বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের একটি গান কদিন আগে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। গানের শুরুতে গাওয়া হয়েছে—‘আইলারে নয়া দামান আসমানেরি তেরা, বিছানা বিছাইয়া দিলাম সাইল ধানের ন্যাড়া, দামান বও... দামান বও...ও... ও’। শ্বশুরবাড়িতে আকাশের তারা (তেরা)-সম নতুন জামাই (স্থানীয় ভাষায় দামান) এলে এমন গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে তাকে বরণ করার রীতি ছিল বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে। সেই সিলেট অঞ্চলেই পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে অপরূপ পর্যটন কেন্দ্র বিছনাকান্দিতে প্রকৃতির নিজ হাতে বিছানো সাদাপাথর সাবাড় করেছে ৫ আগস্টের পর সমাজে তাশরিফ আনা নয়া দামানের দল। এসব দামানের আবার দলীয় পরিচয় ছিল, যা প্রত্যাহার করেছে দলের হাইকমান্ড।
এই দলের নেত্রীকে ঘরে আটক রাখতে তার বাড়ির গেটে ব্রিটিশ আমলের পুরোনো ট্রাকভর্তি বালু রাখা হয়েছিল। তখন দলের কোনো দামান একমুঠ বালুও সরাতে এগিয়ে আসেনি। কোনো ধরনের কামান দাগেনি এই দামানের দল। সেই বালুর ট্রাক সরেছিল বেশ কদিন পর স্বয়ং শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী ইচ্ছায়। সেদিন যদি বালুর বদলে সাদাপাথরের ট্রাক নেত্রীর বাসার সামনে রাখা হতো, তবে তা সরাতে কয় মাস বা বছর লাগত কে জানে।
কিন্তু আজ মাঠে নেমেছে সময়ে নীরব এবং অসময়ে সরব নয়া দামানের দল। কেউ বাজায় তদবির-বাণিজ্য আর কেউ বাজায় দখল-বাণিজ্যের ঢোল। কেউবা আবার হাজার কোটি টাকার সাদাপাথর হাওয়া করে সমাজকে খাওয়ায় ঘোল। তারা কালো টাকার পাহাড় গড়ে খুলেছেন নিত্যনতুন কোম্পানি। এসব কোম্পানির খবর আমরা কীইবা জানি! তাদের কাজ ছিল বৃহত্তর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের ধলাই নদীর উৎস মুখের ধবল (সাদা) পাথর চোরাই পথে বিক্রি করা। আর চোখে কাঠের চশমা আর কানে শিমুল তুলা দেওয়ার কারণে ভোলাগঞ্জে যে সাদাপাথর আছে, তা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন প্রশাসনের ভোলামনের কর্মকর্তারা। নাটক, সিনেমা বা যাত্রায় সুই-সুতা দিয়ে ‘ভুলো না আমায়’ লেখা রুমাল প্রেমিককে উপহার দিত প্রেমিকার দল। আবার কেউ কেউ নিচে লিখে দিত—ইতি, ‘আত্মভোলা’। যে নিজেই নিজেকে ভুলে আত্মভোলা বনে যায়, সে আবার অন্যকে বলে তাকে না ভোলার জন্য। এটাই ছিল নাটক, যাত্রা ও সিনেমার হাস্যকর অংশ। কিন্তু ভোলাগঞ্জের পাথরগুলো মুখ ফুটে প্রশাসনকে বলতে পারেনি ‘ভুলো না আমায়’। তাই প্রশাসন বেমালুম ভুলে গিয়েছিল যে, সেখানে মূল্যবান সাদাপাথর আছে। দামানরা সব পাথর সরিয়ে ফেলার পর ধু-ধু বালুময় নদীতট যখন বস্ত্রহীন মানবের মতো মিডিয়ার সামনে হাজির হয়, তখনই প্রশাসন হঠাৎ বলে ওঠে হায় হায়, এখন কী করা যায়? ভাগ্য ভালো প্রশাসন বলেনি যে, এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য বা অভিযোগ নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজে কোনো ভুল হলে যে কমান্ড দেওয়া হয়, তা হলো—‘যেমন ছিলে’ (As you were), অর্থাৎ আগের অবস্থানে ফেরত যাও। প্রশাসন এবার সেই কমান্ড দিল। তাই শুরু হয়েছে পাথর অনুসন্ধান। আর তাই শুরু হয়েছে সেই পাথর আগের অবস্থায় বা ‘যেমন ছিলে’ অবস্থায় ফেরত দেওয়ার অভিযান। এতদিন জানা ছিল পাথর সরিয়ে মানুষ করে গুপ্তধনের অনুসন্ধান। এবার দেখছি ধনসম্পদ খরচ করে মানুষ করছে হারিয়ে যাওয়া পাথর অনুসন্ধান। কবি বলেছেন, ‘যেখানে পাইবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই। পাইলেও পাইতে পারো মানিক রতন।’ সাদাপাথরকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড দেখে কবি নিশ্চয়ই লিখতেন—‘যেখানে পাইবে পাথর, ফেরত দিও সময়ের ভেতর, পাইলেও পাইতে পারো প্রশাসনের নেক নজর।’
একসময় ট্রেন, বাস ও লঞ্চে নানা প্রকৃতির হকার বা ক্যানভাসার উঠত। একবার এমন একজনকে পেয়েছিলাম, যে সর্বরোগের ওষুধ দিত। স্বপ্নে পাওয়া এই ওষুধ তার মুর্শিদ কেবলা বিক্রি করতে নিষেধ করেছিলেন। তাই সে ওষুধ দিত কিন্তু বিক্রি করত না। তবে মুর্শিদ কেবলা প্রতিষ্ঠিত এতিমখানার বাচ্চাদের জন্য হাদিয়া সংগ্রহ করত, যার পরিমাণ বেশ ভালোই ছিল। এই ওষুধ খেলে যেসব লোকের উপকার হবে মর্মে নিশ্চয়তা দিত এবং ‘কাজ না করলে আপনার জুতা আমার গাল’ বলে গ্যারান্টি দিত, তার অন্যতম হলো দাঁতের ফাঁকে বা পেটের যে কোনো অংশে কিংবা শরীরের আনাচে-কানাচে যে কোনো ধরনের পাথর থাকলে তা মোমের মতো গলিয়ে মলমূত্রের সঙ্গে বের হয়ে যাবে। সিলেটের বিছনাকান্দির হাজার হাজার টন সাদাপাথর কীভাবে কোথায় গেল এমন প্রশ্নের উত্তর যদি সেখানে কর্মরত পুলিশ, মোতায়েনকৃত সীমান্তরক্ষী বাহিনী, গোয়েন্দা শাখা বা প্রশাসনের কেউই দিতে না পারে, তবে ধরে নিতে হবে দেশে ওই হকার বা ক্যানভাসারের পুনরাবির্ভাব ঘটেছে এবং তাদের কোম্পানির প্রস্তুতকৃত ওষুধ ছিটানোর ফলেই কোম্পানীগঞ্জের সব সাদাপাথর মোমের মতো গলে ধলাই নদীর জলের সঙ্গে মিশে গিয়েছে।
সীমান্তবর্তী এই এলাকার পাথর পাশের দেশে আশ্রয় নেওয়া পলাতক রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা সরকারকে হেয় করতে সীমান্ত অতিক্রমের সময় পকেটে করে নিয়ে যেতে পারেন বলেও ধারণা করা যায়। আবার সরকারবিরোধী আন্দোলন বা পুলিশের হামলা মোকাবিলার কাজে ব্যবহারের জন্য দেশেই ঘাপটি মেরে থাকা কুচক্রী মহল পাথরগুলো নেওয়া এবং ক্রাশিং করে উপযুক্ত সাইজে মজুত করে রাখাও বিচিত্র নয়। এ নিয়ে ঘটনা ঘটার পর জেগে উঠতে অভ্যস্ত গোয়েন্দা শাখা নিশ্চয়ই তৎপর রয়েছে।
রামনায় ধোঁয়ার রাজ্যে বাস করা কবি গালভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে দিয়েছেন আরেক তথ্য। পাথর গায়েব নিঃসন্দেহে কবি, সাহিত্যিক ও গীতিকারদের কাজ। কারণ তারাই তো ছন্দে বর্ণে রচনা করেন ‘আমি পাথরে ফুল ফোটাবো শুধু ভালোবাসা দিয়ে’। আরেকজন তো কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’। সুদর্শন তরুণ শিল্পী গেয়ে ওঠেন, ‘এ মন আমার পাথর তো নয় সব ব্যথা সয়ে যাবে নীরবে’। আরেক নারী শিল্পী অনেক আগেই বলেছেন, ‘শ্বেতপাথরের রাজপ্রাসাদে থেকে আর কী হবে জীবনে তোমায় যদি পেলাম না’। আর পুরুষ শিল্পীর দুশ্চিন্তা, ‘ধরো, কোনো এক শ্বেতপাথরের প্রাসাদে আমার এ গানের পাখি সোনার খাঁচায় বন্দি যদি হয়...’। শিল্প ও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হিসেবে কবি, সাহিত্যিক ও গীতিকারের দল যদি একটি করে সাদাপাথর সংগ্রহ করেন, তবেই তো সিলেটের সব সাদা পাথর হওয়া হওয়ারই কথা। এ সহজ অঙ্কটা বুঝতে বাঙালির কেন এত ব্যথা। শুধু সন্দেহ আর উল্টাপাল্টা কথা যথা-তথা।
অন্যদিকে অনেকের সন্দেহের তীর হস্তরেখাবিদ ও কুদরতি হুজুরদের দিকে। দুনিয়ার সব মুশকিল আসানের জন্য তারা একটি করে পাথর ধরিয়ে দেন। কেউ কেউ আবার কফিলকে (আরব দেশের নিয়োগকর্তা) বশ করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যেও পাথর পাঠান। প্রেমিক বা স্বামী বশীকরণ পাথরের চাহিদা এ দেশে গগনচুম্বী। ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে স্বামীকে পরকীয়া থেকে মুক্ত করতেও পাথরে চাহিদা বেড়েছে। এত পাথরের জোগান দিতে গিয়ে সিলেটের পাথর নিঃশেষ। এ নিয়ে আরও লিখতে গেলে কলমের কালিও হবে শেষ।
একসময় চীনে অনেক অভাব ছিল। হোয়াংহো নদীকে বলা হতো চীনের দুঃখ। প্রতি বছর বন্যার কারণে হোয়াংহো নদীর দুকূল ভেসে যেত বলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত চীনে। তখন পেটের ক্ষুধায় চীনারা সামনে যা পেত, তাই খেত। হোক তা মিষ্টি কিংবা তেতো। পোকামাকড়, জোঁক, সাপ, মাকড়সা, কোনো কিছুই কি আর বাদ যেত? আবার নদীতে ভাসমান নৌকায় থাকা মাঝি বা আরোহীরা কোনো উঁচু জায়গায় নৌকা ভিড়িয়ে খাবার অনুসন্ধান করত। অন্য কোনো খাবার না পেলে তারা ছোট ছোট পাথর বা পাথরের টুকরায় যৎসামান্য লবণ বা অন্যান্য মসলা মিশিয়ে তরকারি বা ভাজি আকারে রান্না করত এবং চুষে চুষে খেত। চীনে এখনো আধুনিক সস ও মসলা দিয়ে পাথর রান্না করে চুষে খাওয়া এবং স্মৃতি হিসেবে সেই পাথর সংরক্ষণের প্রচলন আছে। এমন খাবারের দাম বেশ চড়া বলেই ইউটিউবে তথ্য আছে। বাংলাদেশের মানুষও একই প্রক্রিয়ায় সিলেটের সাদাপাথর খেয়ে ফেলেছে কি না, তাও ভেবে দেখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, সিস্টেম লসের নামে আমরা তিতাসের গ্যাস, পিডিবির বিদ্যুৎ আর ওয়াসার পানি খেয়ে অভ্যস্ত।
পোটন নামের এক প্রাক্তন এমপি পরিবহনের নামে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের সার ট্রাকে বোঝাই করেন এবং পরে আস্ত ট্রাকসহ ৮০ হাজার টন সার খেয়ে ফেলেন, যার বাজার মূল্য প্রায় ১১০ কোটি টাকা (সূত্র: যুগান্তর, ১৪ আগস্ট, ২০২৫)। এর আগে একই পোটন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের ৭১ হাজার ৯১৬ টন ইউরিয়া সার খেয়ে ফেলেন, যার মূল্য ৫৮২ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ঘটে যাওয়া এ ঘটনার পর থেকেই দুদক ও পুলিশ তৎপর। এই পাঁচ বছরে অন্যায় করে অনেকে পিটান (মারধর) খেলেও পোটন ছিলেন অক্ষত। তাকে আটক করার ক্ষেত্রে পাথর নির্মিত দুর্গে ঢুকতে পারেনি কেউ। উত্তরাঞ্চলে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে আহরিত কয়লা প্রাথমিকভাবে রাখা হয় স্থানীয় ইয়ার্ডে। সেখানে ১ লাখ ৩০ হাজার টন কয়লা থাকার কথা থাকলেও পাওয়া যায় মাত্র ১৪ হাজার টনের মতো। কে বা কারা প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের ১ লাখ ১৬ হাজার টন কয়লা খেয়ে ফেলেছেন তা অজানা। (সূত্র: প্রথম আলো, ২৩ জুলাই, ২০১৮)। রসিকজনের মন্তব্য, খনিশ্রমিকরা কয়লা দিয়ে দাঁত মাজার কারণেই এ তারতম্য। দিনাজপুরেরই মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি থেকে আহরিত ৫৫ কোটি টাকা মূল্যের সাড়ে তিন লাখ টন পাথর খেয়ে ফেলেছে ‘মাটি’ নামক দুষ্ট বালক। কারণ কর্তৃপক্ষের দাবি, এই পাথর আপনাআপনি মাটিতে দেবে গেছে। (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন, ৬ আগস্ট, ২০১৮)। বনের গাছ সাবাড় করে ‘বনখেকো’ উপাধি পেয়েছিলেন এককালের প্রধান বন সংরক্ষক ওসমান গনি। এই ওসমান গনির বাসায় ছিল টাকার খনি। অভিযান চালিয়ে চালের ড্রাম, বালিশ ও তোশকের ভেতর থেকে তখন ১ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৬০০ টাকা, ২৯০ ভরি স্বর্ণ, ৪১ লাখ ১১ হাজার ৫০ টাকার সঞ্চয়পত্র পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (সূত্র: জাগোনিউজ ২৪ ডট কম, ২২ জানুয়ারি, ২০১৯)। চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নদীতে শত শত ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকার মালিক হন সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম খান। সেইসঙ্গে পান ‘বালুখেকো’ খেতাব। ৫ আগস্ট ক্ষমতা পরিবর্তনের পর গণপিটুনিতে প্রাণ হারান তিনি ও তার ছেলে (সূত্র: দৈনিক আমার বাংলাদেশ, ৬ আগস্ট, ২০২৪)। সমবায় ব্যাংকে কৃষকদের বন্ধক রাখা ১২ হাজার ভরি স্বর্ণ খেয়ে ফেলেছেন ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ ৯ কর্মকর্তা (সূত্র: যুগান্তর, ১ অক্টোবর, ২০২৪)। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের শুল্ক বিভাগের গুদামের লকারে থাকা প্রায় ৫৫ কেজির বেশি স্বর্ণ খেয়ে ফেলেছে কে বা কারা (সূত্র: প্রথম আলো, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩)।
প্রিয় পাঠক, এবার তাহলে ইতি টানি। খেয়ে ফেলার আগেই লুকাই লেখার কলমখানি। কলমটাই হয়তো গিলে ফেলবে না পেলে কয়লা খনি। সোনা খাচ্ছে, বালু খাচ্ছে, খাচ্ছে আস্ত বন। দেশটাই না খেয়ে ফেলে তারা সুযোগ পাবে যখন।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন