ড. আবুল হাসনাত মোহা. শামীম এবং ড. শেখ মনির উদ্দিন জুয়েল
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চারদিক

প্রাকৃতিক বিপর্যয় সতর্কতা ও করণীয়

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপে সৃষ্ট সাম্প্রতিক একটি প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প এবং তা থেকে উদ্ভূত সুনামি সমগ্র বিশ্বের জন্য এক নতুন সতর্কবার্তা নিয়ে এসেছে। ৮.৮ মাত্রার এ শক্তিশালী ভূমিকম্পটি শুধু রাশিয়াকেই নয়, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রায় ৫২টি দেশকে ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।

জাপান, হাওয়াই, চিলি, ইকুয়েডর, পেরু, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যান্য দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে জারি করা হয়েছে সুনামি সতর্কতা। এ ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনো ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। একটি স্থানের বিপর্যয় দূরবর্তী কোনো দেশের পরিবেশ এবং জীবনযাত্রার ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশ সরাসরি প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত না হলে বৈশ্বিক দুর্যোগের এ ধরনের প্রেক্ষাপটে দেশের ভবিষ্যৎ পরিবেশ-পরিস্থিতি, সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং আমাদের করণীয় সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।

যদিও রাশিয়ার ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট সুনামি সরাসরি বাংলাদেশে আঘাত হানার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তবুও এ ঘটনা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভঙ্গুর পরিবেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ রাষ্ট্র, যা মূলত সমুদ্র সমতলের কাছাকাছি অবস্থিত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি; বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। রাশিয়ার মতো দূরবর্তী স্থানে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক একটি দুর্যোগ যখন এতগুলো দেশকে প্রভাবিত করতে পারে, তখন আমাদের নিজেদের জলবায়ুগত ঝুঁকি মোকাবিলায় আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

প্রায় সব দেশেই সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিনিয়ত নানা ধরনের কার্যক্রম চালানো হয়। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিমে সংযুক্ত করা হয় দেশের সব বিভাগ; আন্তঃদেশীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন, উন্নয়ন, পরিবৃদ্ধি করা হয়। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিমূলক ব্যবহারিক জ্ঞানচর্চার যাবতীয় কর্মযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতে থাকে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্ট সব অনুষঙ্গের পারস্পরিক যোগাযোগ সর্বোচ্চ মাত্রায় নেওয়া হয়। তুলনায় বাংলাদেশে বেশ পিছিয়ে আছে বৈকি। নিয়মিত প্রশিক্ষণচর্চা বা জনসংশ্লিষ্টতার খুব বেশি প্রমাণ আমাদের চোখে পড়ে না। কালেভদ্রে বিশেষ করে ঘটনা একটা ঘটে যাওয়ার পর কতক লেখালেখি নজরে আসে। দুঃখ, হতাশা, আফসোস-আস্ফালন আর কথার ফুলঝুরিও ঝরে কোথাও! কিন্তু কাজের কাজ কতটা হয় বা আদৌ হয় কি না, তা বাস্তবে প্রমাণ পেতে অপেক্ষা করতে হবে অগুনতি ক্ষয়ক্ষতির। বহুতল ভবন ধসে পড়া, হেলে পড়া বা আগুন লাগার ঘটনায় আমাদের সামর্থ্য যদিওবা চিহ্নিত, তবুও কতটুকু সচেতন হতে পেরেছি!

জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করছে। এর ফলে বাংলাদেশের সুন্দরবন, কক্সবাজার, পটুয়াখালী এবং খুলনার মতো উপকূলীয় অঞ্চলের এলাকাগুলো ভবিষ্যতে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ফলস্বরূপ লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাবে। কৃষিকাজে চরম প্রতিবন্ধকতা দেখা দেবে। মিঠা পানির উৎস যেমন, তেমনি মারাত্মক প্রভাব ফেলবে জীববৈচিত্র্যের ওপর।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমধারায় এ প্রবণতা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রাশিয়ার মতো একটি বড় ভূমিকম্প যদি প্রশান্ত মহাসাগরের টেকটোনিক প্লেটে এতটা প্রভাব ফেলে, তাহলে যে কোনো স্থানে, বিশেষ করে যেখানে ভূত্বকের পাতগুলো সক্রিয়, সেখানে এমন ঘটনা ঘটলে তার প্রভাব আরও ব্যাপক আকার ধারণ করবে।

বাংলাদেশের অনন্য জীববৈচিত্র্য, বিশেষত সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন এবং এর ওপর নির্ভরশীল প্রাণিকুল জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা এবং ঘন ঘন সাইক্লোনের কারণে এখানকার বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem) অদূর ভবিষ্যতে ভেঙে পড়তে পারে। এতে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ প্রাণী রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

এসব দীর্ঘ ক্ষয়ক্ষতির তালিকায় হ্রাস টানতে জরুরি সচেতনতা, সতর্কতা ও আবেগী মনোভাবের স্ফুরণ। করণীয় নির্ধারণে একদিকে যেমন অভিজ্ঞজনের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে, অন্যদিকে পরিস্থিতি উন্নতির লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরিতে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে।

রাশিয়ার সুনামি সতর্কতা আমাদের শেখায় যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এবং দুর্যোগ-পরবর্তী সময়কার সঠিক প্রস্তুতি এবং সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এমন সুনামি বাংলাদেশের জন্য সরাসরি অতটা বড় হুমকি নয়, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট অন্য সব দুর্যোগের জন্য আমাদের একইভাবে প্রস্তুত থাকা দরকার। সে হিসেবে বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরকে আরও আধুনিক ও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং অন্যান্য দুর্যোগের পূর্বাভাস দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে সাইক্লোন শেল্টার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং বনায়ন কার্যক্রমকে ব্যাপকভাবে জোরদার করতে হবে। দুর্যোগকালীন সময়ে কী কী করণীয় সে বিষয়ে স্থানীয় জনগণকে নিয়মিত প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ, প্রভাব এবং সতর্কতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। স্কুল, কলেজ এবং কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যসব প্রচারমাধ্যমের সাহায্যে মানুষকে দুর্যোগের সময় কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে, সে বিষয়ে নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করতে হবে।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কার্বন নির্গমন কমানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং গাছ লাগানোকে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। সুন্দরবন এবং অন্যান্য বনভূমি রক্ষা করা, নদী দূষণ রোধ করা এবং প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।

পরিবেশগত ঝুঁকি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় গবেষণা ও উদ্ভাবনের ওপর জোর দিতে হবে। নতুন নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে, যা জলবায়ু সহনশীল কৃষি, লবণাক্ততা প্রতিরোধ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করবে। এ ক্ষেত্রে, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

রাশিয়ার ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট সুনামি সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস। মানবজাতিকে প্রকৃতি এবং পরিবেশের সঙ্গে আরও সচেতনভাবে সহাবস্থান করতে হলে এই পূর্বাভাস আমলে নেওয়া জরুরি। বাংলাদেশের মতো একটি ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশের জন্য এটি একটি গুরুতর সতর্কবার্তা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ও সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে এ বিষয়ে এখনই সচেতন হতে হবে, সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং পরিবেশ সুরক্ষায় প্রত্যেককে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। সময় এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনকে একটি জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে গণ্য করার এবং এর মোকাবিলায় সর্বস্তরের মানুষকে একত্রিত করার। সবাই মিলে এ দেশেই বসবাসের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: ড. আবুল হাসনাত মোহা. শামীম: অধ্যাপক, গবেষক ও ট্রেজারার; বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং

ড. শেখ মনির উদ্দিন জুয়েল: সহযোগী অধ্যাপক, শিল্পকলার ইতিহাস, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এস এম ফরহাদের ডাকসু নির্বাচনে বাধা নেই

মাদক সেবন করে মাতাল দুই বন্ধুর ঝগড়া, অতঃপর...

কুড়িলে সড়ক অবরোধ, বন্ধ যান চলাচল  

কিশোরীকে ধর্ষণ : কেয়ারটেকারের আমৃত্যু কারাদণ্ড

মায়ের সম্মাননায় আবেগপ্রবণ তিশা, ভক্তদের জন্য নিয়ে এলেন সুখবর

দুই ম্যাচের জন্য দল ঘোষণা বাংলাদেশের

যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন বন্ধ করে দিলে ইসরায়েলে আগামী দিনে কী হতে পারে?

৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচনে বাধা নেই : আপিল বিভাগ

জামিন চেয়েছেন লতিফ সিদ্দিকীসহ ৭ আসামি, শুনানি বিকেলে

ভারত না আসায় আর্থিক ক্ষতির মুখে বিসিবি

১০

আগস্টে সড়কে ঝরেছে ৫০২ প্রাণ, আহত ১২৩২

১১

চবিতে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু

১২

নিয়মিত বেদানা খাওয়ার ৭ দারুণ উপকারিতা জানালেন পুষ্টিবিদ

১৩

ডাকসু নির্বাচন নির্ধারিত তারিখে আয়োজনের আহ্বান ইউটিএলের 

১৪

৫০ বছর পর বেদখলে থাকা থানার জমি ফেরত পেল পুলিশ

১৫

‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’র ম্যাচে যে একাদশ নিয়ে নামতে পারে বাংলাদেশ

১৬

আবিদ-হামিম-মায়েদ পরিষদের একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি

১৭

স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে সেলিমের কাণ্ড

১৮

কাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন শ্রদ্ধা কাপুর!

১৯

বেড়িবাঁধের পাশে পড়ে ছিল বৃদ্ধের মরদেহ

২০
X