(গতকালের পর)
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এবারের জুলাই-আগস্টের গণজাগরণে বা আন্দোলনে নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে, যা নারীর ক্ষমতায়ন বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে নির্দেশ করে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের কোনো আন্দোলনে নারীদের এত ব্যাপক অংশগ্রহণ আগে খুব একটা পরিলক্ষিত হয়নি। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে, ১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার দাবিতে, স্বাধিকারের দাবিতে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মূল পর্বে বাংলাদেশের নারীরা অংশগ্রহণ করেছে এ কথা সত্যি! পরবর্তীকালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এবং বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষ করা গেছে, তবে ২০২৪-এর মতো এত ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কখনোই দেখা যায়নি। শুধু নারী শিক্ষার্থী নয়, পেশাজীবী নারীরাও নিজস্ব মানসিক উপলব্ধির মধ্য থেকে এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছেন। অভিভাবক হিসেবে গৃহিণী নারীরা তাদের সন্তানসহ আন্দোলন চলাকালে প্রতিদিনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন, যা নিঃসন্দেহে আন্দোলন বেগবান করেছে।
যমুনা টিভির প্রিন্টিং মিডিয়ায় ‘নিক্কেই এশিয়ার’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কর্তৃত্ববাদী শাসকের মতো আচরণ শুরু করেন শেখ হাসিনা। খালেদা জিয়াকে মামলা দিয়ে কারাগারে বন্দি করা হয়। তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেবতার মতো উপস্থাপন করতে থাকে। ক্ষমতার সবচেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সেখানে সব ধরনের সুবিধায় এগিয়ে থাকত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যায় বিরাটসংখ্যক সাধারণ শিক্ষার্থী।’ এ ‘বিরাটসংখ্যক সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ মধ্যে নারীদের হার বর্তমান সময়ে আগের তুলনায় অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২৮ মার্চ ২০২৪-এ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, চিকিৎসা, আইন, কৃষি শিক্ষাসহ দেশের পেশাগত শিক্ষায় যত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন, তাদের মধ্যে ৬১ শতাংশের বেশি হলো নারী শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২৩-এর খসড়া তথ্যের উল্লেখ করে এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, স্কুল অ্যান্ড কলেজে ছাত্রীদের হার ৫৩ শতাংশের বেশি, মাদ্রাসায় প্রায় ৫৪ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীদের হার ৩৭ শতাংশের বেশি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের এ হার আরও বেশি। সুতরাং মোটাদাগে এ কথা বলা যে, বর্তমান সময়ে নারী শিক্ষার্থীদের হার অতীতের তুলনায় বেশি হওয়ার কারণে এবারের আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণের হার ছিল বেশি। তবে জুলাই-আগস্টের গণজাগরণ বা আন্দোলনে নারীদের সম্পৃক্ততা শুধু নারীদের শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই হয়নি। এর পেছনে তাদের নিজস্ব উপলব্ধি ও রাজনৈতিক ভাবনা, মানুষ হিসেবে নিজেকে চেনা, সর্বোপরি স্বৈরশাসনের মাধ্যমে পুরুষের পাশাপাশি নারীর কণ্ঠস্বরকে সমানভাবে দমিয়ে রাখার যে চেষ্টা, বিগত বছরগুলোতে ক্রিয়াশীল ছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই ছিল মূল কারণ।
দ্য ডেইলি স্টারের সাংবাদিক সুচিস্মিতা তিথি এ গণজাগরণের তিনজন নারী সমন্বয়কদের (নুসরাত তাবাসসুম, উমামা ফাতেমা, রাফিয়াত রেহনুমা) একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, যা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরে প্রচারিত হয়। সে সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের ছাত্রী নুসরাত তাবাসসুমের (যাকে ডিবি অফিসে অন্যান্য সমন্বয়কসহ আটক রাখা হয়েছিল) বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, নারীদের কোটা দিয়ে বরং হেয় করা হচ্ছে। কোটা নারীর ক্ষমতায়নের জন্য শোভন নয়। অন্যান্য সবক্ষেত্রে বৈষম্য রেখে চাকরিতে প্রবেশের ১০ শতাংশ কেটে রেখে নারীর ক্ষমতায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। এটা অনেকটা শাঁখের করাতের মতো। বর্তমান সময়ে নারীরা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা নিজেদের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বলে মনে করে না। নারীরা এখন সমতায় বিশ্বাস করে। সমতার সংগ্রাম ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য তিনি প্রথম থেকেই সক্রিয়ভাবে এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এমনকি ১৪ জুলাই রাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তিনিসহ শামসুন নাহার হলের মেয়েরা মিছিল নিয়ে রাজু চত্বরে এসেছে। বিভিন্ন হলের পুরুষ শিক্ষার্থীরা বরং তাদের পরে এসেছে। উল্লেখ্য, ১৪ জুলাই এক প্রেস কনফারেন্সে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে’ অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের তিরস্কার করেন। দৈনিক যুগান্তরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত কোটা পদ্ধতি বাতিলের যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা হাইকোর্টের মাধ্যমে অবৈধ ঘোষণা করা হয় ৫ জুন। ৯ জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে। এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিনউদ্দিন বলেন, হাইকোর্টের কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণার রায় বহাল থাকবে নাকি বাতিল হবে সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে আপিল বিভাগ। এরই প্রতিবাদে ২ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে কোটাসংক্রান্ত বিষয়ে ২০১৮ সালের সরকারি বিজ্ঞপ্তি পুনর্বহালের দাবিতে টিএসসি এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে। ৩ জুলাই থেকে বিক্ষোভ বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ১৪ জুলাই শিক্ষার্থীরা পদযাত্রার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি পালন করে। সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকারদের মধ্যে বিভেদ টেনে আন্দোলনকারীদের কটাক্ষ করেন এবং সে প্রেস কনফারেন্সের চুম্বক অংশ জুড়ে তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে প্রদত্ত নারী কোটা না থাকলে মেয়েদের চরম পরিণতি হতো বলে মন্তব্য করেন। শেখ হাসিনার ‘রাজাকার’ শব্দটিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই গ্রহণ করতে পারেননি। এরই প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের হলগুলোতে বিক্ষোভ শুরু হয়। তখনো তারা হলের বাইরে আসেননি কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা হল থেকে বের হয়ে আসেন। সে সাক্ষাৎকারে আরেক নারী সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা (যিনি ১৫ জুলাই মিছিলে ছাত্রলীগের আক্রমণের শিকার হন) জানান যে, তারা খবর পান আন্দোলনকারী ছেলেদের হলে আটকে রাখা হয়েছে। তখন তারা অন্যান্য হলের মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নেন, যদি তারা হলের বাইরে এসে প্রতিবাদ করেন তাহলে তাদের ভাইয়েরা সাহস পাবে এবং আন্দোলনের জন্য আরও সক্রিয় এবং সংঘবদ্ধ হতে পারবে। যদি সরকারের পেটোয়া বাহিনী এবং ছাত্রলীগের ছেলেরা আক্রমণ করে, সামনে নারীদের দেখলে তারা ততটা হিংস্র আক্রমণ করতে পারবে না। রাত ২টা পর্যন্ত তারা রাজু চত্বরে অবস্থান করে বিক্ষোভ করেন। সে রাতেই তারা পরের দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। সরকার কঠোরভাবে আন্দোলন দমন করার জন্য ১৫ জুলাই মিছিলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে। ছাত্রলীগ সেদিন শুরু থেকে চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে মেয়েদের মারতে থাকে। অনেক নারী শিক্ষার্থী সেদিন আহত হয়েছেন ছাত্রলীগের হাতে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনো হয়নি। সরকার ও ছাত্রলীগ কর্তৃক বলপ্রয়োগের এ ঘটনা নারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। দ্য ডেইলি স্টারের সে সাক্ষাৎকারে তিন নারী সমন্বয়ক আরও বলেন, ছেলেরা মার খাবে আর মেয়েরা তা চুপচাপ দেখবে; তা হয় না। নিজেদের নারী নয় বরং মানুষ ভেবে, সরকারের বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে এবং সমতা প্রতিষ্ঠার তাগিদ থেকে তারা প্রতিদিনের কর্মসূচিতে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেছে। তারা মনে করেন, এভাবে যদি তারা এগিয়ে না আসতেন, তাদের ভাইয়েরা এবং সহপাঠীরা আরও বেশি মার খেত।
‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’—জনপ্রিয় এ স্লোগানটি এবারের আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে ধ্বনিত হয়েছে বহুবার। অসংখ্য নারী—কেউ শাড়ি, কেউ হিজাব, কেউবা প্যান্ট ও কুর্তি, কারও আবার আপাদমস্তক বোরকা ঢাকা—বিভিন্ন মতের, আদর্শের, সংস্কারের, কেউ মুসলিম, কেউবা হিন্দু অথবা খ্রিষ্টান, কেউ আদিবাসী, নানা বর্ণের, নানা সাজের কিন্তু মুখের স্লোগান একটি—‘দাবি আমাদের এক, বৈষম্য নিপাত যাক’। প্রতিদিন টিভি চ্যানেল ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আন্দোলন চলাকালে প্রচারিত বহু ভিডিওতে এরকম চিত্র দেখা গেছে। একটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মেয়েরা হাতে ব্যানার, হ্যান্ড মাইক নিয়ে বিক্ষোভ করছে। প্রায় শিশু এ মেয়েদের সাহসী ভূমিকা, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এক অভাবনীয় দৃশ্য! শুধু ভিকারুননিসা স্কুল নয়, আরও অনেক স্কুলের মেয়েদের পুলিশের জীবন ধ্বংসকারী মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে ‘রুটি বেলার বেলুনি’ নিয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে, যা নারীদের সচেতনতার এবং ‘সংসার ও চার দেয়ালের ‘মধ্যে আটকে থাকার পুরোনো ছকের’ বিরুদ্ধে সরব হওয়ার আগমনী বার্তা বহন করে নিঃসন্দেহে। [চলবে]
লেখক: অধ্যাপক, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
জুলাই-আগস্টের গণজাগরণে আন্দোলনকারীদের দমন করার জন্য সরকার প্রথম থেকেই অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। ১৮ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ত্যাগ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় অথচ এটি ছিল সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এরকম একটি বিক্ষোভ সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামসুন নাহার হলের সানজিদার বক্তব্য ছিল হৃদয়গ্রাহী। ‘পেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা’—সানজিদার কাছে এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছিল স্বাধীনতার আরেক নাম। মাই টিভিতে প্রচারিত এক ভিডিওতে তাকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে দেখা যায়, ‘আমরা কেন হল ছাড়ব? আমরা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের স্টুডেন্ট। সরকার এখানে নাক গলাতেই পারে না। দে হাভ নো রাইট। উনাদের সতর্ক করছি, বাঘকে মাঠে নামাবেন না। রক্তে ভেসে যাবে। আপনারা নিজেরাই কোনো কূল-কিনারা পাবেন না। আমরা কেন হারব? আমরা তো কোনো অযৌক্তিক দাবি নিয়ে এখানে আসিনি, আমরা তো বলিনি কোটা বাতিল করেন। আমরা বলেছি সংস্কার করেন।’ তার মতে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংখ্যার দিক থেকে অনেক বেশি, যা অযৌক্তিক। তা ছাড়া অনেক সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। আর এ সুযোগ গ্রহণ করছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। তার এ বক্তব্যে এটি সুস্পষ্ট যে, রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট বৈষম্যের প্রতি এ আন্দোলনে তিনি নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবনা থেকে সম্পৃক্ত হয়েছেন। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মত বা নেতৃত্বের আহ্বান ছাড়াই তিনি তার আত্মোপলব্ধির জায়গা থেকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। মাই টিভির সে ভিডিওতে অভিভাবক হিসেবে একজন মায়ের সাক্ষাৎকারও প্রচারিত হয়। তিনি পুলিশের কঠোর ভূমিকার সমালোচনা করেন। সরকারের মতপ্রকাশের অধিকার হরণের বিষয়ে তিনি কথা বলেন—‘আমি আমার বাচ্চাকে লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছি, লাশ হতে নয়।’ এ নারীরা প্রত্যেকেই জানেন যে, মিডিয়ায় তাদের বক্তব্য এবং ছবি প্রচারিত হলে তারা ফোকাসড হবেন। সে কারণে তারা সরকারের রোষানলেও পড়তে পারেন। তবুও তারা আন্দোলনের সম্পৃক্ত হন এবং পরিষ্কারভাবে বিগত সাড়ে ১৫ বছর ধরে চলা বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য এবং একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য তারা তাদের ভাবনাকে তুলে ধরেছেন, যেখানে প্রত্যেকের অধিকার নিশ্চিত হবে।
‘নারী যেখানে অগ্রসর, কোটা সেখানে হাস্যকর’—চমৎকার এ বক্তব্যটি প্রচারিত হয়েছিল আন্দোলন চলা সময়ে ‘কোটা পেয়েও কেন আন্দোলনে নারীরা’ এ শিরোনামে এটিএন নিউজ চ্যানেলে। সেখানে বিভিন্ন নারীকে বলতে শোনা যায় যে, ‘আমরা নারী, আমরাও পারি। এটা আমরা প্রমাণ করতে চাই। নারী বলে আমাদের চাকরিতে প্রবেশের জন্য কোটা দিতে হবে, এটা অবমাননাকর। কোটা থাকতে পারে, তবে তা প্রতিবন্ধী বা অন্যান্য অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য। অনগ্রসর বলে আমাদের মেধাকে হেয় করা হচ্ছে। কোটা নয় বরং মেধা দিয়ে নারীকে মূল্যায়ন করা হোক।’ এটিএন নিউজ চ্যানেলের ভিডিওটি থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, নারীরা নিজেদের মেধা ও শক্তির প্রতি এখন অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল। তারা নিজেরা এখন আর অবহেলিত এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের ভাবে না।
বিগত সাড়ে ১৫ বছর ধরে চলা আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের এ গণজাগরণে নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন পেশাজীবী মহিলাদেরও অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। ১ সেপ্টেম্বর বিবিসি নিউজ বাংলায় প্রকাশিত আকবর হোসেনের ‘শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে এত নারী রাস্তায় নেমেছিল কেন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে পেশাদার বডিবিল্ডার ফারজানা লিওর বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। ফারজানা লিও বলেন, ‘আমি মনে করেছি যে, রাস্তায় গিয়ে আন্দোলন করাটা আমার নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের ছেলেদের রক্ষা করতে হবে, এটা আমি ভেবেছিলাম। মায়ের দিক থেকে যখন আপনি সাপোর্ট পাবেন, তখন সন্তান বলেন আর সহকর্মী বলেন, সবারই বুকের সিনা টান হয়ে যায়। মা যদি সাহস দেয় যে, তুমি যাও। তুমি না গেলে দেশের কী হবে? তুমি না গেলে এই দেশকে কে রক্ষা করবে? এ সাহসটা তো ঘর থেকে আসতে হবে।’ ফারজানা লিওয়ের এ বক্তব্য যদি আমরা মূল্যায়ন করি তাহলে দেখতে পাই যে, ওনার মতো বহু নারী স্বেচ্ছায় এ আন্দোলনে এসেছেন। পুলিশ যেভাবে কঠোর হয়ে আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের হত্যা করেছে এবং আহত করেছে, এটা তারা মা হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। সন্তানদের উৎসাহ দিতে, সাহস জোগানোর নৈতিক জায়াগা থেকে তারা এ আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। মায়েদের তাদের সন্তানদের স্বেচ্ছায় এ আন্দোলনে শরিক হওয়ার উৎসাহ জোগানোর কারণে এবারের আন্দোলনে পুলিশের কঠোর ভূমিকাও আন্দোলনকারীদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। পুলিশকে তাইতো বলতে শোনা যায়, ‘মারি একটা, মরে একটা, বাকিডি যায় না। এটাই সমস্যা।’ মায়েদের সাহসিকতার সঙ্গে সন্তানদের এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার উৎসাহ দেওয়ার মানসিকতা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীদের ভূমিকা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে প্রমাণ করে।
একটি ভিডিওতে ৩১ জুলাইয়ের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি চলাকালে হাইকোর্টের মাজারগেটে, ‘পিঠে ব্যাকপ্যাক ও চশমা পরা’ একটি মেয়েকে (নুসরাত জাহান টুম্পা) পুলিশের প্রিজন ভ্যান আটকে দিয়ে বলতে শোনা গেছে—‘আমি আমার ভাইকে নিয়ে যেতে দেব না।’ এর কিছুক্ষণ আগে ভিডিওটিতে দেখা যায়, পুলিশ মেয়েটির সঙ্গে থাকা তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাইকে আটক করে প্রিজন ভ্যানে উঠিয়েছিল। এ ঘটনার প্রতিবাদে মেয়েটিকে তার সর্বশক্তি দিয়ে প্রিজন ভ্যানের গতিরোধ করতে দেখা যায়। পুলিশের অস্ত্রের কাছে নতিস্বীকার না করে মেয়েটির দৃঢ়চিত্তে প্রতিবাদের এ ভিডিও বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছে। সেইসঙ্গে এটিও প্রমাণ করেছে যে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা আন্দোলন দমাতে সরকার কতটা মরিয়া হয়েছিল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন-পরবর্তী সময়ে নাগরিক টিভিতে ‘আসছে ফাগুন, আমরা হব দ্বিগুণ’—এ শিরোনামে নুসরাত টুম্পার একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। এ পুরো সাক্ষাৎকারটি তার সঙ্গে থাকা স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাই নুরকে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করার দৃঢ় মানসিক শক্তি, পুরুষের পাশাপাশি নারীও যেকোনো কাজে যে সমান পারদর্শী; তারই ইঙ্গিত বহন করে।
আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রীদের নিয়ে একটি ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন করা হয়। সেখানে আটজন ছাত্রী আন্দোলন সম্পর্কে এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোলাখুলিভাবে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। তারা জানান, ১৭ জুলাই রাতে যখন হল ছাড়ার নির্দেশ আসে, তখন তারা সংঘবদ্ধভাবে হল না ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। উল্লেখ্য, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি ছাত্রী হল রয়েছে। তিনটি হলের মেয়েরাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন এবং ছেলেদের সঙ্গে এক হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হন। তারা আরও জানান, এমনকি ১৪ তারিখ রাতে মেয়েরা ছেলেদের আগেই মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৮ জুলাই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাপে হল ছাড়তে বাধ্য হন। এ ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনে সবাই একটি কথা বলেছেন, কোটা সংস্কারের জন্য আগে থেকেই তারা সোচ্চার ছিলেন। তবে ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার ‘রাজাকার’ সম্পর্কিত কটূক্তি তাদের ভীষণ মর্মাহত করে। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া ইউনিভার্সিটির ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যু তাদের যারপরনাই ব্যথিত করে এবং সাহস বাড়িয়ে দেয়। নারী হিসেবে নিজেদের কখনো তারা আলাদা কিছু ভাবেননি। সে কারণে ১০ শতাংশ নারী কোটা দিয়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বিষয়টি তারা তাদের মেধার প্রতি অসম্মানজনক বলে মনে করেন। কয়েকজন ছাত্রী এ কথা বলেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনা সরকার যেভাবে নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে দিয়েছিল, টাকা পাচার ও দুর্নীতির মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল; এ বিষয়গুলো তাদের মধ্যে ক্ষোভ জমিয়েছে। পুলিশ দিয়ে ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’কে দমন করার যে ভূমিকা সরকার নিয়েছিল, তা তাদের আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। এ কারণেই তারা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তাদের অনেকের মতে, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য দরকার নারীর মেধাগত যোগ্যতা। কখনোই কোটা দিয়ে নারীর ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করা যায় না। বুদ্ধিবৃত্তিক উপলব্ধি, নিজস্ব ন্যায়বোধ, সমাজ সম্পর্কিত সচেতন চিন্তা প্রভৃতির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব বলে তারা মনে করেন। ১৮ জুলাই তারা হল ছাড়লেও আন্দোলনের মাঠ ছাড়েননি। তাদের কেউ কেউ সিলেটে থেকে গেছেন, আবার কেউ কেউ বাড়ি চলে গেছেন। যারা বাড়ি চলে গেছেন তারা স্থানীয়ভাবে যে আন্দোলনগুলো হয়েছে, সেখানে মাকে নিয়ে, এমনকি বাবাকে নিয়েও উপস্থিত ছিলেন। আর যারা সিলেটে ছিলেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে আন্দোলনের যেসব কর্মসূচি পালিত হয়েছে, প্রত্যেকে সক্রিয়ভাবে সেখানে অংশগ্রহণ করেছেন। কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বা মতের প্রতি তাদের কোনো ‘ফ্যাসিনেশন’ নেই। কোনো দলীয় আদর্শে বিশ্বাসী না হয়েই রাজনৈতিক সচেতনতার প্রশ্নে, বৈষম্যহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জুলাই-আগস্টের এ গণজাগরণে তারা সম্পৃক্ত হয়েছেন। এ ডিসকাশনে দুজন মেয়ে জানিয়েছেন যে, তারা নিজেকে কখনো নারী হিসেবে ভাবেননি বা ভবিষ্যতেও ভাববেন না। যে কোনো বৈষম্যের প্রতি তারা সবসময় রুখে দাঁড়াবেন। শুধু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার নয় বরং আগামীতে যে সরকারই বৈষম্য তৈরি করবে কিংবা অগণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করবে, তার বিরুদ্ধেই তারা আবারও প্রতিবাদ গড়ে তুলবেন। নারী নয় বরং তারা নিজেকে মানুষ হিসেবে দেখতে চান।
এ ছাড়া এই ডিসকাশনে সবাই প্রায় একমত পোষণ করেছেন যে, বিগত সরকার যেভাবে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে তাদের ‘নিজস্ব অর্জনের বিষয়’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালিয়েছিল, তা সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশে বিভাজন তৈরি করেছে এবং সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলাকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা হিসেবে দেখা হয়েছে। অথচ তাদের অনেকের বাবাদেরও জন্ম হয়েছে ১৯৭১-এর পর। এভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করাকে তারা মেনে নিতে পারেননি এবং পারবেনও না। গণতন্ত্রে ভিন্নমত থাকবে। ভিন্নমত কখনো স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা হতে পারে না। কিন্তু গত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনা সরকার এভাবেই বাংলাদেশে Sense of Political Injustice তৈরি করেছে।
জুলাই-আগস্ট গণজাগরণ ও নারীদের অংশগ্রহণ: কিছু ভাবনা
উপর্যুক্ত তথ্যগুলো থেকে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এবারকার জুলাই-আগস্ট গণজাগরণে বা শ্রাবণ বিপ্লবে নারীদের অংশগ্রহণ আন্দোলনকে এক ভিন্নমাত্রা দিয়েছিল। নারীর ক্ষমতায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি নারীদের অংশগ্রহণের এ বিষয়টি আমরা মূল্যায়ন করি, তবে দেখতে পাই যে, বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে মেয়েরা আগের চেয়ে অনেক বেশি ‘নারী স্বাধীনতায়’ বিশ্বাসী। গতানুগতিক ছকের বাইরে এখন তারা তাদের কণ্ঠস্বর প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, ‘ক্ষমতায়ন হচ্ছে মানুষের সেই অধিকার অর্জিত হওয়া, যার দ্বারা নিজের জীবনের পাশাপাশি সমাজ-পারিপার্শ্বের ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব হয়। শুধু ক্ষমতায় থাকা নয়, দরকার তা প্রয়োগের অধিকার; শুধু উঁচু পদে আসীন হওয়া নয়, দরকার পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতার সঙ্গে ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার অর্জিত হওয়া অর্থাৎ ক্ষমতায়ন হচ্ছে এমন একটি বিষয় যার দ্বারা মানুষ তার নিজের শরীর, মন ও কাজের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।’ এবারের আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রোকেয়া কবীরের এ মতামতের পূর্ণ প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। নারীরা তাদের নিজস্ব উপলব্ধির মধ্য দিয়ে, স্বেচ্ছায় এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কারও নির্দেশে নয়, মনের তাগিদে তারা পুরুষের পাশাপাশি থেকে, কখনোবা এগিয়ে গিয়ে আন্দোলনে শামিল হয়েছেন।
ক্যারলিন মোসার বলেন, “The capacity of women to increase their own self-reliance and internal strength. This is identified as the right to determine choices in life and to influence the direction of change, through the ability to gain control over crucial material and non- material resources.”১৭ মোসারের এ ভাবনারও একটি চমৎকার উদাহরণ হতে পারে এবারের আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণের বিষয়টি। নারীর ভেতরকার শক্তিই তার নিজস্ব চাওয়া নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে এবং তাকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে একটি বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের দলীয় বয়ান দিয়ে স্পষ্টই বাংলাদেশে একটি বিভাজনমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেছিল যার একদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আর অন্যদিকে ভিন্নমত পোষণকারী সবাই তার (শেখ হাসিনা) মতে, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। এভাবে সমাজে বিভাজন তৈরি করে মানুষের দ্রোহকে তিনি ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে তুলেছিলেন। অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের মধ্য দিয়ে তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জেঁকে বসে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাইতো ২০২৩-এর নভেম্বরে বিশ্বের শক্তিশালী পত্রিকা টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘হার্ড পাওয়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রচ্ছদ করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার সব জায়গায় অতিমাত্রায় দলীয়করণ করে তিনি অ্যারিস্টটলের বর্ণনাকৃত ‘Sense of Political Injustice’-এর জন্ম দিয়েছিলেন, যা শুধু পুরুষ নয়; নারীকেও সমানভাবে প্রতিবাদী করে তুলেছে। এ কারণেই নারীর অংশগ্রহণ এবারের জুলাই-আগস্টের গণজাগরণে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে, আন্দোলনকে মহান করেছে।
এবারকার আন্দোলনে একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের নারীরা এখন আর নিজেদের অনগ্রসর ভাবতে ইচ্ছুক নয়। তারা তাদের মেধায় বিশ্বাসী এবং নিজস্ব অধিকারে বিশ্বাসী। পুরুষের সহযাত্রী হওয়ার স্পৃহা থেকে এবং তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক সচেতনতার মধ্য দিয়ে এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছেন। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, সময়ের প্রয়োজনে তারা কাজ করতে সক্ষম। যে কোনো বৈষম্যের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াতে সক্ষম। রাষ্ট্র ও সমাজ যদি নারীদের অবহেলিত কিংবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী মনে করে, সেখানে তাদের তীব্র আপত্তি রয়েছে, বরং জৈবিকভাবে এখন আর তাদের দুর্বল ভাবার কোনো সুযোগ নেই। নিঃসন্দেহে এ ভাবনাগুলো বর্তমান বাংলাদেশে নারীদের ক্ষমতায়নকেই নির্দেশ করে। আমরা আশাবাদী, একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করার জন্য যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করার দরকার, বাংলাদেশের নারীরা সে প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে এখন শতভাগ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাইতো এ আন্দোলনে নারীর সাহসী উচ্চারণ ছিল ‘পেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা’— স্বাধীনতার প্রশ্নে সামনে এগিয়ে যাওয়াই এখনকার নারীদের একমাত্র লক্ষ্য। এ লক্ষ্যই জুলাই-আগস্ট গণজাগরণে বিশাল পরিসরে নারীর অংশগ্রহণকে উৎসাহ জুগিয়েছে এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার গল্পগুলো সত্যি করে তুলেছে।
লেখক: অধ্যাপক, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
মন্তব্য করুন