‘দেশের রাজনীতি থেকে শালীনতা-শিষ্টাচার কি উঠে গেল? কেউ আর কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বলে না। যার যা মুখে আসে বলে। ক্রমেই কি আমরা “অসভ্য” জাতি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করতে যাচ্ছি?’ বেতার দূরালাপনী, মানে মোবাইল ফোনে যিনি আমাকে কথাগুলো বললেন, তিনি একজন সাদামাটা ভদ্রলোক। আমার সঙ্গে তার পরিচয় সত্তর দশকের একেবারে শেষপ্রান্তে। বিক্রমপুরের মানুষ। থাকতেন জয়পুরহাটে। নাম জয়নাল আবেদীন ধলু। আমি তখন বর্তমানে লুপ্ত ‘দৈনিক দেশ’-এর জয়পুরহাট মহকুমা প্রতিনিধি। একই এলাকার মানুষ হিসেবে খাতির জমতে সময় লাগেনি। সম্পর্ক গভীর হওয়ার অন্যতম কারণ রাজনীতি সম্বন্ধে তার আগ্রহ ও চমৎকার ধারণা; যদিও তিনি সরাসরি রাজনীতি করেননি । একই সঙ্গে তিনি একজন সমঝদার পত্রিকা পাঠক। তার এ বৈশিষ্ট্যের জন্য আমি তাকে ‘ওস্তাদ’ সম্বোধন করতাম। সন্ধ্যার পর ওস্তাদ-শিষ্য বসতাম সেদিনের পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ খবরের ব্যবচ্ছেদে। কখনো তার মতের সঙ্গে একমত হতাম, কখনো আবার ব্যক্ত করতাম দ্বিমত। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ও সহযোগী জয়নাল আবেদীন ধলু ভাইয়ের সঙ্গে আমার এখনো যোগাযোগ অক্ষুণ্ন আছে। আমার সেই ওস্তাদই ফোন করে ক্ষোভের গোলাবর্ষণ করলেন সেদিন। দীর্ঘ টেলিসংলাপে বললেন, আগে নেতারা চরম বিরোধিতার পরও পরস্পরকে ভদ্রভাবে, সম্মান দিয়ে সমালোচনা করতেন। গালি তো দূরের কথা, শ্রুতিকটু কোনো শব্দবাক্য ব্যবহার করে মন্তব্য করতেন না। আর আজকাল এমনসব ‘হাড়িভণ্ড’ (বিক্রমপুরের আঞ্চলিক শব্দ। এর অর্থ অশ্রাব্য গালাগাল) একজন আরেকজন সম্পর্কে বলে, তাতে কানে আঙুল দিতে হয়। উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি নেটজগতে ভাইরাল হওয়া একজন স্বেচ্ছায় দেশান্তরী ‘সাংবাদিক’ও একজন সাবেক এমপির কনটেন্ট-যুদ্ধের কথা বললেন। ওস্তাদকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করে বললাম, ‘কী করবেন! সব জায়গায়ই তো পচন ধরেছে। যে সময়ে রাজনীতি না করেও সবাই ‘রাজনীতিবিদ’, সাংবাদিকতায় অর্ধদশকের অভিজ্ঞতা না থাকলেও হয়ে যায় ‘বিশিষ্ট সাংবাদিক’; সে সময়ে রাজনীতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে শালীনতা বা শিষ্টাচার খোঁজা দুর্ভিক্ষপীড়িত জনপদে ‘মোগলাইখানা’র জন্য হন্যে হওয়ার শামিল। শিষ্যের যুক্তি মেনে নিয়ে ওস্তাদ তার ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত করে ‘ঠিকই কইছ’ বলে ফোনসেটকে মুক্তি দিলেন। আমিও তার কথাগুলো নিয়ে ভাবতে বসলাম।
বাস্তবিক দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আজকাল যে পরিবেশ বিরাজ করছে, তাতে কোনো ভদ্রলোক আর দেশ ও জনগণের সেবার এ মহান ব্রতে আত্মনিয়োগে উৎসাহী হবেন বলে মনে হয় না। কেননা, যারা প্রকৃত ভদ্রলোক, তারা অন্যপক্ষকে কখনো বস্তির ভাষায় আক্রমণ করে কথা বলতে পারবেন না। অথচ আজকাল অনেকের মুখের ভাষাই বস্তির অশিক্ষিত-মূর্খ ও শিষ্টাচার সম্পর্কে অজ্ঞদের মতো। তাদের ভাষা শুনে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, তারা কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন। কিংবা এটাও মনে হয় না, তারা কোনো ভদ্রপরিবার থেকে উঠে এসেছেন। অনেক দিন আগের কথা। ১৯৭৭ সালে এইচএসসি পাসের পর উচ্চতর শিক্ষার জন্য ঢাকায় আগমন করে ভর্তি হওয়ার আশায় ধরনা দিতে গিয়েছিলাম জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) প্রিন্সিপাল বজলুর রহমান স্যারের কাছে। তিনতলায় স্যারের কক্ষে যাওয়ার আগে সিঁড়ির মাথার দেয়ালে কালো টিনের ওপর সাদা অক্ষরে লেখা একটি বোর্ডের প্রতি নজর আটকে যায় আমার। তাতে লেখা ছিল—‘আমাদের কথাবার্তা ও আচরণই বলে দেবে আমরা কে কোন পরিবেশ থেকে এসেছি।’ বাক্যটির মর্মার্থ কাউকে ব্যাখ্যা করে বলার আবশ্যকতা আছে বলে মনে হয় না। বস্তুত, মানুষ যে পরিবেশে বড় হয়ে ওঠে, পরবর্তী জীবনে তাদের কাজকর্ম, কথাবার্তা, আচার-আচরণে তার প্রতিফলন ঘটবেই।
যে দুজনের ‘কনটেন্ট-যুদ্ধে’র কথা জয়নাল সাহেব বলেছেন, সবাই তাদের চেনেন। একজনকে ইউটিউব-সাংবাদিক হিসেবে, আরেকজনকে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে। একজন একসময় কিছুদিন দেশের একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন, তারপর কোনো এক বিশেষ পরিস্থিতিতে দেশান্তরী হয়ে থিতু হয়েছেন আমেরিকায়। অন্যজন ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করেছেন, তারপর ওয়ান-ইলেভেনের গজবের সময় ২০০৮ সালে ফখরুদ্দীন-মইন ইউর নীল-নকশার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে টিকতে পারেননি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত কাছের মানুষ এক ‘দরবেশে’র বদদোয়ায় দল থেকে বিচ্যুত হয়ে আশ্রয় নেন বিএনপিতে। ২০১৮ সালে নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেলেও জিততে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর এই একনিষ্ঠ সৈনিকের বিদ্যুৎবেগে জিয়ার সৈনিকে রূপান্তরের ঘটনা ছিল সে সময় ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। এখন তিনি বিএনপিতেও সক্রিয় নেই। অবলম্বন করেছেন তার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলকে। যাহোক, এই দুই ‘বিশিষ্ট ব্যক্তি’ যে ভাষ্য়া পরস্পরকে আক্রমণ করে কথা বলেছেন, তা সভ্যতা-ভব্যতার গণ্ডির মধ্যে থাকেনি। তাদের সেসব কথার উদ্ধৃতি এখানে দেব না রুচিবোধের কারণেই। তারা একজন আরেকজনের মা ও স্ত্রীকে নিয়ে যেসব কদর্য মন্তব্য করেছেন, সেসব শব্দবাক্য ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে একা একা উচ্চারণ করাও কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে সম্ভব বলে মনে হয় না। অথচ তারা বলেছেন খোলা মাঠে, মানে ভার্চুয়াল জগতের মতো পাবলিক প্লেসে। এই ‘ভার্চুয়াল যুদ্ধে’ কার ‘একচুয়াল’ জয় হয়েছে, নাকি দুজনই সর্বস্ব হারিয়েছেন; তার পরিমাপ করা আমার দায়িত্ব নয়। তবে গালাগালি, অশ্লীল বাক্যগোলা (অস্ট্রিয়া প্রবাসী সেফাতউল্লাহ সেফুদার ভাষায় ‘শব্দবোমা’) নিক্ষেপ বিবেচনায় তারা ‘উইন-উইন’ অবস্থায় রয়েছেন। এ যেন ‘কেউ কারে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান’। তবে তাদের এ অশ্লীল বাক্যের ভার্চুয়াল মল্লযুদ্ধ দেখে অনেকেই মন্তব্য করেছেন, অস্ট্রিয়া প্রবাসী সেফুদার অবর্তমানে তার শূন্যস্থান পূরণ নিয়ে আমাদের আর দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। তার উত্তরসূরিরা আমাদের অজান্তেই বেড়ে উঠছে দেশ-বিদেশে।
কিন্তু কথা সেটা নয়। কথা হলো শালীনতা-শিষ্টাচারের দুর্ভিক্ষ নিয়ে। একসময় সিনেমায় অশ্লীলতার অভিযোগ ছিল। সিনেমার অশ্লীলতা সাধারণত কাহিনি, সংলাপ, চিত্রায়ণ, নায়ক-নায়িকার পোশাক, নাচ ও অঙ্গভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়ে থাকে। এটা একটা অবক্ষয়। সে অবক্ষয় এখন রাজনীতিতেও সংক্রমিত হয়েছে। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ও রাজনীতিক শফি বিক্রমপুরী একদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আফসোসের বিষয় হলো, যে দুটি ক্ষেত্রে আমি কাজ করেছি, সে দুটি ক্ষেত্রই এখন অবক্ষয়ের শিকার। একটি চলচ্চিত্র, আরেকটি রাজনীতি।’ শফি বিক্রমপুরী সাহেব পরলোকগমন করেছেন বছর দুই হলো। সে অবক্ষয়ের ধারা প্রবল বেগে বহমান। বলা যায় এর সংক্রমণ আরও বেড়েছে।
আগে রাজনৈতিক নেতারা প্রতিপক্ষের সমালোচনা করতেন শালীন ভাষায়, যাতে তার কথায় কারও মান-মর্যাদায় আঘাত না লাগে, কারও সম্মানহানি না হয়। তাই বলে কি কেউ ছেড়ে কথা বলতেন? মোটেই নয়। বাক্যবাণে প্রতিপক্ষকে ঝাঁজরা করে দিলেও তা কারও সম্মানে আঘাত করত না। পারস্পরিক সম্মানবোধের এ সংস্কৃতির কারণেই তখন রাজনীতি ছিল ‘ভদ্রলোকদের’ বিচরণভূমি। মানুষ রাজনীতিকদের সম্মানের চোখে দেখত, শ্রদ্ধা করত। আজ আর সে অবস্থা নেই। পারস্পরিক সহনশীলতা, শ্রদ্ধাবোধ নির্বাসিত হতে বসেছে আমাদের সমাজ ও রাজনীতি থেকে। এখন কেউ কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে চায় না, বলে না। ভদ্রতার সঙ্গে বাকচাতুর্যের প্যাঁচ-কৌশলে নয়, অশ্লীল ভাষায় ল্যাং মেরে প্রতিপক্ষকে ভূপাতিত করতেই যেন আগ্রহী তারা। অন্যকে সম্মান দিলে যে নিজের উচ্চতা বেড়ে যায়, এ কথাটিই কারও মননে মস্তিষ্কে আছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তীব্র বাক্যবাণে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন মরহুম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। তারা শ্লীল-অশ্লীল শব্দসহযোগে এমনসব বাক্যবোমা প্রতিপক্ষের উদ্দেশে নিক্ষেপ করতেন, সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত। বলাবাহুল্য, এজন্য তাদের ঝুড়িতে নিন্দার ফুল কম জমেনি। একসময় ভিন্ন দল করলেও তাদের জীবনাবসান হয়েছে বিএনপি নেতা হিসেবে। তবে বিএনপির অন্য কোনো নেতাকে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে দেখা যায়নি। অবশ্য অতিসম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে গিয়ে শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করে দলের সাংগঠনিক শাস্তির কবলে পড়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান। দলে তার সব পদ তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
প্রতিপক্ষকে অশালীন ভাষায় আক্রমণে অতীব পারঙ্গম যিনি, তার নাম শেখ হাসিনা; বাংলাদেশের পতিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতেন সভ্যতা-ভব্যতার সীমারেখা অতিক্রম করে। এমনকি তার সে তীব্র আক্রমণ থেকে দলের নেতারাও রেহাই পেতেন না। শেখ হাসিনার আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক জিয়াউর রহমান ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে শেখ হাসিনা এমনসব মন্তব্য করেছেন, যা অশালীন তো বটেই, নীতি বিগর্হিতও। তবে এতে শেখ হাসিনার কোনো লাভ হয়নি। বরং দেশবাসীর কাছে তার মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে বেতার ও টেলিভিশনে ভোটে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য প্রচার করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে এমনসব কুরুচিপূর্ণ কথা বলেছিলেন, সারা দেশে ঘৃণার রি রি পড়ে গিয়েছিল। একটি বড় দলের শীর্ষ নেত্রী কীভাবে অমন বিশ্রী ভাষায় কথা বলতে পারেন, তা ছিল সবার কাছে অচিন্তনীয়। শেখ হাসিনার ওই এক ভাষণে আওয়ামী লীগ দশ শতাংশ ভোট হারিয়েছিল বলে জনমনে বদ্ধমূল ধারণা ছিল। তীব্র শ্লেষ আর কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের জন্য সমালোচকরা শেখ হাসিনা জিহ্বাকে ‘বিষলক্ষার ছুরি’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। প্রাচীন গীতিকাব্য ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র মহুয়া বিষলক্ষার ছুরিতে আত্মহত্যা করেছিল। আর শেখ হাসিনাও তার বিষলক্ষা ছুরিসম জিহ্বার দ্বারা নিজের রাজনৈতিক ভাবমূর্তির আত্মহনন ঘটিয়েছেন।
এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, অন্যকে হেয়প্রতিপন্ন করার মানসে অশ্লীল-অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল কখনোই বক্তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে না। বরং তাকে নামিয়ে আনে একই কাতারে। অনেকটা অন্যকে পানিতে চুবাতে নিজেরও কোমর পানিতে নামার মতো। তবে দুঃখজনক হলো, অনেকেই সেটা স্মরণে রাখেন না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
মন্তব্য করুন