মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৪৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভাতের বিকল্প খাদ্যের ব্যবস্থাপত্র

ভাতের বিকল্প খাদ্যের ব্যবস্থাপত্র

দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের মূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, তা জনজীবনে এক দুঃসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াকে কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে; অর্থনীতির মূলে হেনেছে আঘাত। এর প্রভাব পড়েছে বিশ্বের পণ্যবাজারে। আগামীতে চালসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মূল্যে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কয়েক বছর আগে দেশে চাল ও খাদ্যপণ্যের ব্যাপক উৎপাদনের মূল্য স্থিতিশীল থাকায় জনমনে কিছুটা স্বস্তি এসেছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কখনো অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখা যায়নি। দেশের বৃহত্তম জনগাষ্ঠীর প্রধান খাদ্যশষ্য চাল প্রকারভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৯৫ টাকায়। সরু চালের চেয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মোটা চালের দাম তুলনামূলক বেশি। আটা বর্তমানে কেজিপ্রতি ৫৫-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবরকমের ডালের দামও চড়া। এক লিটার খোলা ভোজ্যতেলের মূল্য ১৮০ ও বোতলজাত তেলের দাম ১৯০ টাকা। চিনি কেজিপ্রতি ১০০-১০৫ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না। মসলার বাজারও গরম। পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৭৫ রসুন কেজি ১৪০ টাকা। ৮০ টাকা কেজির নিচে কোনো সবজি বিক্রি হচ্ছে না। সড়কে সড়কে, পাড়া-মহল্লায় ফেরিওয়ালারা হাঁক ছেড়ে আলু বিক্রিতে নেমে পড়েছেন। বাজারে একমাত্র সস্তা পণ্য হচ্ছে আলু। এখন পাঁচ কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। কিন্তু সস্তা বলে মানুষ কত কিনবে আলু!

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে আলুর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ২৯ লাখ ৯০ হাজার ৬০০ টন। অথচ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ১৩ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ টন। অর্থাৎ, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আলু বেশি উৎপাদিত হয়েছে ১৬ লাখ ৩ হাজার ১০০ টন। আর দেশে আলুর মোট চাহিদা ৯০ থেকে ৯৫ লাখ টন। সেই হিসেবে ৩৪ লাখ ৯০ হাজার ৬০০ থেকে ৩৯ লাখ ৯০ হাজার ৬০০ টন আলু উদ্বৃত্ত রয়েছে। অথচ রপ্তানি এ পর্যন্ত ১ লাখ টনও অতিক্রম করতে পারেনি। এর পেছনে কৃষকের অজ্ঞতা, প্রক্রিয়াজাতকরণে ঘাটতি এবং অতিরিক্ত রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহারকে দায়ী করা হয়।

দেশের একটি শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়। তাদের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। বর্তমান দ্রব্যমূল্য দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকর্তৃক গৃহীত নানা পদক্ষেপ যেন তেমন কাজে আসছে না। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও জিনিসপত্রের দাম বাড়বে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব জিনিসের দাম কমে বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়ে না। বরং কোনো ক্ষেত্রে এর উল্টোটা হয়। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ জানে না। ক্রমাগত পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশের কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হবে। ধনী-দরিদ্রের আয় বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে, যা কোনোমতে কাম্য নয়। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে চালের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভাতপ্রিয় বাঙালি বিপাকে পড়েছেন। কিন্তু দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে ভাতের বদলে আলুর মতো বিকল্প খাদ্য গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি। সে সময়ে আলুর বাম্পার ফলন হওয়ায় কমমূল্যে দীর্ঘ সময় আলু প্রাপ্তির যে সম্ভাবনা ছিল, বাস্তবে তা হয়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ আলু পচে যাওয়ায় এবং অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের মারপ্যাঁচে পড়ে আলুর দাম বেড়ে যায়। ফলে ভাতের বদলে কিছুটা হলেও আলু খাওয়ার বাসনাও মানুষের মনে স্তিমিত হয়ে আসে। হিমাগারে সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় ফি বছর প্রচুর আলু পচে যায়। এভাবে আলুর মূল্যও দীর্ঘদিন স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয় না।

আমাদের দেশে ভাতের বিকল্প খাদ্যের প্রেসক্রিপশন এর আগেও বহুবার এসেছে। কখনো মোটা চালের ভাতের বদলে সরু চালের পোলাও আবার কখনো বাঁধাকপি খাওয়ার পরামর্শ এসেছে। কিন্তু বাস্তবতাবর্জিত এসব পরামর্শ কাজে আসেনি। অবশ্য যে ঋতুতে যেসব খাদ্যপণ্য তুলনামূলক কমদামে বিক্রি হয়, তা বেশি করে গ্রহণ করা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের একটি পদক্ষেপ হতে পারে। এ কথা সত্যি, বছরের বেশ কিছু সময়ের জন্য চালের চেয়ে আলুর দাম বেশ কম থাকে। সে ক্ষেত্রে ভাতের বিকল্প হিসেবে পুরোটা না হোক, অর্ধেক পরিমাণ আলু খেলে ব্যয় সাশ্রয় হতে পারে। দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চালের ওপরও চাপ কমবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই ভাতের বদলে আলু, ইয়াম, কাসাভা খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। সবই মাটির নিচে উৎপাদিত মূলজাতীয় ফসল। এর উৎপাদন ব্যয়ও কম। আফ্রিকার অনেক দেশে ভাতের বদলে নিয়মিত আলুসেদ্ধ খাওয়া হয়। ইউরোপের অনেক দেশেও আলু প্রধান শর্করাজাতীয় খাবার হিসেবে পরিচিত। এক সময় বাঙালি যে রুটিকে ভাতের বিকল্প হিসেবে কোনোক্রমেই মেনে নিতে রাজি ছিল না, সেই রুটি এখন তারা কম করে হলেও একবেলা নিয়মিত খেয়ে থাকেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে যায়, বদলাতে হয়। এজন্য প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। খাদ্যাভ্যাস বদলানো কঠিন কোনো কাজ নয়।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, একমাত্র ভাতই বাঙালির প্রধান খাদ্য হওয়ায় ১৭-১৮ কোটি মানুষের দেশে সবাই দু-তিনবেলা পেট পুরে ভাত খেলে চালের ওপর ভীষণ চাপ পড়ে। দেশে পর্যাপ্ত চাল উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও ভর্তুকি দিয়েও চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে আনা যায় না। আবার চালের দাম বেশি কমে গেলে কৃষকশ্রেণি পড়ে যায় মহাসংকটে। উৎপাদন ব্যয়ও তারা ঘরে তুলতে পারে না। চালের বিক্রয় মূল্য দিয়েই তো দেশের কৃষক সম্প্রদায়কে তাদের জীবনের সব প্রয়োজন মেটাতে হয়। এ ধরনের নাজুক পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মানসিকতা গড়ে তোলা জরুরি। ভাতের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ধীরে ধীরে আলু বা অন্য কোনো ধরনের শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হতে হবে। চালের বিকল্প হিসেবে ভুট্টা, গম ও আলুর বিকল্প ইয়াম, কাসাভার চাষে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। দেশের কৃষক সম্প্রদায়কে এসব কৃষিপণ্যের আবাদে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে। দিতে হবে কৃষিঋণ সহায়তা। বিকল্প খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ব্যয় চালের উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম না হলে মানুষ ভাতের বিকল্প খাদ্য হিসেবে সহজে তা গ্রহণ করবে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, প্রধান খাদ্য হিসেবে দেশের জনগণ ভাত, আলু বা অন্য যা কিছু গ্রহণ করুক না কেন, তা থাকতে হবে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ক্রয়সীমার মধ্যে। আর দেশের আপামর জনগণকে ভাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। যখন চালের চেয়ে আটার দাম কম থাকে তখন ভাতের বদলে আটার রুটি খাওয়া অভ্যেস করতে হবে। ভাতের বিকল্প না হলেও সম্পূরক খাদ্য হিসেবে আলু পেতে পারে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা। আর দেশের কোটি মানুষের জন্য চালসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। দ্রব্যমূল্য রাখতে হবে নিম্নবিত্তের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। মুক্তবাজার অর্থনীতির এ সময়ে সরকারের খাদ্যমজুত বৃদ্ধি ও বাজার মনিটরিং জোরদারসহ নিশ্চিত করতে হবে খাদ্য নিরাপত্তা। বাড়াতে হবে কৃষি উৎপাদন। এ লক্ষ্যে কৃষকের কাছে কমমূল্যে যথাসময়ে পর্যাপ্ত বীজ, সার, কীটনাশক, বিদ্যুৎ ও ডিজেল পৌঁছে দিতে হবে। কৃষকের জন্য কৃষিঋণ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখেই ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মানসিকতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। আজ সুদান, ইথিওপিয়ার মতো আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত নানা দেশে এক টুকরো রুটির জন্য শিশুদের দীর্ঘ লাইন বিশ্বের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের চোখ পানি এনে দেয়। পৃথিবীর অনেক সম্পদশালী দেশেও বিত্তবান মানুষরা অনেক কম খেয়ে সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকেন। আসলে মানুষের জীবনধারণের জন্য খুব একটা বেশি খাবারের প্রয়োজন পড়ে না। কাজেই সময়ের প্রয়োজনে যখন যা সস্তায় পাওয়া যায়, শরীরের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে যতটুকু প্রয়োজন; তা খেয়ে বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত হতে হবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘ধানের শীষ রেকর্ড সংখ্যক ভোটে বিজয়ী হবে’

নাসির গ্রুপে চাকরির সুযোগ, আবেদন করুন আজই

মেঘলা থাকবে ঢাকার আকাশ, কমবে তাপমাত্রা

মঞ্জুরুল ও জ্যোতিকে নিয়ে এবার বিস্ফোরক মন্তব্য আরেক নারী ক্রিকেটারের

জেনে নিন আজকের স্বর্ণের বাজারদর

সন্ত্রাসী ‘বুইস্যার’ সহযোগী ইয়াছিন অস্ত্রসহ ধরা

যে কারণে এসএ টোয়েন্টিতে খেলা হচ্ছে না তাইজুলের

শিগগিরই গাজায় আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন: ট্রাম্প

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধানক্ষেতে টর্চলাইট জ্বালিয়ে সংঘর্ষ, আহত ১৫

যৌন হয়রানির অভিযোগ: সবার প্রতি যে অনুরোধ করলেন মঞ্জুরুল

১০

বায়ুদূষণের শীর্ষ পাঁচে ঢাকা

১১

ওয়ালটনে চাকরির সুযোগ

১২

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ, আবেদন শুরু আজ

১৩

শহীদ জিয়াই জাতির মহানায়ক : মীর হেলাল 

১৪

‘তুমি ছাড়া কোনো নারীকে স্পর্শ করিনি’

১৫

ইরানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের

১৬

মিরপুরে খতমে নবুওয়ত মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত

১৭

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন মারা গেছেন

১৮

টিভিতে আজকের যত খেলা

১৯

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

২০
X