নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রখ্যাত বাঙালি কবি। তিনি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আবির্ভূত আধুনিক বাংলা কবিদের অন্যতম। ‘উলঙ্গ রাজা’ তার অন্যতম বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। এ কাব্যগ্রন্থ লেখার জন্য তিনি ১৯৭৪ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। কবি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সঙ্গে দীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন। নীরেনের জন্ম ১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর। শৈশব কেটেছে পূর্ববঙ্গে ঠাকুরদা আর ঠাকুমার কাছে। কবির ঠাকুরদা কর্মজীবন কাটিয়েছেন কলকাতায়। কর্মজীবন শেষে ৫০ বছর বয়সে কলকাতার পাট চুকিয়ে বাংলাদেশের ফরিদপুরের বাড়ি চান্দ্রা গ্রামে চলে আসেন। তার বাবা কলকাতাতেই ছিলেন। কলকাতার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে তিনি কাজ করতেন। নীরেনের প্রাথমিক লেখাপড়া ফরিদপুরের পাঠশালায়। পরে ঠাকুরদার মৃত্যুর পর ১৯৩০ সালে কলকাতায় চলে যান। কলকাতায় প্রথমে বঙ্গবাসী স্কুল এবং পরে মিত্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। ১৯৪০ সালে ‘প্রবেশিকা পরীক্ষা’য় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪২ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৪৪ সালে সেন্ট পলস কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বিএ পাস করেন। ছাত্রাবস্থায় ‘শ্রীহর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদনা করে সংবাদপত্রের প্রতি তার নিবিড় ও গভীর অনুরাগের সূত্রপাত হয়। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা লেখেন। কিন্তু সেটা কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। ১৬ বছর বয়স থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা লিখে এসেছেন। ১৬ বছর বয়সেই ‘শ্রীহর্ষ’ পত্রিকায় কবিতা লেখার মধ্যে দিয়েই সাহিত্যজগতে তার প্রথম আত্মপ্রকাশ হয়। ‘দৈনিক প্রত্যহ’ পত্রিকায় তার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় সাংবাদিকরূপে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর একে একে ‘মাতৃভূমি’, ‘স্বরাজ’, ‘ভারত’, ‘ইউনাইটেড প্রেস অব ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি পত্রিকায় কাজ করা শুরু করেন। ১৯৫১ সালে যোগ দেন ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায়। দীর্ঘ সময় তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। নীরেন্দ্রনাথের প্রথম কবিতার বই ‘নীল নির্জন’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। এরপর প্রকাশিত হয় তার লেখা ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নীরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘আজ সকালে’সহ অসংখ্য কবিতার বই। সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তার লেখা ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতায় সামন্ততান্ত্রিক জমিদার, জোতদার সমাজ ব্যবস্থাকে তীব্র কটাক্ষের বাণে বিদ্ধ করেন। কবিতার শেষ লাইনে লেখা ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়’ লাইনটি আজও মানুষের মুখে মুখে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একাধিক গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তার সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্রের নাম ভাদুড়ী মশাই। ‘উলঙ্গ রাজা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৭৪ সালে ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ পান। এ ছাড়া একগুচ্ছ পুরস্কার রয়েছে তার ঝুলিতে। ১৯৫৮ সালে ‘উল্টোরথ পুরস্কার’, ১৯৭০ সালে ‘তারাশঙ্কর স্মৃতি’ ও ১৯৭৬ সালে ‘আনন্দ শিরোমণি’ পুরস্কার পান কবি। ২০০৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডি লিট প্রদান করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছিল। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ধ্রুবতারা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তার সৃষ্ট ‘অমলকান্তি’র মতোই যেন রোদ্দুর হয়ে গেলেন। ২০১৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মন্তব্য করুন