কাজী বনফুল
প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৫ মে ২০২৫, ০৩:৩৫ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

যুদ্ধ-উত্তপ্ত পৃথিবী শীতল হোক

যুদ্ধ-উত্তপ্ত পৃথিবী শীতল হোক

সমগ্র পৃথিবী যেন এক উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। পৃথিবীর সব মানুষ যেন সেই আগ্নেয়গিরির ওপর কড়াইয়ে ভাজা মাছের মতো ছটফট। আমরা যাদের সুখী দেশ হিসেবে চিনি সেই সুখী দেশগুলোও আগ্নেয়গিরির এই ভবিষ্যৎ বিস্ফোরণের আতঙ্কে আঁতকে উঠছে। পৃথিবীজুড়ে এক ভবিতব্য ভীষণ যুদ্ধের আশঙ্কায় সবাই ভয়ার্ত হরিণের মতো ছটফট করছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া যুদ্ধ বারুদের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে। সেই যে দৃশ্যমান মনুষ্য সৃষ্ট অগ্ন্যুৎপাতের শুরু, যা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। পৃথিবী আজ ভালো নেই। পৃথিবীজুড়ে এক নিভৃত কান্নার শব্দ বেজে চলছে অবিরাম। সে কান্নার শব্দ এতই মৃদু; যা এত বারুদ, বন্দুক, বোমার শব্দকে ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে কর্তৃপক্ষকে সজাগ করতে পারছে না। সেই মৃদু করুণ আর্তনাদে ভরা পৃথিবীর কান্না মিলিয়ে গেছে দূর নক্ষত্রের দেশে। কর্তৃপক্ষের কর্ণমূলে সে কান্নার শব্দ আজও পৌঁছাতে পারেনি।

বৃহৎ পরমাণু শক্তিধর দেশসমূহ নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে সর্বদা চোখে চোখ রাখছে অন্য কোনো শক্তিধর দেশগুলোর চক্ষুবিন্দুতে। শক্তির প্রদর্শন চলল সর্বত্র। দেশ, দেশবন্ধত্ব হচ্ছে, শক্তিধর দেশগুলো পক্ষ-বিপক্ষে ভাগ হয়ে গঠন করছে জোট। বেছে বেছে ক্ষমতার সঙ্গে ক্ষমতার মিলন হচ্ছে, পারমাণবিক বোমার সঙ্গে অন্য দেশের পারমাণবিক বোমা যোগ হয়ে বোমার সংখ্যা বৃদ্ধি করছে, অস্ত্রের সঙ্গে অস্ত্র মিলেমিশে গলাগলি ধরে এক হচ্ছে, সব হচ্ছে শুধু শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে না। সেই চেষ্টার পথে কেউ হাঁটছেও না। সবাই শুধু শক্তি বাড়ানোর মিছিলে যোগ দিয়ে অস্ত্রশক্তি বৃদ্ধির মহড়া দিচ্ছে। মানবতা নামক যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এ পৃথিবীতে রয়েছে, সেই শব্দটি অপমানিত হয়ে মাটির নিচে মুখ লুকিয়েছে। চারপাশে আজ মানুষে মানুষে সংঘর্ষের বীজ বপন করছে। একজন আরেকজনের রক্ত কেড়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

নগর পুড়িলে দেবালয় এড়িয়েছে কবে? এ যে পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের তৈল প্রস্তুত করা হচ্ছে মানুষের জীবন ভাজার জন্য। সেই গরম উত্তপ্ত কড়াইয়ের তেলে যদি ভাজা হয় মানুষ তাহলে অভিজাত, ক্ষমতাধর অনেকে না চাইলেও ছিটকে পড়বে ওই উত্তপ্ত কড়াইয়ে। যুদ্ধের ওই ঐতিহাসিক কড়াই কিন্তু কাউকে দেখেশুনে ভাজবে না, এই তেলের মধ্যে পড়লে কিন্তু সবাই মাছ ভাজার মতো সমানতালে ভাজি হবে। চড়চড় করে সেই যুদ্ধের উত্তপ্ত কড়াইয়ে পুড়বে সবার দেহ।

হিটলার পৃথিবীর সবটুকুকে নিজের মনে করত। সেখানে যে আরও অনেক মানুষ, প্রাণীরা বাস করে এটা তিনি অদৈবিকভাবে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। যুদ্ধে শুধু যে মানুষই মারা যায় এমনটি নয়, যুদ্ধে অনেক প্রাণীও প্রাণ হারায়। আমি এটা প্রাণ হারানো বলব না, এটাকে মানুষের শয়তানরূপে বিবর্তনে ফলে অকারণে প্রাণ কেড়ে নেওয়া বলব। হিটলার কিন্তু পারেননি। তিনি যে ইচ্ছে নিয়ে যুদ্ধের শুরু করেছিলেন তার পরিসমাপ্তি যথার্থভাবে মঞ্চায়িত করতে পারেননি। পরিশেষে হিটলারও কিন্তু বন্দুকের নল থেকে রেহাই পাননি। নিজের অঙ্গুলিই তার নিজের মস্তিষ্কে ঝাঁজরা করে দিয়েছিল। অবশেষে কোনো এক্সিট পথ না পেয়ে নিজেই নিজের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ছিল। কই হিটলার তো পারেননি, কেউ পারেননি। সবাই পুড়েছে সবাই পুড়বে। পোড়াতে গেলে পুড়তে হয়, একটু আগে অথবা পড়ে।

এ পৃথিবী শুধু ক্ষমতাবান ও শক্তিশালী মানুষের একার নয়। এই পৃথিবী শান্ত, নরম, যুদ্ধবিরোধী, আফ্রিকার কঙ্কালসার অসহায় হতদরিদ্র মানুষ, মরুভূমির বুকে উটের পিঠে করে বয়ে চলা কোনো আরব্য বণিক, সমুদ্রের মাঝখানে জাল ফেলে বসে থাকা সহস্র জেলে সম্প্রদায়, পদ্মার বুকে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে বয়ে চলা বেদে নৌকার দল, এই পৃথিবীর এদের সবার। এই পৃথিবী শুধু মানুষের পৃথিবী নয়, এই পৃথিবী পিপীলিকা থেকে শুরু করে হাতি, বানর, ঘোড়া, পাখিসহ সতেরো লাখ প্রজাতি প্রাণীর। মানুষ চাইলেই যা ইচ্ছে তাই করতে পারে না। এতে সমগ্র বাস্তুসংস্থানের ওপর এই বিরাট বিপর্যয় নেমে আসে, যা মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। এই পৃথিবী শুধু স্বার্থপর যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক পক্ষের একার নয়; এই পৃথিবী যুদ্ধবিরোধী, প্রেমিক যুগল, কবি, লেখক, গীতিকার, সুরকার, সাধু-সন্ত, সাধারণ মানুষের সবার। কেউ চাইলেই যুদ্ধ বাধিয়ে ভয়ংকর বিপর্যয় ঘটিয়ে ধ্বংস করবে শান্তির বীজ, সেটা অবশ্যই অযাচিত, অশোভন, অনাকাঙ্ক্ষিত।

ধ্বংসের বীভৎস ছায়া চারপাশে আছড়ে পড়ছে, ভবিষ্যৎ মৃত্যুর ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে। এই ঘ্রাণ কি ওইসব লোকের নাকে দিয়ে লাগে না যারা ক্ষমতার অগ্রে উপবেশন করে আছেন তারা কি টের পাচ্ছেন না ভবিষ্যৎ ওই মৃত্যু-উপত্যকার স্তম্ভ দেখে। তাদের বিবেক কি শিহরিত হচ্ছে না ওই ভবিষ্যৎ কান্নার বিস্ফোরিত শব্দের আঘাতে।

যুদ্ধ পৃথিবীর জন্য একটি অসুস্থতার মতো বা কালাজ্বরের মতো যেটা পৃথিবী কখনোই চায় না। পৃথিবীর প্রায় নব্বইভাগ মানুষই চায় না যে যুদ্ধ আসুক, যুদ্ধ হোক। কিন্তু তারপরও কেন যুদ্ধ হয়; লাখ লাখ নিরীহ মানুষের প্রাণ ঝরে। পৃথিবী তার সব সৃষ্টি, সব সন্তানকেই সমানভাবে ভালোবাসে। একজনের লোভ, ক্রোধের বলি অন্যরা হোক, এটা পৃথিবী কখনোই চায় না। সে তার সব সন্তানকে নিয়ে এক প্রেমময় সম্পর্কে বেঁচে থাকতে চায়, বাঁচিয়ে রাখতে চায়। যুদ্ধের বিধ্বংসী খেলার ছলে মানুষসহ কোটি কোটি জীবকুলের এমন অনিবার্য মৃত্যু কখনোই সে চায় না, এতে তার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তবুও লোভ, ক্ষমতার অতিরিক্ত প্রদর্শন, মানবিক বোধহীনতায় যুদ্ধে জড়ায় দেশ ও মানুষ; যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

তাই বিশ্বের স্তম্ভ বিবেকবান মানুষ যারা আছেন তাদের অবশ্যই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া এই যুদ্ধের তেজকে, মাতৃত্বের, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের ছোঁয়ায় নিবিড় পরিচর্যায় প্রশমিত করতে হবে। শান্তি ও ঐক্যের মাধুর্য নির্মাণে সবাইকে সমানভাবে কাজ করতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাজধানীতে মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধের পরিধি বাড়ল

চট্টগ্রামে প্রাইম মুভার শ্রমিকদের পরিবহন ঘর্মঘট

পুলিশ হেফাজত থেকে পালানো ছাত্রলীগ কর্মী রবিন গ্রেপ্তার

উত্তেজনার মধ্যে ভারত-পাকিস্তানের বিরল পদক্ষেপ

গ্রি এসির নতুন ৪টি সিরিজের মোড়ক উন্মোচন

ওসি সেজে সালিশ যুবদল নেতার, ভিডিও ভাইরাল

এবার মধ্যপ্রাচ্যে শাকিবের ‘বরবাদ’

দিনে দেড় হাজার টাকার খাবার খায় ডন

বুক প্রাইসিং সংস্কারের পর ইন্টারনেটের দাম না কমালে চুক্তি পুনঃবিবেচনা

দুই উপদেষ্টার সাবেক এপিএস ও পিওসহ তিনজনকে দুদকে তলব 

১০

ফারাক্কা বাঁধ এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে : মির্জা ফখরুল

১১

রওশন এরশাদের পৈতৃক বাড়িতে ভাঙচুর

১২

কুলাউড়া সীমান্তে পুশইন করা ১৪ জনের পরিচয় মিলেছে

১৩

কয়েক মাসে দেড় লাখ শ্রমিক নেবে মালয়েশিয়া : আসিফ নজরুল

১৪

সৌদিতে পাকিস্তানিদের ভিক্ষাবৃত্তি, গণহারে দেশে ফেরত

১৫

জগন্নাথের আন্দোলনের দুর্গ যেন কাকরাইল মসজিদ

১৬

রাঙামাটিতে ট্রাক্টর উল্টে প্রাণ গেল তিন শ্রমিকের

১৭

স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সাবেক পিও ফারাবির বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

১৮

গাইবান্ধায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ৩ জনের মৃত্যু

১৯

দেশে ফিরল ভারতে আটক ১১ বাংলাদেশি

২০
X