মেজর (অব.) ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ৩০ জুন ২০২৫, ০৮:১৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ডিসিদের নিয়ে একি—ছি ছি!

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

ইংরেজি বর্ণমালার শুরুর দিকে পাশাপাশি দুটি অক্ষর সি ও ডি। এ দেশে ইংরেজি ভাষার প্রবর্তক ইংরেজ তথা ব্রিটিশরা এ দুটি অক্ষরকে উল্টাপাল্টা করে অর্থাৎ সি ও ডি-এর বদলে ডি ও সি দিয়ে ডিসি নামে একটি প্রশাসনিক পদ সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু ইংরেজরা হয়তো জানতেন না যে একদিন এ ডিসিরাই উল্টাপাল্টা কাজ করে প্রশাসনের ইমেজের বারোটা বাজাবেন। কারণ গত ১২ বছরে ৮ জন ডিসি ৯ জন নারীর বারোটা বাজিয়ে প্রশাসনের ইজ্জতের তেরোটা বাজিয়েছেন, এমনটাই খবর বেরিয়েছে কালবেলায়। তাই জেলায় জেলায় হাসি-আনন্দ আর খেলায় আটজন ডিসির কেলেঙ্কারির কথা ভেসে বেড়ায় সব গল্পকথায়। অথচ প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি প্রার্থী আমজনতার চরিত্র কেমন, তা প্রমাণ হয় এমন ডিসি সাহেবদের কলমের এক খোঁচায়।

ডিসি বলতে ইংরেজ সাহেবরা বোঝাতে চাইতেন ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর। তখন ছিল ঔপনিবেশিক যুগ। ফলে ব্রিটিশরা প্রত্যেক জেলা থেকে কর বা ট্যাক্স আদায় করতেন। আর এজন্য প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর, (ডিসি) নামক ব্যক্তিবর্গকে। শুকনো কথায় চিড়া ভেজে না বিধায় বিশেষ ক্ষমতাবানরূপে ডিসিদের উপস্থাপন করা হয়। তিনি ও তার বাহিনী হাতে হান্টার নিয়ে ঘোড়ায় চড়তেন আর অসহায় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরজবরদস্তি করে হলেও খাজনা আদায় করতেন। তার অফিসের নাম ছিল কালেক্টরেট অফিস, তার প্রতিষ্ঠিত স্কুলের নাম হতো কালেক্টরেট স্কুল, যার কিছু এখনো টিকে আছে।

কালের বিবর্তনে উপনিবেশ প্রথা শেষ হলো। ইংরেজরাও ইংল্যান্ড ফিরে গেল। তাদের পিছু পিছু এ দেশের কিছু মানুষও ইংল্যান্ডে পাড়ি জমালেন। এরপর ইংল্যান্ডে এ দেশের মানুষজন রেস্তোরাঁ ব্যবসা জমিয়ে তুললেন। সেখানে কর্মসংস্থান হলো ভাগ্যান্বেষণে ইংল্যান্ডে যাওয়া বহু মানুষের। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল হলেও অনেকেই ছিলেন ‘পোড়া কপাইল্লা’। তাদের ঠিকানা হলো বাঙালিদের হোটেল বা রেস্তোরাঁয়। দেশে ফিরে আবার এসব সাচ্চা মুসলমান নিজেদের ইংল্যান্ডের ডিসি কিংবা ওসি বলে পরিচয় দিতেন। তবে প্রকৃতপক্ষে তারা ছিলেন ডিশ ক্লিনার (ডিসি) কিংবা অনিয়ন কাটার (ওসি) রূপে কর্মরত।

অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় জেলা প্রশাসনের ডিসি নামক মহাক্ষমতাধর ব্যক্তিটির সঙ্গে আমার ডিসি (ডিরেক্ট কন্টাক্ট) ঘটে। একটি জেলা বা ডিস্ট্রিক্টকে কন্ট্রোল করার জন্য স্বাধীনতার পর প্রত্যেক প্রশাসনিক জেলায় একজন করে ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) পদায়ন করে বাংলাদেশ সরকার। ডিস্ট্রিক্টকে যদি জমিদারি ধরা হয়, তবে ডিসি হলেন সেখানকার জমিদার। সরকারের প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের কোনো না কোনো কমিটি রয়েছে ডিস্ট্রিক্ট পর্যায়ে। আর এসব কমিটির প্রায় সবকটির সভাপতি হন ডিসি। এক বা একাধিক স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, শিশু জন্ম ও লালন কেন্দ্র, গোরস্তান, শ্মশান; এককথায় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ডিসিই জান, ডিসিই প্রাণ। সর্বক্ষেত্রে তাই শুধু ডিসি আর ডিসি, এই ঐকতান। একজন ডিসি কয়টি কমিটির সভাপতি আর এক দিনে কিংবা এক মাসে একজন ডিসির পক্ষে এসব কমিটির কয়টি মিটিংয়ে সময় দেওয়া সম্ভব, এ নিয়ে হয় না কোনো প্রশ্নের উদ্ভব। তাই ডিসিরা সবকিছুতে ছিলেন, আছেন, থাকবেন—এটাই রীতি। কারণ বাস্তবে ডিসি ছাড়া আমাদের নেতাদের নেই কোনো গতি।

জেলায় কোনো নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজটি সম্পন্ন হয় ডিসির মাধ্যমে। এমন একটি প্রকল্পের খবরে ডিসি অফিসে আনন্দের জোয়ার নামে। ভূমি অধিগ্রহণের নামে নানা দুর্নীতি ও জালিয়াতিতে অভিযুক্ত ডিসির সঠিক সংখ্যা গুনে বের করা কঠিন। তবে বেরসিক কালবেলা ৮ ডিসির নাম করেছে জাহির, যারা ১২ বছরে বারোটা বাজিয়েছে ৯ নারীর। কালবেলার কি খেয়েদেয়ে নেই কোনো কাজ? কেন রে বাবা! ডিসিরা তো মূলত জমিদার, যদিও পরনে নতুন সাজ তার। আর জমিদারি রক্তে কিছুটা পটেটো প্রবলেম (আলুর দোষ) তো থাকতেই পারে। তাদের শরীরে ডাইরেক্ট কারেন্ট। তাই নিরাপদ দূরত্বে না থেকে ডিসিদের নিয়ে অযথা টানাটানি কেন? আর তোমাদের মতো এ দেশের সব পত্রিকার ডিক্লারেশন, সে তো ডিসি মহোদয়েরই অবদান, সে কথা কি ভুলে গেছো বাছাধন!

২০১৩ সালের মিস্টার কান্তি নামের জনৈক ডিসি মনের ক্লান্তি ঘোচাতে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে এক নারীর ঘরের দরজার ভেতর খিলি আটকে দিয়েছিলেন। এমনটা টের পেয়ে আমজনতা দরজার বাইরের খিলি আটকে দেন। দীর্ঘ চার ঘণ্টা ‘হাম তোম এক কামরা মে বন্দি হো’ গানের দৃশ্যায়ন শেষে পুলিশ এসে ঘরের খিলি খুলে ক্লান্ত ডিসিকে উদ্ধার করে। খিলগাঁওয়ের দরজায় খিলি আটকানো ও খোলার ঘটনার পরও সেই ক্লান্ত ডিসির মন শান্ত হয়ে যায় যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার কারণে।

২০১৮ সালে নাটোরের ডিসি গোলাম একটা ছোট্ট গোলমাল বাধিয়ে দেন। তার ওপর ভর করেছিল জীবনানন্দ। তাই আনন্দ করতেই জুনিয়র নারী সহকর্মীকে ‘নাটোরের বনলতা সেন’ ভেবে বসেন। তাকে মেসেঞ্জারে পাঠানো অশোভন আচরণ ও প্রস্তাব নাটোরের সীমা ছেড়ে ইউরোপের ন্যাটো অবধি পৌঁছে যায়। পরে তাকে একটি প্রকল্পের পরিচালক করা হয়।

২০১৯ সালে জামালপুরের ডিসি এক কামাল কাণ্ড ঘটান। কবির নামের এ ডিসি তারই অফিসে এক নারী সহায়কের সঙ্গে কবিরা গুনাহ করেছেন মর্মে দুটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। কবিরা গুনাহর কারণে তার পদোন্নতি বন্ধের ঘোষণা দেয় সরকার বাহাদুর। অথচ একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সগিরা গুনাহ হলেও লাল দালানের ভাত খাইয়েছেন তিনি। একই বছর দিনাজপুরের দিনমজুর ও আলেম সমাজ গর্জে ওঠেন সেখানকার ডিসি আলম সাহেবের বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে ডিসির সঙ্গে নিজের অনৈতিক সম্পর্কের তথ্য ফাঁস করে ভিডিও বার্তা দেন এক নারী। কী আর বলব, উই আর সরি।

২০২০ সালে দেশের উত্তর-পূর্বকোণের জেলা নেত্রকোনার ডিসির নেত্র (চোখ) পড়ে তারই কার্যালয়ের এক নারী কর্মীর ওপর। এরপর গ্রাম্য সালিশ কায়দায় তদন্তপূর্বক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে’ স্টাইলে দুজনকে বদলি করে অনেক বড় দায়িত্ব পালন করে। আর এভাবেই ডিসিরা পান সরকারি প্রটেকশন।

২০২১ সালে অন্যের স্ত্রীর ওপর নিজের হক প্রতিষ্ঠা করেন বাগেরহাটের ডিসি জনৈক হক সাহেব। তবে তাকে বাঘের মতো ভয় পেত তৎকালীন প্রশাসন। তাই হক বিচার না করে উল্টো হক সাহেবকে যুগ্ম সচিব পদে প্রমোশন দিয়ে সে যাত্রা বাঘের থাবা থেকে প্রাণ বাঁচান প্রশাসনের হর্তাকর্তা। কেউ ভাবল না পরের স্তরের মানুষগুলো পেল কেমন বার্তা।

২০২৩ সালে প্রকাশ পায় তিন বছর আগের অর্থাৎ ২০২০ সালের ঘটনা। বড় বড় গুণে গুণান্বিত ছিলেন বরগুনায় কর্মরত ডিসি হাবিবুর রহমান। আরবি হাবিব শব্দের অর্থ বন্ধু। বরগুনার ডিসি হাবিব সবাইকে বন্ধু ভাবতেন। হাবিব সাহেবের এ বন্ধুর তালিকায় ছিলেন একজন ‘হাবিবি’ (নারী), যিনি ২০২০ সালে ধারণ করা কিছু অন্তরঙ্গ ভিডিও ’২৩ সালে এসে বাজারে ছাড়েন। তবে মজার বিষয় হলো, হাবিব সাহেবের হাবিব-হাবিবি (বন্ধুবান্ধব) কমতি ছিল না ওপরমহলে। ফলে তাকে পদায়ন করা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা শাখায়। নারীসহ সব জনতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন করেন এ হাবিব। গেল বছর (২০২৪) তিনি পদোন্নতি পেয়েছেন। তবে পদোন্নতির পর হাবিবি-হাবিবি গানের সুরে ডিজে পার্টি দিয়েছিলেন কি না, তা জানা যায়নি।

২০২৫ সালে শরীয়তপুরে ঘটে শরিয়তবিরোধী আরেক ঘটনা। কালবেলা সংবাদ বলছে, সেখানকার ডিসির (বর্তমানে ওএসডি) সঙ্গে দুজন নারীর আপত্তিকর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পায়। আর এভাবেই ১২ বছরে ৮ জন ডিসির মাধ্যমে ৯ নারীর বারোটা বাজার ঘটনা প্রকাশ পায়।

তবে এবার কালবেলার বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা বলছি। শুধু ডিসি কেন? থানার ওসি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ল্যান্ডের এসি, নির্বাচন কমিশনের ইসি, ব্যাংকের ভুয়া এলসি—সবই কি তবে ধোয়া তুলসী?

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

ইমেইল: [email protected]

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

জুলাই সনদ নিয়ে টালবাহানা সহ্য করা হবে না : নাহিদ 

ব্রাজিলিয়ান ক্লাবের কাছে হেরে সতীর্থদের ওপর ক্ষুব্ধ আর্জেন্টাইন লাউতারো

সীমান্ত দিয়ে ৯ বাংলাদেশিকে হস্তান্তর বিএসএফের

আন্দোলনের একপর্যায়ে ‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতিতে চলে যাই : নাহিদ ইসলাম

স্বামীকে রাতভর নির্যাতনের পর স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

বিপিএল নিয়ে অবশেষে বড় ঘোষণা

কমলো সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার, আজ থেকে কার্যকর

৫ দিনেও হয়নি সেই নারীর ডাক্তারি পরীক্ষা

যুদ্ধবিরতির পর নিহতের নতুন সংখ্যা জানাল ইরান

১০

সিটিকে বিদায় করে ক্লাব বিশ্বকাপে আল হিলালের বড় অঘটন

১১

ডেঙ্গু জ্বর: কিছু তথ্য

১২

এইচএসসিতে প্রশ্নপত্র নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সতর্কতা

১৩

জুলাই অভ‍্যুত্থান : মাসব্যাপী কর্মসূচি উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা

১৪

৪৪তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম ফরহাদ

১৫

‘দুঃখিত, এবার আর তা হবে না’

১৬

‘কূটনীতির দরজা কখনো পুরোপুরি বন্ধ হয় না’

১৭

তেলের দামে বড় পতনের আভাস

১৮

এসএসসি পাসেই ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে চাকরি

১৯

৩২৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ, বাবা-ছেলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

২০
X