কাজী বনফুল
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৫, ০৮:৫৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফিলিস্তিনে হামলা বন্ধ হোক

ফিলিস্তিনে হামলা বন্ধ হোক

ইসরায়েলের এমন অকল্পিত আক্রমণে ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। প্রবীণ, তরুণ, শিশু, নারী, পুরুষ সবার জীবনই সেখানে বিপন্ন। কারও জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই, নেই কোনো নিশ্চিত বাসস্থান। যাযাবরের মতো প্রাণ সংকটে ঘুরে বেড়াচ্ছে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। শিশুদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিনের আকাশ। মানুষের হাহাকারে বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে সেখানকার জনজীবন। ফিলিস্তিনের মানুষের আহাজারি ও বিলাপে বাকরুদ্ধ পুরো বিশ্ব।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের এ দ্বন্দ্বের ইতিহাস অনেক পুরোনো। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের পতনে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যকে মাছের ভাগার মতো ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয় ব্রিটেন ও ফ্রান্স। ১৯১৭ সালে জেমস বেলফোর ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়; যা ইতিহাসে বেলফোর ঘোষণা হিসেবে পরিচিত। বেলফোর ঘোষণার পর ইউরোপ থেকে বহু ইহুদি জাতি ফিলিস্তিনে এসে বসবাস করতে থাকে।

আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের ইহুদি নিধনের মধ্য দিয়ে ইহুদিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভব করে কর্তৃপক্ষ। সে কারণেই ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হয়েও ইহুদিরা পায় ভূমির প্রায় ৫৭ শতাংশ ও ফিলিস্তিনিরা ৪৩ শতাংশ। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এ দ্বন্দ্ব চলছেই। মৃত্যুর পর মৃত্যু সংঘাতের পর সংঘাত কোনোভাবেই এর কোনো সুষ্ঠু সমাধান আজও হয়নি। কর্তাব্যক্তিরা বড় কোনো মৃত্যুর পাহাড় সৃষ্টি হলে তখন শুধু শোকবার্তার একটি মৌখিক ও লৌকিক শোক প্রকাশ করে বিশ্ববাসীকে সান্ত্বনা দেয় যে, আমাদের হৃদয়ও পাথর দিয়ে তৈরি নয়; আমরাও শোক প্রকাশ করতে পারি—এ শোকবার্তা তার প্রমাণ। এভাবে সেই শুরু থেকেই শুধু লৌকিক শোক প্রকাশই করে যাচ্ছে কর্তাব্যক্তিরা কিন্তু এ সংঘাত নিরসনের জন্য তাদের পর্যাপ্ত উদ্যোগ আজও চোখে পড়েনি।

কুরুক্ষেত্রের মহারণে আর্যাবর্তের অজস্র প্রাণের যে চিতা রচিত হয়েছিল, সে চিতাকে ন্যায়ের বিশুদ্ধ চিন্তার প্রকোষ্ঠে সৃজিত করবে যে, মহারথীরা তারাই সেদিন হয়ে উঠেছিল পক্ষপাতদুষ্ট। তারাই সেদিন যুদ্ধ করেছিল হাতে রক্তের দাগ নিয়ে। কুরুভূমির বুকে তারাই সেদিন রচনা করেছিল মৃত্যুর সজ্জিত সজ্জা। সেদিন যদি দেবব্রত মহামহিম ভীষ্ম ও গুরু দ্রোণাচার্য শক্ত হস্তে কঠোরচিত্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিত, তাহলে এত বড় প্রাণের বিসর্জন হয়তো এড়ানো যেত।

সেদিন দেখলাম ইসরায়েল ফিলিস্তিনের আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো বিমান হামলা করছে। সে হামলার আঘাতের লেলিহান দাবানলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে পুরো শহর। চিলে আক্রমণ করলে পাখির বাচ্চারা যেমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চিৎকার-চেঁচামেচির তুফান তোলে লুকোতে চায় কোনো নিশ্চিত আশ্রয়ে, ঠিক তেমনি সেখানে থাকা ছোট ছোট বাচ্চাকে দেখলাম ভীষণ আতঙ্কে চিৎকার-চেঁচামেচি করে একটু বেঁচে থাকার আশ্রয়ের খোঁজে গুটি গুটি পায়ে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। চারপাশ জুড়ে মানব সৃষ্ট এ আগুনের ভয়ংকর দাবানলে পুরো শহর পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। একটি ছোট শিশুকে দেখলাম ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভাঙা কংক্রিটের ভেতর চাপা পড়ে ছটফট করে কাতরাচ্ছে। শরীর-মুখ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। এমন অমানবিক নিষ্ঠুর দৃশ্যতে যাদের মানবিক জাগরণ না ঘটে এবং শুধু লৌকিক শোক প্রকাশে যারা সীমাবদ্ধ থেকে কেবল কাগজের অপচয় করছে, তাদের হৃদয়ে শোক কতটুকু আছে সেটা আসলেই সন্দেহের বিষয়। এ দুপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কেন এর নির্দিষ্ট সমাধান করা হচ্ছে না বা চেষ্টা করা হচ্ছে না; সেটা অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করে মানুষের মনে।

যে বয়সে শিশুদের বই-খাতা নিয়ে নির্বিঘ্নে স্কুলে যাওয়ার কথা, নতুন নতুন শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের ভিত মজবুত করার কথা, প্রাণভরে উচ্ছ্বাসে বাঁচার কথা; সেই বয়সে তারা গোলাবারুদ, বোমা, পৃথিবীর স্বার্থপর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যবাদীদের স্বার্থপর আচরণ, বিভীষিকাময় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। ওই শিশুরা নিজেদের ভেতর ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য কোন শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠবে, তা খুব সহজেই অনুমান করা যায়।

কত স্বপ্ন দিয়ে গড়া সংসার কত আবেগ দিয়ে নির্মিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অথচ সে সংসার, ঘর, পরিবার কিছু অল্প সময়ের ভেতর মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন দেহে মানুষের জীবনের গল্পের অযাচিত অশোভন অবসান হচ্ছে। শিশুরা বড় হচ্ছে একটি ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারগ্রস্ত মস্তিষ্ক নিয়ে। চারপাশ জুড়ে অদ্ভুত এক ভয় ঘিরে রেখেছে মানুষের মন।

আমরা অবশ্যই এ বিপর্যয়, হত্যা, খুন ও সংঘাতের অবসান চাই। আমরা ওই অঞ্চলের মানুষের মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করে ব্যথিত হৃদয়ে বিশ্বের সমঝোতা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাই, তারা যেন স্বার্থের চেতনাজাগ্রত ঘুমের অভিনয়ের পারদর্শিতা না দেখিয়ে, প্রচণ্ড বিবেকের চপেটাঘাতে জাগ্রত হয়ে যথাযথ হস্তক্ষেপে উল্লেখযোগ্য সমাধানে বন্ধ করে দেয় এ রক্তের জোয়ার। মানুষের ক্রন্দন, রক্তের প্রবাহে বিশ্বমাতার হৃদয়ে গভীর রক্তক্ষরণ হয়ে কেঁপে ওঠে সমগ্র মানবিক প্রাণ। তাই সবার একত্রিত সিদ্ধান্তে বন্ধ হোক এ যুদ্ধের দামামা, পৃথিবীব্যাপী বেজে উঠুক শান্তির তূর্য।

যারা পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নির্মাতা, যাদের হাতে রয়েছে এ রক্তের দাগ মুছে ফেলার শক্তি, যারা চাইলেই এ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন; আমরা চাই তারা কঠিন ও কঠোর হাতে এ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে যথাযথ উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করবেন।

লেখক: প্রাবন্ধিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমি থাকাকালে চীন তাইওয়ানে হামলা করবে না : ট্রাম্প

ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক চলাকালে ইউক্রেনে ৮৫ ড্রোন হামলা

গাজীপুরে সাত মাসে সড়কে প্রাণ গেছে ৩৪ জনের

ঢাকায় আনা হলো হাতির আঘাতে আহত চিকিৎসকদের

খালেদা জিয়ার জন্মবার্ষিকীতে ক্যালিফোর্নিয়ায় দোয়া মাহফিল

হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ

হোয়াটসঅ্যাপে নতুন ফিচার, জেনে নিন কী থাকছে

জনগণ নির্বাচনমুখী হলে কেউ আর আটকতে পারবে না: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

আগামী নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে : গোলাম পরওয়ার

ইংল্যান্ডের ১৩৬ বছরের রেকর্ড ভাঙতে যাচ্ছেন বেথেল

১০

দেশে আরেক চেতনার উদ্ভব হয়েছে : রিজভী

১১

বানানীতে রাব্বি হত্যা নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিল র‌্যাব

১২

তরুণদের রক্তে ফিরতে পারে ত্বকের তারুণ্য

১৩

গণতন্ত্রের জন্য জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে হবে : সালাহউদ্দিন 

১৪

শরতের প্রথম দিন আজ

১৫

বিপুল অস্ত্র উদ্ধার, রাজশাহীতে বাড়ি ঘিরে রেখেছে সেনাবাহিনী

১৬

কোনো যুদ্ধবিরতি, ‍কোনো চুক্তি হয়নি : বৈঠকের ফল ‘শূন্য’

১৭

৬৩ বছরে পা রাখতেন রক লেজেন্ড আইয়ুব বাচ্চু

১৮

টাকার বিনিময়ে শেখ মুজিবকে নিয়ে পোস্ট? সামনে এলো সত্য ঘটনা

১৯

যমুনায় দ্রুত বাড়ছে পানি, প্লাবিত নিম্নভূমি

২০
X