আরব-ইসরায়েলি দ্বন্দ্ব বিশ্বের সবচেয়ে জটিল ও গুরুতর রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর একটি। বিশেষ করে ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি দ্বন্দ্ব। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই দ্বন্দ্ব চলে আসছে এবং এখন পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের কোনো প্রকৃত সুরাহা হয়নি। ইসরায়েলের বিরোধীরা ইসরায়েলকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের ক্যান্সার’ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। আরব রাষ্ট্রগুলো সম্মিলিতভাবে জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে ইসরায়েলের তুলনায় অনেক শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও এই ‘ক্যান্সার’কে অপসারণ করতে পারছে না। এর প্রধান কারণ মূলত দুটি। প্রথমটি আরব দেশগুলোর মধ্যে অনৈক্য। আর দ্বিতীয়টি হলো ইসরায়েলের পাশে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি।
শুক্রবার ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রাণকেন্দ্র ও দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর ওপর হামলা চালায় ইসরায়েল। এ ঘটনার পরই ইরান পাল্টা জবাব হিসেবে শনিবার ভোরে হামলা চালিয়েছে।
ইসরায়েল এসব হামলায় যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে। পাশাপাশি আগে থেকে ইরানে চোরাপথে প্রবেশ করানো ড্রোনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। এসব হামলায় ইরানের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হন। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের দূত বলেছেন, এসব হামলায় মোট ৭৮ জন নিহত এবং ৩২০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের দাবি, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির আরও কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই এই ব্যাপক হামলা চালানো জরুরি ছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হামলার আগে তেহরান এমন কোনো অস্ত্র তৈরির চেষ্টায় সক্রিয় ছিল না। ইরান পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রথমে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। এরপর ইসরায়েলের দিকে একের পর এক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। এই হামলা চলাকালে জেরুজালেম ও তেল আবিবের আকাশ অন্ধকারের মধ্যেও বিস্ফোরণের আলোয় ঝলমল করে ওঠে এবং নিচের ভবনগুলো কেঁপে ওঠে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সংঘাতে টেনে আনতে চায় ইসরায়েল। যাতে ত্রিদেশীয় যুদ্ধের চাপ মধ্যপ্রাচ্য সইতে না পারে। স্বভাবতই বিশ্ব পরাশক্তির আঘাত সামলানো ইরানের পক্ষে সহজ হবে না। সে সুযোগটিই নিতে চান বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে ইরানে শাসন পরিবর্তনের লক্ষ্য তার।
ইসরায়েল ও ইরান উভয়ই দীর্ঘ সময় ধরে এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে থাকার জন্য প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে। ফলে পাল্টাপাল্টি আরও হামলার আশঙ্কা রয়েছে। এ মুহূর্তে ইরান কেবল ইসরায়েলের হামলার জবাবে ইটের বদলে পাটকেল (প্রতিশোধমূলক) প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তবে এটা খুবই স্পষ্ট যে, ইরান তার সামরিক কমান্ডার, বিজ্ঞানী, সামরিক স্থাপনা এবং পারমাণবিক সুবিধাগুলোকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলের হামলা সহ্য করবে না। এটি পুরো অঞ্চলের জন্য খুবই বিপজ্জনক মোড়। কারণ, অনেক পর্যবেক্ষক উল্লেখ করেছেন—এ পরিস্থিতি পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার এবং যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িয়ে ফেলার প্রতিটি সম্ভাবনা সক্রিয়।
ইসরায়েলের আগ্রাসী আচরণের প্রভাব যে শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই পড়েছে, তা নয়। সারা বিশ্বেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে এখনই যদি এই যুদ্ধ বন্ধ না করা যায়, অর্থাৎ এই যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়ে তবে বিশ্ব যে আরেকটি অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে, তা অনুমান করা কঠিন নয়।
আমাদের প্রত্যাশা, বৈশ্বিক সংকটময় পরিস্থিতি এড়াতে ইসরায়েলের মিত্র হিসেবে পরিচিত পশ্চিমা শক্তিগুলো এই যুদ্ধ বন্ধে তৎপর হবে। ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের উত্তেজনা নিরসনে তো বটেই, ফিলিস্তিন ইস্যুতেও পশ্চিমা শক্তি ইতিবাচক ভূমিকার রাখবে। তবেই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
মন্তব্য করুন