দেশের ক্রিকেটের সামান্যতম খোঁজখবর যারা রাখেন, তাদের মানতেই হবে গত ১৫ বছর ধরে, বিসিবি ছিল একজন মাত্র ব্যক্তির ছা্য়াতেই—তিনি হলেন নাজমুল হাসান পাপন। যিনি কি না ইসমাইল হায়দার মল্লিকসহ কয়েকজনকে দিয়ে এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন আর যেই সাম্রাজ্যে সমস্ত ভক্তি, শ্রদ্ধার নিবেদন ছিল শুধু তার চরণতলেই… মনে করে নিলাম, পাপন ছিলেন অস্পৃশ্যদের একজন স্বৈরাচার এবং পাশে থাকা তাঁবেদারদের কল্যাণে তার প্রভাবও ছিল একচেটিয়া। বোর্ডের কাঠামো, কার্যক্রম এবং নীতিমালা সবই তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য তার হয়ে যারা প্রকাশ্যে কাজ করেছিলেন, তাদের অনেকেই এখনো রয়ে গেছেন বহাল তবিয়তে। ক্ষমতায় থেকে যাওয়া পাপনের সেই উত্তরসূরিদের পল্টিবাজিতে অপসারিত হয়েছেন বোর্ড সভাপতি ফারুক আহমেদ। ফ্যাসিস্টদের পতনের পর দেশে হচ্ছেটা কী? এমন প্রশ্ন অনেকেরই। বাংলাদেশের একজন নতুন ক্রীড়া উপদেষ্টা দায়িত্বে আছেন এবং মন্ত্রণালয় দেশের ক্রীড়াঙ্গন পুনর্গঠনের জন্য কাজ করছে। তাই যদি হয় তবে ফ্যাসিস্টদের মতো এখনো কেন হস্তক্ষেপ, ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাতের আঁধারে তড়িঘড়ি করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া, কেনইবা রাজনৈতিক অপকৌশলের প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি। যারা এসব কাজে লিপ্ত, ক্ষমতার দাপটে তারা কি বুঝতে পারছেন না, এসব কাণ্ডে বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই ক্ষতি হচ্ছে, ধাবিত হচ্ছে বিলুপ্তির দিকে। ফারুক আহমেদের এই হঠাৎ চলে যাওয়ায় সৃষ্ট পরিস্থিতি যে মন্ত্রণালয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে; কঠিন এ সত্যটাই কিন্তু প্রকাশ করে। প্রথমত, আমরা এখনো সরকার-প্রভাবিত ক্রিকেট বোর্ডের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসিনি, যা আইসিসির আচরণবিধির গুরুতর লঙ্ঘন। অতীতে এমন কিছু সমস্যা সৃষ্টি করেনি বলে এবারও সেটি হবে মনে করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মোটেও সমীচীন হবে না বলে মনে করেছিল। আমি নিশ্চিত, আমরা সবাই জানি সরকারি হস্তক্ষেপে সম্প্রতি জিম্বাবুয়ে এবং শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের পরিণতি কী হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এনএসসির পরিচালক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার নজির নিশ্চিত করেই একটি অস্থির ও বৈষম্যমূলক পরিবেশ তৈরি করে এবং তৃতীয়ত, যদি সরকার নিজেই ফারুক আহমেদকে এনএসসি পরিচালক হিসেবে বেছে নেয়, তবে সেটি কি যাচাই-বাছাই ছাড়াই করা হয়েছিল। যদি করা হয়ে থাকে তবে এখন বলা যেতেই পারে সেটি নির্ভুল ছিল না। একই পদ্ধতিতে বেছে নেওয়া হয়েছে নবনিযুক্ত সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে। তার মতো সম্মানিত একজন ক্রিকেট ব্যক্তিত্বকেও যে ফারুক আহমেদের পরিণতি ভোগ করতে হবে না, সেটিরইবা গ্যারান্টি কী? ফারুক আহমেদের অপসারণে এনএসসির ব্যাখ্যায় কিন্তু বাকি পরিচালকদের ওপরও বর্তায়। এমন সিদ্ধান্তের জন্য যদি বিপিএলের অব্যবস্থাপনাই একমাত্র কারণ হয়, তাহলে কেন এর সঙ্গে জড়িত অন্যসব অংশীদারকে রেহাই দেওয়া হচ্ছে? পুরো দোষ তো আর বোর্ড সভাপতির একার নয়, কিছু তো অন্যদেরও নিতে বা দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের অন্য সদস্যরা কি আইনের ঊর্ধ্বে? সবার ভূমিকা খতিয়ে দেখলে স্পষ্ট হবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে তা কতসব জঘন্য কাজ করেছেন। আমার জানামতে, বিসিবি সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত কমিটিতে আইনজীবী এবং ক্রিকেটের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এমন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার কিছু গুরুতর দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলেও জানা গেছে। যদিও শেষ পর্ষন্ত পুরো উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়েছিল। যখন একটি মন্ত্রণালয় সীমিত জ্ঞান এবং প্রশ্নবিদ্ধ সততা সম্পন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন তো এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপেক্ষিত হবেই—এসব করে যে বিশ্বমঞ্চে দেশের সুনাম এবং পারফরম্যান্সকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে, সেটিও তারা বুঝতে পারেন না। বিসিবির কাছে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্বল কাঠামো এবং শৃঙ্খলা থেকে শুরু করে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ, পক্ষপাতদুষ্ট আম্পায়ারিং এবং টেকসই প্রতিভা পাইপলাইন তৈরিতে দীর্ঘস্থায়ী ব্যর্থতা—সমস্যাগুলো বিসিবি নামের সঙ্গে গভীরভাবে গেঁথে আছে। শুধু এ কারণেই একটি মানসম্পন্ন বিপিএল আয়োজনে ব্যর্থতা জ্বলন্ত সমস্যায় রূপ নিয়েছে। অতীতের বিপিএল যদিও সফলই হয়, তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট এখনো কেন এ ফরম্যাটের ক্রিকেটে ভুগছে? এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তোষামোদ সংস্কৃতির পাশাপাশি অযোগ্যদের দায়িত্ব থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে অভিজ্ঞদের নিয়ে একটি কার্যকর দল বানানো। নোংরা মন এবং বিষাক্ত মানসিকতার মানুষগুলোকে অপসারণ না করলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে না বলেই আমি মনে করি। ক্রিকেট বাংলাদেশের লাখো কোটি মানুষের প্রাণভোমরা। এখন বাংলাদেশে ক্রিকেট কেবল একটি খেলা নয়, এটি একটি শিল্প। এটি লাখো কোটি মানুষের আবেগের ভিত্তি। মাফিয়া সংস্কৃতিকে আশ্রয় দিলে সেটি দেশের ক্রিকেটকে ধ্বংস করে দেবে। আমার শ্রদ্ধা ও শুভকামনা আমিনুল ইসলাম বুলবুলের প্রতি—যিনি সবে বোর্ড সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমার উদ্বেগ এখনো রয়ে গেছে। যে দেশে রাতারাতি নায়ক বানানো হয় এবং পরদিন সকালে খলনায়ক বানানো হয়, সেখানে যারা ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে আগুনে পা রাখেন, তাদের জন্য আমি ভীত। আমি আশা করি বুলবুল যেন ধ্বংসাত্মক চক্রের আরেকটি পুতুল না হয়ে যান। মাঠের ক্রিকেট, যা আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত, তা নতুন নিম্নস্তরে পৌঁছাতে থাকে। এটি জাতীয় হতাশার উৎস হয়ে উঠছে। যদি এমন একটি বিপ্লবও বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ঠিক করতে না পারে, তাহলে কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারে— হবেটা কীভাবে? বাংলাদেশের ক্রিকেট কি চিরকাল খারাপ, কুৎসিত এবং নোংরা থেকে যাবে?
লেখক : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ক্রিকেট বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন