সুন্দর এ পৃথিবীতে সবাই সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকতে চায়। জীবনধারণের তাগিদেই আলো-বাতাসের মতো দরকার সুষম খাবার। আল্লাহ মানুষের শরীর রক্ত-মাংসে পূর্ণ করে দিলেও পেটের কিছু অংশ শূন্য রেখে দিয়েছেন নিজে পূর্ণ করে নেওয়ার জন্য। এর মাধ্যমে পৃথিবীর জীবনে মানুষের পরীক্ষা হয়—কে বৈধ উপায়ে তা পূর্ণ করে আর কে অবৈধ উপায়ে তা পূর্ণ করে; পরকালে সে অনুযায়ী প্রতিদান পাবে মানুষ। বৈধ উপায়ে পেট পূর্ণ করলে জান্নাতে অনন্ত সুখের জীবন, অবৈধ উপায়ে পেট পূর্ণ করলে জাহান্নামের অনন্ত কষ্টের জীবন। পৃথিবীতে আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করার পর, মানুষের পেট পূর্ণ করার জন্যও সৃষ্টি করেছেন কাঁচা-পাকা দুই ধরনের খাদ্য উপাদান। তবে সব খাবারের জোগান দেওয়া একজন মানুষের একার পক্ষে সম্ভব হয় না। মানুষকে খাবার কিনতে হয়। এসব খাবারের মাধ্যমে শরীরে পুষ্টির জোগান হয়। তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, কিছু অসাধু মানুষ আল্লাহর দেওয়া এসব খাবারে ভেজাল মিশিয়ে ধ্বংস করছে মানুষের জীবন। ডেকে আনছে নানা রোগ-ব্যাধিসহ অপমৃত্যু। খাদ্যপণ্যকে আকর্ষণীয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের রং মেশানো, মধুতে কেইন সুগারের ব্যবহার, চাল ও মুড়ি উজ্জ্বল এবং মাছ, মাংস ও সবজির রক্ষণাবেক্ষণে এবং পশুকে মোটা-তাজাকরণে ইউরিয়ার ব্যবহার, পচনরোধে ফলমূল ও শাকসবজি এবং মাছ-মাংসে ফরমালিনের ব্যবহার, ফল পাকানোর কাজে ক্যালসিয়াম কার্বাইডের ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব কেমিক্যাল মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত ও মারাত্মক ক্ষতিকারক। এসব কাজ মুমিন তো করতে পারেই না; মানুষেরই কাজ নয়। ইসলাম এভাবে অর্থ উপার্জন কোনোভাবেই সমর্থন করে না।
মানুষের খাবারে যারা ভেজাল মেশায় তাদের কোনো ইবাদতই কবুল হবে না। কারণ জীবিকা ও উপার্জন হালাল হওয়া ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত। অথচ ভেজাল মেশানো লোকদের উপার্জিত অর্থ হারাম। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘হারাম খাদ্যের মাধ্যমে যে রক্ত-মাংস তৈরি হবে, ওই রক্ত-মাংসের শরীরের মাধ্যমে কৃত কোনো ইবাদত কবুল করা হবে না। যেসব ব্যবসায়ী খাবারে ভেজাল দেয়, ভেজাল মেশায়, ভেজালে সমর্থন দেয়, ভেজাল থেকে উপকৃত হয় তাদের সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় কেয়ামতের দিন ব্যবসায়ীদের মহাপাপীরূপে ওঠানো হবে, তবে যারা সততার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করেছে তারা ছাড়া।’ (তিরমিজি : ১২১০)। ইসলামে এ ধরনের কাজ চরমভাবে নিন্দিত। এতে কয়েক ধরনের অপরাধ জড়িয়ে আছে—এক. এটি প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি। দুই. এটি মূলত অবৈধ পন্থায় অন্যের অর্থ গ্রহণ, যা আত্মসাতের শামিল। তিন. ভেজালমিশ্রিত খাদ্য বিক্রয়ের সময় মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কসম করতে হয়। চার. মানুষকে কষ্ট দেওয়া। পাঁচ. মানুষকে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা। খাদ্যে ভেজাল দেওয়া মানে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করা। প্রতারণা ইসলামে নিষিদ্ধ।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘একদা রাসুল (সা.) বাজারে এক খাদ্য স্তূপের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্য স্তূপের ভেতরে হাত প্রবেশ করিয়ে দেখলেন ভেতরেরগুলো ভেজা। তিনি খাদ্য বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলেন, এটি কেমন কথা? সে বলল, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। তদুত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, তাহলে তুমি খাদ্যগুলো ওপরে রাখোনি কেন, যাতে মানুষ দেখতে পেত? তখন নবীজি আরও বললেন, যে ব্যক্তি প্রতারণা করবে সে আমার উম্মত নয়।’ (মুসলিম : ১০২)
খাবারে ভেজাল মেশানোর ফলে যে অতিরিক্ত অর্থ আসে তা অবৈধ পন্থায় উপার্জিত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অবৈধ পন্থায় অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল বলেন, ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ কোরো না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)
সম্পদ ভক্ষণের ক্ষেত্রে মূলত দুটি মূলনীতি আছে—এক. বস্তুটি স্বয়ং হালাল হতে হবে। যেমন মদ হালাল নয়। দুই. বস্তুটি হালাল হলেও তা উপার্জনের পন্থাটি বৈধ হতে হবে। যেমন আম একটি হালাল বস্তু। কিন্তু কেউ যদি তা চুরি করে সংগ্রহ করে তবে তা অবৈধ হবে। কেননা তার উপার্জনের পন্থাটি বৈধ নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হালাল বস্তুকে পবিত্র বলে এবং অবৈধ পন্থায় উপার্জিত বস্তুকে অপবিত্র বলে আল কোরআনে উল্লেখ করেছেন। বর্ণিত হয়েছে, ‘তাদের জন্য সকল পবিত্র বস্তু হালাল করা হয়েছে এবং সকল অপবিত্র বস্তু হারাম করা হয়েছে।’ (সুরা আরাফ : ১৫৭)
ভেজালযুক্ত খাদ্যের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ অবৈধ ও হারাম। হারাম খাবার পেটে নিয়ে এবং হারাম অর্থ উপার্জন করে কোনো ইবাদত করলে আল্লাহর কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এক হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, “এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলিধূসরিত দেহ নিয়ে আকাশের দিকে দুহাত তুলে ‘হে প্রভু’ বলে দোয়া করে, অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারাই সে পুষ্টি অর্জন করে। তার মোনাজাত কীভাবে কবুল হবে?” (মুসলিম : ১০১৫)
হজরত সাদ (রা.) নবীজির (সা.) কাছে আবেদন করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, যেন আমার দোয়া কবুল হয়। নবীজি (সা.) বললেন, হে সাদ! তোমার উপার্জনকে হালাল রাখো, তোমার দোয়া কবুল হবে। মনে রেখো, কেউ যদি হারাম খাদ্যের এক লোকমাও মুখে নেয় তাহলে চল্লিশ দিন ধরে তার দোয়া কবুল হবে না। (মুজামুল আওসাত)
বৈধ পন্থায় ব্যবসা পরিচালনা করা একটি মহৎ পেশা। তাদের সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেন, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ীরা হাশরের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে উত্থিত হবেন।’ (তিরমিজি : ১২০৯)। কিন্তু যারা খাদ্যে ভেজাল দেবে তারা অসাধু ব্যবসায়ী। তারা মহাপাপী। তাদের সম্পর্কে নবী (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই কেয়ামতের দিন ব্যবসায়ীদের মহাপাপীরূপে ওঠানো হবে। তবে যারা সততার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করেছে তারা ব্যতিরেকে।’ (তিরমিজি : ১২১০)
খাদ্যে ভেজালদানকারী মূলত অন্যের সম্পদ আত্মসাৎকারী এবং বান্দার হক নষ্টকারী। বান্দার হক নষ্ট করার গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ না যার হক নষ্ট করা হয়েছে সে ক্ষমা করবে। একদা নবী (সা.) তার পাশে উপবিষ্ট সাহাবিদের বললেন, তোমরা কি জানো গরিব কে? সাহাবিরা বললেন, আমাদের মধ্যে তো গরিব তাদের বলা হয়, যাদের কাছে ধনসম্পদ, টাকা-পয়সা না থাকে। তখন নবী (সা.) বললেন, প্রকৃতপক্ষে আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে গরিব সে, যে কেয়ামতের দিন নামাজ, রোজা, জাকাত সবকিছু নিয়ে উঠবে, কিন্তু তার এ কর্মগুলো থাকবে যে, সে দুনিয়ায় কারও মন্দ আচরণ করেছে, কারও নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারও সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কাউকে আঘাত করেছে, কাউকে খুন করেছে ইত্যাদি। সেদিন তার সৎকাজ দিয়ে অর্জিত নেকিগুলো দিয়েই হকদারদের হক পরিশোধ করা হবে। যদি তার নেকি শেষ হয়ে যায় তাহলে এ হকদারদের গুনাহ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম)
অতএব যারা খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করবে তাদের নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, দান-সদকা কোনো কাজে আসবে না। খাবারে ভেজাল দেওয়ার অর্থ হলো সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সত্যের সঙ্গে অসত্যের মিশ্রণ ঘটাবে না। জেনেশুনে সত্য গোপন কোরো না।’ (সুরা বাকারা : ৪২)
এ ছাড়া যারা খাদ্যে ভেজাল দেয় তারা অনেক সময় মিথ্যা কসম করে বলে, আল্লাহর কসম, এটি খাঁটি মাল। এভাবে মিথ্যা কসম করে পণ্য বিক্রয়কারী সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তিন ব্যক্তির সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন হলো, যে তার ব্যবসায়িক পণ্য মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রয় করে। (মুসলিম : ১০৬)
অন্যের হক নষ্টকারী সম্পর্কে এক হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার নিজ হাতে কোনো মুসলিমের হক খেয়ে ফেলে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব করে দেন এবং জান্নাত হারাম করে দেন। একজন লোক প্রশ্ন করল, যদি তা সামান্য বস্তু হয়? তখন রাসুল (সা.) বললেন, দেখতে যদি তা আরাক গাছের ডাল পরিমাণও হয় তথাপিও।’ (মুসলিম : ৩৭০)
ভেজালযুক্ত খাবার ক্রয় করে ক্রেতা অনেক কষ্ট পায়। মুসলমানকে শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া কষ্ট দেওয়া হারাম। খাদ্যে ভেজাল শুধু মানুষের মানসিক ও আর্থিক ক্ষতিই করে না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা মানুষের জীবনও নষ্ট করে দেয়। ফরমালিন, কার্বাইড ইত্যাকার বিষাক্ত কেমিক্যালযুক্ত খাবার খেয়ে বিভিন্ন জটিল অসুখে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। গরিবরা টাকার অভাবে সুচিকিৎসা না করতে পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলেও পড়তে পারে। কাজেই যারা খাদ্যে ভেজাল দেয় তারা মানুষের জান ও মালের ক্ষতিকারক। যারা জান ও মালের ক্ষতি করে তারা প্রকৃত মুমিন হতে পারে না। শুধু আইন করে বা শাস্তির ব্যবস্থা করে খাবারে ভেজাল রোধ করা সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার মানুষের নৈতিকতাবোধ এবং পরকালীন জবাবদিহির বোধ জাগ্রত করা। একজন সত্যিকারের মুমিন, একজন সত্যিকারের পরকাল বিশ্বাসী মানুষ খাবারে ভেজাল মেশাতে পারে না, অস্বাস্থ্যকর খাবার দিয়ে মানুষ হত্যায় মেতে উঠতে পারে না।
লেখক : মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ
মন্তব্য করুন