অন্য মানুষের জীবন বাঁচানোর তাগিদে প্রতিদিন নিজের জীবন বাজি রাখতেন মোহাম্মদ বাহলুল। ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির এ স্বাস্থ্যকর্মী প্রতিদিন এক নতুন অজানা কর্মস্থলের উদ্দেশে নিজের ঘর থেকে রওনা দিতেন। দিনশেষে আদৌ পরিবারের কাছে ফিরতে পারবেন কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা থাকত না। ঈদুল ফিতরের মাত্র এক সপ্তাহ আগে তাকে পাঠানো হয় রাফাহর তাল আস-সুলতান এলাকায়। ইসরায়েলের হামলার বিভীষিকাময় ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে আহতদের বের করে আনা এবং নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করা ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু তিনি এবং তার সহকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরই ইসরায়েলের সেনাসদস্যরা এলাকাটি ঘিরে ফেলে। ভেতরে যাওয়ার ও বাইরে আসার সব রাস্তা বন্ধ করে দেয় তারা। এ আটকে পড়া দলের সঙ্গে বাইরে অবস্থানরতদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে রাফাহ জুড়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে, ভেতরে বন্দি সবাইকে হত্যা করা হবে।
অতঃপর তাদের উদ্ধার করতে একটি দল গঠন করে ওই এলাকায় পাঠানো হয়। তারাও আক্রমণের শিকার হয়। এলাকায় অবস্থানরত জাতিসংঘের কর্মীদের ভাষ্যমতে, গাজার বেসামরিক সাধারণ নাগরিকদের ওপর গুলি চালাচ্ছিল ইসরায়েলি বাহিনী। প্রায় এক সপ্তাহ পর, মার্চের ২৯ তারিখ বহু বাধা পেরিয়ে অবশেষে উদ্ধারকারী দল ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। তারা সেখানে গিয়ে শুধু অ্যাম্বুলেন্স, জাতিসংঘ এবং বেসামরিক নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়। আর এসবের মাঝে নিথর পড়ে ছিল বাহলুলের সহকর্মী আনোয়ার আলাতারের মরদেহ।
ঈদের দিন (৩০ মার্চ) তারা আবারও ওই বিভীষিকাময় স্থানে ফেরত যায়। সেখানে তারা বালু দিয়ে ঢেকে রাখা এক গণকবরের সন্ধান পায়। কবর থেকে উদ্ধার করা হয় আরও ১৪টি মৃতদেহ। স্বাস্থ্যকর্মীদের সবার পরিধানে ছিল তাদের কর্মক্ষেত্রের পোশাক এবং হাতে ছিল হাসপাতালের গ্লাভস। তারা যে উদ্ধারকাজ চলাকালে জরুরি চিকিৎসা দিতে গিয়ে প্রাণ হারায়, এটা তারই প্রমাণ। এ কবরের মধ্যেই পাওয়া গেছে মোহাম্মদ বাহলুলের লাশ। একই সঙ্গে তার সহকর্মী মুস্তাফা খাফাজা, ইজ্জেদিন শাত, সালেহ মোয়াম্মার, রিফাত রেদওয়ান, আশরাফ আবু লাবদা, মোহাম্মদ আবু আল-হিলা ও রায়েদ আল-শরিফেরও লাশ পাওয়া গেছে।
এই চিকিৎসাকর্মীদের হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইসরায়েল বেশ আগে থেকেই সুপরিকল্পিতভাবে তার গণহত্যামূলক যুদ্ধের অংশ হিসেবে উদ্ধার এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিশানা বানিয়ে আক্রমণ চালিয়ে আসছে। এ যুদ্ধ যেন গাজাকে জনমানবশূন্য করে ফেলার যুদ্ধ। গাজাই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র স্থান যেখানে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরও কোনো নিরাপত্তা নেই; যেখানে অ্যাপ্রন পরিহিত কোনো ডাক্তারেরও সুরক্ষা নেই। একমাত্র গাজাতেই এ নিরাপত্তার প্রতীকগুলোকে নিশানা বানিয়ে হামলা চালানো হয়।
মোহাম্মদ বাহলুলের বাবা সোবহি বাহলুলকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তিনি রাফাহর বির আল-সাবা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যক্ষ। যে সাত দিন সন্তানের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি, সেই সময়টায় তিনি ও তার স্ত্রী নাজাহ সৃষ্টিকর্তার কাছে নিরন্তর প্রার্থনা করে গেছেন যেন কোনো অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে তাদের সন্তানের প্রাণ বেঁচে যায়; যেন সে তাদের কাছে জীবিত ফিরে আসে। তারা কল্পনা করতেন যে, তাদের সন্তান হয়তো এলাকা অবরুদ্ধ হওয়ার আগে কোনোমতে পালাতে সমর্থ হয়েছিল, অথবা হয়তো সে কোনো বিধ্বস্ত বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে লুকিয়ে আছে। শেষ অবধি তারা ধারণা করতেন যে, হয়তো ইসরায়েলি সেনারা তাকে আটক করে নিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো তাকে মেরে ফেলেনি। ফিলিস্তিনি জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের কথাই শেষ পর্যন্ত যেন সত্যি হলো—ফিলিস্তিনিরা এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত; এই রোগের নাম ‘আশা’।
বাহলুল পরিবার সাহস করে আশার আলো আঁকড়ে ধরেছিল। তারপরও তাদের হৃদয়ের গহিনে একটা অব্যক্ত ভয় দানা বাঁধছিল—তাদের সন্তান মোহাম্মদ যদি আর কখনো ফিরে না আসে? কারণ গাজা অঞ্চলে এই ফিরে না আসার গল্পটা অতি পরিচিত। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে মাত্র ছয় বছরের শিশু হিন্দ রাজাব আক্রমণের শিকার হয়ে তার রক্তাক্ত শরীর নিয়ে একটা গাড়ির ভেতর আহত অবস্থায় পড়েছিল। আর পাশেই ছিল তার আপনজনদের লাশ। তাকে উদ্ধারের জন্য পাঠানো স্বাস্থ্যকর্মীদের দলকেও তখন হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। ঠিক একইভাবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় আলজাজিরার চিত্রগ্রাহক সামের আবুদাকা আহত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় খান ইউনিসের রাস্তায় পড়েছিল। তাকে বাঁচানোর জন্য যে চিকিৎসাকর্মীরা ছুটে যায়, তাদেরও মেরে ফেলে ইসরায়েলি বাহিনী।
সাত দিন মনের ভেতরের ভয়কে আশা দিয়ে প্রতিহত করে রেখেছিলেন মোহাম্মদ বাহলুলের বাবা-মা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোবহি বাহলুল তার নিঃস্বার্থ সন্তানকে উদ্দেশ্য করে লিখেন, ‘সৃষ্টিকর্তা তোমাকে এবং তোমার সহকর্মীদের আমাদের কাছে বহাল তবিয়তে ফিরিয়ে নিয়ে আনুন।’ মোহাম্মদের মৃত্যুর ঘটনা এ পরিবারের প্রথম দুর্দশার ঘটনা নয়। ইসরায়েলের গণহত্যার দরুন অনেক স্বজন হারিয়েছেন তারা। নিরাপত্তার সন্ধান করতে গিয়ে পূর্ব রাফাহতে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে খান ইউনিসের আল মাওয়াসি অঞ্চলে আশ্রয় নিতে হয়েছে তাদের।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়া হলে অন্যান্য অসংখ্য সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে তারাও পূর্ব রাফাহতে ফিরে যান। ফিরে দেখেন তাদের ঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অনেক কসরত করে দুটি কক্ষকে বসবাসযোগ্য করে তোলেন তারা। কোনোমতে যেন সেখানে রাতযাপন করা সম্ভব হয়। অস্থায়ী তাঁবু খাঁটিয়ে আবারও এলাকার বাচ্চাদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়। কারণ ইসরায়েলি হামলায় গুঁড়িয়ে গেছে এলাকার অসংখ্য স্কুল।
কিন্তু মোহাম্মদের নিখোঁজ হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে শুরু হয় ফের আক্রমণ। তাদের বাড়ির উল্টো দিকের ঘরটা বিমান হামলায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। একই সঙ্গে তার বাবার গাড়িটাও ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যতটুকু জিনিসপত্র সঙ্গে বহন করা যায়, তাই নিয়েই অগত্যা আবারও বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয় তাদের। জীবন বাঁচাতে যে কয়বার এভাবে পালাতে হয়েছে, প্রতিবারই সম্পদের পরিমাণ একটু একটু করে কমে আসছে। এই নির্মম অভিজ্ঞতা তাদের প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয় যে, দিন দিন সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনও ধুলোর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
শেষবার যখন পালাতে হলো, সেবার বাবার সঙ্গে তাঁবু খাটানোর সময় ছিল না মোহাম্মদের কাছে। একমুহূর্ত নষ্ট না করেই তিনি বের হয়ে পড়েন নিজের দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে। খান ইউনিসে সহযোগী চিকিৎসাকর্মীদের সঙ্গে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করে গেছেন। সেবা দিয়ে গেছেন। একের পর এক ডাক এসেছে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল থেকে। যখন সম্ভব হয়েছে ছুটে গেছেন এক বিধ্বস্ত এলাকা থেকে অন্য বিধ্বস্ত এলাকায়। এমনকি পবিত্র রমজান মাসজুড়ে একদিনও তিনি পরিবারের সঙ্গে ইফতার করার সুযোগ পাননি। পাঁচ সন্তানের বাবা ছিলেন মোহাম্মদ। সবচেয়ে কনিষ্ঠ সন্তান আদমের বয়স মাত্র তিন মাস। নিজের সন্তানের সঙ্গে খেলার সুযোগ পাননি মোহাম্মদ। তার আগেই প্রাণ হারাতে হয়েছে তাকে। এই পরিবারের জন্য পবিত্র রমজান মাসের সমাপ্তি ঘটেছে একজন সন্তান, একজন স্বামী এবং একজন বাবার মৃত্যু সংবাদ দিয়ে। ঈদের দিন আমি সোবহির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তিনি ফেসবুকে সবাইকে জানিয়ে লিখেছেন, ‘আমরা আমাদের প্রিয় সন্তান মোহাম্মদ সোবহি বাহলুরের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। সে মানবতার পথে তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের মালিক এবং তার কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।’
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের অপরাধ মাটির নিচে চাপা দিয়ে আড়াল করতে চাইলেও তাদের অপরাধ ঢাকা থাকেনি। ৩০ মার্চ ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতি প্রকাশ করে জানিয়েছে যে, ইসরায়েলি বাহিনী বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। নিহতদের মধ্যে কয়েকজনের হাতে হাতকড়া পরানো ছিল। কারও কারও মাথায় ও শরীরে আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট দৃশ্যমান ছিল। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনবিষয়ক মানবিক সহায়তা কার্যালয়ের প্রধান জনাথান হুইটল বলেন, ‘চিকিৎসা ও উদ্ধারকর্মীদের আটক করে একজন একজন করে হত্যা করা হয়েছে।’
ইসরায়েল প্রতিবারের মতো এবারও এসব দাবি অস্বীকার করে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তারা একবার দাবি করে যে, যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা হামাস এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ সংগঠনের সদস্য; আবার দাবি করে যে, যে অ্যাম্বুলেন্সগুলোর ওপর গুলি চালানো হয় সেগুলো সন্দেহজনকভাবে ইসরায়েলিদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তাই গুলি চালানো হয়েছে।
অন্যদিকে ভণ্ডামির এক চরম প্রদর্শনীরূপে ইসরায়েলের সরকার ঘোষণা করেছে যে, প্রাণনাশক ভূমিকম্পের পর তারা থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে ২২ সদস্যের একটি উদ্ধারকারী দল পাঠাচ্ছে। উত্তর মেসিডোনিয়াতে এর দশ দিন আগে তারা একটি মেডিকেল প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল। ইউরোপ হোক কিংবা এশিয়া, ইসরায়েলের কপট মানবতাবাদ সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। যে রাষ্ট্র অবৈধভাবে দখলকৃত ভূখণ্ডে এক হাজারেরও বেশি চিকিৎসাকর্মী ও উদ্ধারকারীদের হত্যা করেছে, সে আবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ত্রাণকর্তা সেজে মানবিকতার মুখোশ ধারণ করছে।
যুদ্ধরত অঞ্চলে চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার ব্যাপারে জেনেভা কনভেনশনের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু গাজার ভূখণ্ডে যেন এই আন্তর্জাতিক আইনের কোনো মূল্যই নেই। মানবাধিকারের রক্ষক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ক্রমাগত নিন্দা জানিয়ে যাচ্ছে। তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করতে পারছে না। পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের কোনো কোনো সরকার নীরব প্রত্যক্ষদর্শীর ভূমিকা পালন করছে। আবার কোনো কোনো সরকার ইসরায়েলকে সমর্থন এবং অস্ত্রের জোগান দিয়ে গণহত্যার সরাসরি অংশীদার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও পশ্চিমা বিশ্বের কিছু সরকার তাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
আর কতদিন বিশ্ব এ গণহত্যায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাবে? এ বর্বরতা আর অপরাধ যেন শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। এই স্বাস্থ্যকর্মীদের হত্যার ঘটনা যুদ্ধের এক নতুন মোড় নেওয়ার কথা ছিল। এটা হতে পারত বিশ্ববিবেকের জন্য এক চূড়ান্ত সতর্কবার্তা। কিন্তু তা হলো না। এ ঘটনা জাতিবিদ্বেষী জায়োনিস্টদের দায়মুক্তি এবং তাদের শাসনের প্রতি স্বীকৃতির নিদর্শন হয়ে রয়ে গেল।
লেখক: কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং তৃতীয় প্রজন্মের ফিলিস্তিনি শরণার্থী। নিবন্ধটি আলজাজিরার মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ
মন্তব্য করুন