বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন মৌসুমি সংকট নয়, এটি এক ভয়াবহ বার্ষিক জনস্বাস্থ্য দুর্যোগ। করোনা মহামারির মাঝামাঝি সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে বাড়ছে ডেঙ্গুমৃত্যু। বাংলাদেশে ২০২০ সালে ৩, ২০২১ সালে ১০৫ এবং ২০২২ সালে ২৮১ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ১ হাজার ৭০০ জন, যা শুধু দেশের ইতিহাসেই সর্বোচ্চ নয়; ওই বছর কোনো একক রাষ্ট্রে বিশ্বে সর্বোচ্চ মৃত্যু। ২০২৪ সালে মোট মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমলেও (৫৭৫ জন), গত তিন বছরের মতো দেশে একই ধরনের শতকরা মৃত্যুহার পরিলক্ষিত হয়েছে। অথচ মৃত্যুর এ মিছিল এখনো ডেঙ্গু নিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যনীতি ও প্রস্তুতিকে বদলাতে পারেনি।
গত বছর স্বাস্থ্য গবেষণা নিয়ে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক জার্নালে (Khan et al., 2024, IJID Regions) আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার ডেঙ্গুপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শতকরা ডেঙ্গু মৃত্যুহার কয়েক বছর ধরে উচ্চতম, যা এখনো বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাজিলে বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হলেও তাদের মৃত্যুহার বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ কম। পার্শ্ববর্তী ভারত ও শ্রীলঙ্কার চিত্রও একই। কাজেই ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলেও সময়মতো কার্যকরী চিকিৎসা ও সুশৃঙ্খল প্রস্তুতি থাকলে মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশে কেন এত মৃত্যু?
মোটা দাগে বিশ্লেষকরা ডেঙ্গুমৃত্যুর কারণ তিনটি বড় স্তর ব্যাখ্যা করে থাকেন—
১. পরিবেশগত ও জলবায়ুগত ঝুঁকি: অনিয়মিত বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা ও বাড়তি আর্দ্রতা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণে এডিস মশার বিস্তার বাড়ছে।
২. ভাইরাসের বিবর্তন ও দ্বিতীয়বার সংক্রমণ: ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরন বিশেষ করে DENV-2 ও DENV-3 এখন আগের চেয়ে বেশি প্রাণঘাতী।
৩. প্রস্তুতির অভাব ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা: হাসপাতালে চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় শয্যার সংকট; স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগে সমন্বয়ের অভাব।
বায়ুদূষণ: অদৃশ্য অথচ শক্তিশালী ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর
বাংলাদেশ বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের তালিকার শীর্ষে, যা দেশের ডেঙ্গু সমস্যায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আমাদের চলমান গবেষণায় দেখতে পেয়েছি, উচ্চমাত্রার PM2.5 (পার্টিকুলেট ম্যাটার যা বায়ুদূষণের অন্যতম ক্ষুদ্র উপাদান) ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ানোর সঙ্গে সংযুক্ত। অথচ বায়ুদূষণকে ডেঙ্গুজনিত জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে আমরা এখনো বিবেচনায় আনিনি।
বারবার একই ভুল: রাষ্ট্রের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই
বর্ষা, জলাবদ্ধতা ও আবর্জনার মধ্যে এডিস মশা এখন শুধু শহরে নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। এর দায় শুধু প্রকৃতির নয়, দায় প্রশাসনের অপ্রস্তুতিতেও। ডেঙ্গু সেকেন্ডারি ইনফেকশন (দ্বিতীয়/তৃতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়া) সাধারণ তো রোগের তীব্রতা বাড়ায় এবং এর জন্য বাড়তি সতর্কতাসহ চিকিসৎসা ব্যবস্থা প্রয়োজন হয়। তাহলে সংগতকারণেই প্রশ্ন আসে যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কি দ্বিতীয়/তৃতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়া রোগী বেশি ছিল? কিংবা ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরনে কোনো জিনগত পরিবর্তন ঘটেছে? কিন্তু এগুলো পরীক্ষার কোনো সরকারি উদ্যোগ কিংবা গাইডলাইন দেশে নেই। গত বছর দেশের কোন অঞ্চলে কোন ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং এ বছর কোন ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে, তার কোনো কার্যকরী তথ্য ডেঙ্গু মৌসুমের শুরুতেই সরবরাহ করার সরকারি উদ্যোগের মারাত্মক ঘটতি দেখা যায়। তা ছাড়া প্রতি বছর দেশে ডেঙ্গু ভাইরাসের জিনগত কী পরিবর্তন হচ্ছে, তা শনাক্তে দেশে নেই কোনো জাতীয় জিনোমিক নজরদারি। দেশের ছোট ছোট গবেষণা গ্রুপ এ ধরনের কিছু কাজ করলেও সরকারি উদ্যোগ বছরের পর বছর উপেক্ষিত কিংবা অপ্রতুল। এমনই এক বাস্তবতায় ঢাকাবাসী প্রতি বছর বর্ষায় শুধু একটি পরিচিত দৃশ্য দেখেন—নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় মশার ওষুধ ছিটানো ও কিছু সচেতনতামূলক ব্যানার। এ সামান্য প্রস্তুতি দিয়ে চলমান ডেঙ্গুর ভয়াবহতা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এ বছর ডেঙ্গু মৌসুম শুরুর আগেই ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে আবারও দেখা যাচ্ছে শয্যা সংকট, প্লাটিলেট সংকট, স্যালাইনের ঘাটতি, চিকিৎসক/নার্স সংকট; যা ঠিক আগের বছরগুলোর মতোই। উপরন্তু, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখনো বিগত বছরগুলোতে ডেঙ্গুতে মৃতদের বয়স, এলাকা, সংক্রমণের ধরন এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করে তথ্যভিত্তিক কোনো বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে পারছে না। এ অবস্থায় রাষ্ট্র শুধু অপারগতাই প্রকাশ করছে না, কার্যত নির্লিপ্ত থাকছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
১. জাতীয় ডেঙ্গু প্রস্তুতি পরিকল্পনা (NDPP) প্রণয়ন
—জেলাভিত্তিক ঝুঁকি নিরূপণ করা এবং সেই হিসেবে পরিকল্পনা গ্রহণ করা; বর্ষা মৌসুমের জন্য তিন-চার মাসের বাড়তি প্রস্তুতি প্রণয়ন করা; জেলাভিত্তিক বাজেট নির্ধারণ, দায়িত্ব ভাগ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
২. ভাইরাস ও রোগীর জিনোমিক নজরদারি চালু
—ডেঙ্গুর প্রকৃত বিস্তারের মাত্রা নির্ধারণে দেশজুড়ে নমুনা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ বাড়াতে দ্রুত পর্যাপ্তসংখ্যক শনাক্তকরণ কিট সংগ্রহ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সহজলভ্য করতে হবে।
—RT-PCR ও জেনোম সিকোয়েন্সিং করে জেলাভিত্তিক ডেঙ্গু ভাইরাস ধরন চিহ্নিত করতে হবে।
—ডেঙ্গু ভাইরাসের টাইপ এবং প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি ইনফেকশনের ভিত্তিতে চিকিৎসা নির্দেশিকা তৈরি করতে হবে।
৩. জেলা-উপজেলা হাসপাতাল প্রস্তুত করা
—স্যালাইন, প্লাটিলেট ও ট্রান্সফিউশন ইউনিট সুবিধা বাড়ানো।
—চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ, HDU/ICU সুবিধা বাড়ানো।
৪. স্থানীয় সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনা
—ওয়ার্ডভিত্তিক ডেঙ্গু প্রজনন হটস্পট ম্যাপিং করা।
—নিয়মিত ড্রেনেজ পরিষ্কার, নির্মাণকাজ মনিটরিং করা।
—জরিমানা ও অ্যাকশনভিত্তিক মনিটরিং জোরদার করা।
৫. জনসচেতনতা ও প্রযুক্তিনির্ভর হস্তক্ষেপ
—মোবাইল সতর্কবার্তা, স্কুল-মসজিদ-মন্দির-উপাসনালয়-কমিউনিটির মাধ্যমে প্রচার করা; লার্ভা শনাক্তে ছবিভিত্তিক অ্যাপ ব্যবহার করা; মাল্টিমিডিয়া প্রচারণা করা।
৬. আবহাওয়াভিত্তিক আগাম সতর্কতা
—আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ডেঙ্গু মৌসুমের পূর্বাভাস নির্ধারণ করা; নির্ধারিত মান ছাড়ালে এলাকা চিহ্নিত করে প্রস্তুতি বাড়ানো।
৭. বায়ুদূষণকে স্বাস্থ্যনীতির অংশ করা
—বায়ুদূষণকে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের পাশাপাশি ডেঙ্গুর জন্যও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি হিসেবে স্বাস্থ্যনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা; স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
অধিকাংশ ডেঙ্গুমৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য, শুধু দরকার সদিচ্ছা। ডেঙ্গু ভাইরাস একা মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়; এটি আমাদের অব্যবস্থাপনা, বৈজ্ঞানিক তথ্য উপেক্ষা এবং দায়হীন নীতিনির্ধারণের যৌথ ফল। কভিড মহামারির সময় যেভাবে স্বাস্থ্য খাত দ্রুত সাজিয়েছিল, তার যত সামান্যও যদি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রয়োগ হতো তবে ডেঙ্গুতে এত মৃত্যু হয়তো ঠেকানো যেত। প্রশ্ন এখন একটাই—ডেঙ্গুতে আর কত মৃত্যু হলে রাষ্ট্র জেগে উঠবে?
লেখক: ফুল ফ্যাকাল্টি, রিসার্চ সেন্টার ফর গ্লোবাল অ্যান্ড লোকাল ইনফেকশাস ডিজিজেস, ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন, ওইতা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান
মন্তব্য করুন