অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২৩, ০২:২৯ এএম
আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০২৩, ১১:৫৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচন আসন্ন: মনোনয়নে কৌশলী ভূমিকা সময়ের দাবি

নির্বাচন আসন্ন: মনোনয়নে কৌশলী ভূমিকা সময়ের দাবি

নির্বাচন আসন্ন, ক্ষমতাসীন দলে প্রার্থীর ছড়াছড়ি। বিদ্যমান মন্ত্রী, এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচিত-অনির্বাচিত নেতারা প্রার্থী হতে চাচ্ছেন। প্রত্যেকে স্বীয় অবস্থান সুদৃঢ় করে প্রভাব বলয় বিস্তারে নিষ্ঠাবান। তাই ভাই, বোন, পুত্র, কন্যা, বেয়াই, জামাই, চাচাতো, জ্যাঠাতো ভাইবোন বা তাদের আত্মীয় বা অন্য আত্মীয়দের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন। আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রগুলোও কৌশলে তাদের দিয়েছেন।

শেখ হাসিনার বর্জন তালিকায় ২৬২ জন এমপির মধ্যে অন্তত এমন ৫৯ জন মতভেদে ১০০ জন এমপি এলাকায় জনপ্রিয়তাহীন। কিন্তু তারা নিজেদের এমনভাবে গুছিয়ে নিয়েছেন, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ছাড়া অত্র এলাকায় অন্য কেউ আর নেই। এমন কোনো অনুষ্ঠান নেই যেখানে তিনি প্রধান অতিথি নন। তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে আমন্ত্রণ মানে প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টির প্রয়াস এবং সর্বাংশে দমনযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত। অতীতে দলের প্রতি ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিবেদিত ছিল এমন কাউকেও তারা সহ্য করেন না, কল্পিত প্রতিপক্ষকে কাটছাঁট করার সব ফন্দিফিকির মন্ত্রতন্ত্র তারা আয়ত্ত করেছেন। নেতাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় এমপি সাহেব প্রথমে তার দলের নিবেদিতদের সঙ্গেই কথা বলা বন্ধ করে দেন। তারপর তাদের চরিত্র হননে লিপ্ত হন। পরবর্তী পদক্ষেপ হলো, সামাজিকভাবে কল্পিত প্রতিপক্ষকে একঘরে করা, বাড়িতে ঢিল মারা, বিষয় সম্পত্তিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ করা, দৈহিকভাবে নির্যাতন করা এবং পরিশেষে তাদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক মামলা দিয়ে হয়রানি করা ও এলাকা ছাড়ার ব্যবস্থা করা হত্যার মতো জঘন্য কাজটিরও আশ্রয় নেওয়া হয়েছে কিছু জায়গায়। এ ঘটনা অন্য দলে নেই তাও হলফ করে বলা যাবে না।

এখানে শেষ হলে কথা ছিল না। তার এলাকার গাছের পাতাও তার সম্মতি ছাড়া নড়ে না। তার সম্মতি ছাড়া মূল সংগঠনসহ অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতা কেউ হতে পারেন না বা টিকতে পারেন না। কেউ ব্যতিক্রমী ভূমিকা মানে তার কপাল পুড়ল। প্রশাসনের ওপর তার প্রভাব রয়েছে বিধায় তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল সর্বত্র প্রতীয়মান। এলাকায় ছোট-বড় নির্বিশেষে এমপি সাহেবকে স্যার সম্মোধন করতে বাধ্য। বয়োজ্যেষ্ঠ এবং অনেকেই বঙ্গবন্ধুর কাল থেকে ত্যাগ-তিতিক্ষার ভাস্বর হলেও আজকাল চুপসে গেছেন। বিরোধীরা এ সুযোগটি নিচ্ছে এবং পরবর্তী নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটবে বলে অনেকে মনে করেন।

আরেকটি বেদনা বা বিষাদ সৃষ্টিকারী উপাদান হলো টেলিফোন। আমি জানি না কতজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি মন্ত্রী, এমপিদের টেলিফোন নম্বর জোগাড় করতে পেরেছেন। সুবিধা আদায়ের জন্য নয়, কোনো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে তাকে আমন্ত্রণের জন্যও টেলিফোনে পাওয়া যায় না। তাদের পিএস বা সহকারীরা তাদের প্রভু ছাড়া দলের অন্যদের মানুষই মনে করে না, কিন্তু পয়সাওয়ালা বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে তাদের দহরম-মহরম। ওদের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেলে মনে হয় তারা হাতে চাঁদ পেয়েছেন। এমপি সাহেব তাদের বুকে নিয়েছেন আর তারা এ সুযোগে পূর্বে অর্জিত সম্পদ স্থায়ী করে নিচ্ছেন কিংবা নতুন করে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন। মুক্তহাতে তার সম্পদ ব্যবস্থার পারঙ্গমতা দেখিয়ে বিরোধীদের অর্থায়নে তাকিয়ে আছে। ব্যতিক্রম আছে কেউ কেউ একদিন হলেও টেলিফোন ধরেন। তারপর তাদের টেলিফোন থেকে অনবরত জবাব আসে, ‘টেলিফোনটি এখন ব্যস্ত’। আজকালকার মানুষ তত বোকা নয় যে, তারা টেলিফোন ব্যস্ত রাখার কৌশলটি অবগত নয়।

এরই মধ্যে দলের নেত্রী যেসব এমপির ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থান নিয়েছেন, তাদের ব্যাপারে সাধারণ ভোটারের মতামত পাওয়া দুষ্কর। কেননা তারা দাপটে কোন কোন এলাকায় মূর্তিমান ত্রাস ও মুখ বন্ধ রাখতে আপাতত সফল। তাই গোয়েন্দা সংস্থার মতামতই বড় ভরসা। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও হয়তো নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। কারণ তাদের মাঠপর্যায়ের কর্মী বা কর্মকর্তারা পক্ষপাতমূলক তথ্য নিয়ে আসতে পারেন। অর্থবিত্ত-প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে পরাভূত হতে পারেন। তজ্জন্য চেক বা ব্যালান্সের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। বিপদ চলে যায়নি, ঘনায়মান। যারা নমিনেশন বঞ্চিত হবেন তারা কিংবা তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা বসে থাকবেন? নিজে হয়তো সহযোগিতার ভান দেখাবেন। সাঙ্গোপাঙ্গদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক, অর্থ, প্রভাব-প্রতিপত্তির সম্পর্ক অতএব প্রতিরোধটা কেমন হবে চিন্তনীয়। এখানে একটাই স্বস্তির ব্যাপার যে, পরিবার বা বলয়ের মধ্যে দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান সংঘাত অত্যাসন্ন। স্ত্রী, ভাই, শ্যালক, ভাতিজা, ভগ্নি, ভগ্নিপতি, বেয়াই, মেয়ে, স্বামী, নাতি, ছেলের বউ, নিদেনপক্ষে ডামি ক্যান্ডিডেট এবং হাইব্রিডরা মনোনয়ন পেতে উদগ্রীব। তাদের দুটো হিসাব; এক, নেতার আসন থেকে নমিনেশন পাওয়া; না হলে নেতার হাত শক্তিশালী করা।

আবার বলছি, বাদ পড়ে যেতে পারেন এমপিরা; কিন্তু অতিমাত্রায় প্রভাবশালী, তাদের বিত্তবৈভব অফুরন্ত। আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে তার প্রতিটি সহযোগী সংগঠন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে কোনো সংগঠন, জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন কমিটিতে তার নিকটাত্মীয় কিংবা দূরের আত্মীয় কিংবা লতাপাতা জাতীয় আত্মীয় এবং লুকায়িত জামায়াত-শিবির বিএনপি ধারার অতি অনুগত অনুসারী রয়েছে। এরাও বিভিন্নভাবে সম্পদশালী ও তাই প্রভাবশালী আত্মীয় বা হাইব্রিডদের তারা কেউ ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা এমনকি জাতীয় পর্যায়ে বসিয়েছেন। ইউনিয়ন সদস্য ও চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান ও সদস্যবর্গ, জেলা প্রশাসক পদ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, তাঁতী লীগ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদসহ সর্বস্তরের তাদের পছন্দের প্রেসিডেন্ট বা চেয়ারম্যান পদে অভিষিক্ত করে নিজের অবস্থান সংহত করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। গোয়েন্দা সংস্থার রাডারে তারা ধরা পড়েছেন যে, তারা এলাকায় সম্মানিত নন; তারা দাম্ভিক, অনুপস্থিত চাষি। তথ্য এসে গেছে নেত্রীর কাছে, তথ্য সংগ্রহ প্রয়াস চলমান রেখেছেন আর সে থেকে নির্মিত ডাটা ব্যাংক চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে সহায়ক হবে। তবে দলের শীর্ষ পর্যায়ে এসব এমপিরও সমর্থক রয়েছেন। এ অবস্থায় করণীয় হতে পারে :

এক. মনোনয়ন কাজে ত্বরিত হাত দিতে হবে, যথেষ্ট সময় হাতে রেখে নমিনেশন পর্বটা শেষ করতে হবে, তাতে সংঘাত ও ষড়যন্ত্রের মাত্রাটা কমিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। নমিনেশন বঞ্চিতদের গতিবিধি ও আচার-আচরণ মনিটরিং করা যাবে, নেতাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কে বা কারা কীভাবে পালন করছে তাও জানা যাবে। তাদের বলিষ্ঠ ও সম্পদশালী স্বজনরা বা রিক্রুটরা কীভাবে চলছেন তা জানা যাবে এবং ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পর্যাপ্ত সময় হাতে থাকবে।

দুই. দলের নিবেদিত, নির্যাতিত, অবহেলিতদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে মূল্যায়ন করতে হবে। তারা সবাই না হলেও অধিকাংশ বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার সৈনিক, নিবেদিত এবং দুঃসময়ের সহযাত্রী, এলাকায় সম্মানিত, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিমুক্ত, এ জাতীয় ব্যক্তিদের নমিনেশন দিলে আওয়ামী লীগের সব ভোটার কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে তাদের ভালোবাসার মানুষটিকে পাস করিয়ে আনবে; এমনকি অন্য সমর্থকদের তারাই হাত ধরে নিয়ে আসবে।

তিন. প্রতিস্তরে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রকৃত দুস্থ, দরিদ্র, অসহায়দের হাতে পণ্যসামগ্রী অর্থ পৌঁছিয়ে দিতে হবে। তাদের প্রাপ্যটা যেন অবাঞ্ছিতদের হাতে না যায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

চার. মনোনীত প্রার্থীরা নিজেদের চোখে ভোটারদের না দেখে, ভোটারদের চোখে নিজেকে দেখতে হবে এবং সে অনুযায়ী ভোটার সন্তুষ্টির সর্বাত্মক প্রয়াস নিতে হবে।

পাঁচ. সর্বত্র ত্যাগী-যোগীদের পাহারায় বসাতে হবে; যাতে তারা অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নেত্রীর কাছে পৌঁছাতে পারেন। আমলানির্ভরতা কমাতে হবে। সমাজে যারা মতামত প্রভাবান্বিতকারী, তাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করতে হবে।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও উপাচার্য ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাফাল ধ্বংসের বিষয়ে যা বলল ভারতের বিমানবাহিনী

চাঁদা না পেয়ে চায়ের দোকানে জবি ছাত্রদল নেতার তালা

ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে দুজনের মৃত্যু

আ.লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধে শরীয়তপুরে মিষ্টি বিতরণ

মৌসুমের শেষ এল ক্লাসিকো জিতে শিরোপার দোরগোড়ায় বার্সা

তালগাছ থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু

ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুটের হালচিত্র

‘সরকারে থাকা যেন এখন দু’ধারী তলোয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা’

বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মডেল হয়ে আছে : ধর্ম উপদেষ্টা

বিলম্ব হলেও সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমরা খুশি : নজরুল ইসলাম

১০

বিপ্লবী জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র প্রস্তাব করবে জুলাই ঐক্য

১১

বিক্ষোভে উত্তাল বরিশাল নার্সিং কলেজ

১২

ভুটানকে হারিয়ে সেমিফাইনালে বাংলাদেশ

১৩

শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে বালুচাপা

১৪

‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আ.লীগকে নিষিদ্ধ করলে ভালো হতো’

১৫

নিজেদের কত সৈন্য মারা গেল জানাল ভারতের সেনাবাহিনী

১৬

চাঁদা দাবি, ছাত্রদল-যুবদল নেতাসহ আটক ১০

১৭

রাত ১২টার মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে বজ্রবৃষ্টি

১৮

ক্ষমতার জন্য বিএনপি রাজনীতি করে না : আমিনুল হক

১৯

ফর্মে না থাকলেও লিটনের পাশে সালাউদ্দিন

২০
X