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের নির্বাচন উদযাপিত হলেও নারীর প্রার্থিতা প্রায়ই ভোট টানার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কমলা হ্যারিস সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান ও এশীয়-আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট হলেও তার প্রার্থিতা ডেমোক্রেটিক পার্টির সংখ্যালঘু ভোটারদের আকৃষ্ট করার কৌশল হিসেবে দেখা হয়েছে। গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে সোচ্চার থাকা সত্ত্বেও নারীর ভোট নিশ্চিত করতে তার ব্যর্থতা কিছু বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়েছে। এ পরিস্থিতি নারীদের প্রার্থিতাকে টোকেনিজমের উদাহরণ হিসেবে আরও স্পষ্ট করে।
কী বলছে গবেষণা: গবেষণা বলছে, উচ্চমর্যাদাপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা কম থাকলে তাদের প্রচেষ্টা প্রায়ই অবমূল্যায়িত হয়। এ পরিস্থিতিতে তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হতে পারেন। তবে টোকেন নারী হিসেবে নেতৃত্বের সুযোগ পেলে, তারা বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
Harvard Kennedy School-এর গবেষণা ‘Female Tokens in High-Prestige Work Groups: Catalysts or Inhibitors of Group Diversification’ অনুযায়ী, কর্মগোষ্ঠীতে নারীর সংখ্যা কম থাকলে তাদের ‘টোকেন’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতে তারা অতিরিক্ত নজর ও চাপ অনুভব করেন, যা কার্যক্ষমতা সীমিত করে। সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্ত না করলে বৈচিত্র্য বৃদ্ধির সুযোগও ব্যাহত হয়।
প্রগতিশীল সময়েও বিজ্ঞাপনশিল্পে নারীর ঐতিহ্যবাহী বা অবাস্তবিক ভূমিকা দেখানোর প্রবণতা রয়েছে। UN Women-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, ৮৭ শতাংশ ভারতীয় অংশগ্রহণকারী মনে করেন, মিডিয়ায় নারীর প্রথাগত ভূমিকাতেই তুলে ধরা হয়। বিএফএসআই ও অটোমোবাইল খাতেও নারী নেতৃত্বের অনুপস্থিতি ও অতিরঞ্জিত চিত্রায়ণের উদাহরণ।
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ: নারীর টোকেনিজম থেকে মুক্ত করতে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজে প্রকৃত অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা জরুরি। মানসম্মত শিক্ষা ও নেতৃত্বের প্রশিক্ষণের সুযোগ নারী ক্ষমতায়নের পথ সুগম করবে। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন প্রবর্তন এবং সাধারণ আসনে নারীর মনোনয়ন বৃদ্ধি তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ, বৈষম্যহীন মজুরি ও সমান সুযোগ নারীর পেশাগত সমতা অর্জনে সহায়তা করবে। পাশাপাশি নারীর প্রগতিশীল চিত্রায়ণ ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনবে, যা টোকেনিজমের ধারণাকে দূর করতে সহায়ক হবে।
শেষ কথা: তত্ত্বগতভাবে অন্তর্ভুক্তি সবার জন্য ইতিবাচক হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা অন্তর্ভুক্তিকে ভয় পান। কারণ এটি তাদের আধিপত্যের জন্য হুমকি। শেষ পর্যন্ত তারা মনে করেন যে, আরও অনেকের জন্য জায়গা তৈরি করা তাদের নিজের জায়গা নেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
টোকেনিজমের মাধ্যমে নারীর অন্তর্ভুক্তি দীর্ঘমেয়াদে তাদের প্রকৃত ক্ষমতায়নে বাধা সৃষ্টি করে। নারীর আত্মবিশ্বাস ও নেতৃত্বের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে টোকেনিজমের সীমাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব। সামাজিক, পেশাগত ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর সঠিক ভূমিকা নিশ্চিত করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
লেখক: পরিবেশ ও নারী অধিকারকর্মী
মন্তব্য করুন