নানা অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও শুক্রবার স্বাক্ষর হয়েছে বহুল কাঙ্ক্ষিত জুলাই সনদ। রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বর্ণাঢ্য আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা একে একে এই সনদে স্বাক্ষর করছেন। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এ সনদে স্বাক্ষর করেনি। অনেকেই জানতে চাচ্ছেন, কেন আমরা অংশ নিইনি। এ প্রশ্নের উত্তরটি শুধু রাজনৈতিক অবস্থান বা কৌশলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি মূলত নীতিগত ও প্রক্রিয়াগত এক গভীর অসংগতির মধ্যে নিহিত।
আমরা মনে করি, জুলাই সনদ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবায়নের পথ পরিষ্কার না হলে সনদের স্বাক্ষর কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা হয়েই থাকে। কমিশনের সঙ্গে আমাদের আলোচনার সময় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি সরকারকে প্রস্তাব আকারে দেওয়া হবে। সে সময় সব পক্ষই একমত হয়েছিল যে, একটি ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ’ (July Charter Implementation Order) প্রণয়ন করা হবে। সেই আদেশের অধীনে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।
আমাদের ধারণা ছিল, গণভোটের পর নির্বাচিত সংসদ দ্বৈত দায়িত্ব পালন করবে—একদিকে এটি হবে গঠনমূলক সংসদ (Constituent Parliament), যা সংস্কারমূলক আইন প্রণয়ন করবে; অন্যদিকে এটি নিয়মিত সংসদ হিসেবেও কাজ করবে, যা দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এ ধারণাটি আমরা কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় ভাগাভাগি করেছিলাম এবং প্রথমদিকে মনে হয়েছিল কমিশনও বিষয়টি সমর্থন করছে।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে এক ধরনের অস্পষ্টতা তৈরি হচ্ছে। গণভোটের সময়সূচি, গণভোটে কী প্রশ্ন থাকবে, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা সংরক্ষিত মতামতগুলো কীভাবে বিবেচিত হবে—এসব বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা বা আলোচনা হলো না। আমরা বারবার অনুরোধ করেছি যে, জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার আগে বাস্তবায়ন প্রস্তাবের খসড়াটি যেন আমাদের হাতে দেওয়া হয়। কিন্তু কমিশন তা করেনি।
আমরা এমনকি কমিশনের সঙ্গে একাধিক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে বৈঠকগুলো থেকেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাস্তবায়ন পদ্ধতি, গণভোটের কাঠামো, কিংবা জুলাই আদেশের খসড়া—এসব কিছুই আমাদের হাতে দেওয়া হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের দলের সিদ্ধান্ত ছিল স্পষ্ট—কোনো অস্পষ্ট নথিতে স্বাক্ষর দেওয়া যায় না।
আমাদের এ অবস্থান একেবারে নতুন নয়। জুলাই ঘোষণাপত্রের সময়ও আমরা একবার প্রতারিত হয়েছিলাম। তখন আমাদের দেখানো টেক্সট আর পরে প্রকাশিত ঘোষণাপত্রের টেক্সট এক ছিল না। পরে দেখা যায়, সেই ঘোষণাপত্র একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের দলীয় ঘোষণা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সে অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এবার আরও সতর্ক ছিলাম।
এ ছাড়া আমরা লক্ষ করেছি, জুলাই সনদের টেক্সটেও একাধিকবার পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রাথমিক খসড়ায় উল্লেখ ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান’—যা এ আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাসকে তুলে ধরেছিল। কিন্তু পরবর্তী চূড়ান্ত সংস্করণে সেই বাক্যটি পরিবর্তন করে লেখা হয় ‘ছাত্র-জনতা, শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থান’। আমাদের প্রশ্ন হলো, কেন এ পরিবর্তন? ইতিহাসের বয়ান কে ঠিক করবে? আমরা মনে করি, জনগণের ঐতিহাসিক অবদানকে বিকৃত করা যাবে না।
এ অভিজ্ঞতাগুলোর কারণে আমরা কমিশনের কাছ থেকে চূড়ান্ত টেক্সটটি দেখার সুযোগ চেয়েছিলাম, যাতে ভুল বোঝাবুঝি বা বিকৃতি না ঘটে। কিন্তু কমিশন আমাদের অনুরোধ উপেক্ষা করেছে। ফলে আমরা এই উপসংহারে পৌঁছেছি যে, এবারও যদি চূড়ান্ত নথি না দেখি, তবে আবারও প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
আমরা কমিশন বা সরকারের সঙ্গে বৈরিতা চাই না। বরং আমরা বিশ্বাস করি, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন একটি জাতীয় প্রক্রিয়া হওয়া উচিত, যেখানে সব পক্ষের আস্থা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু যখন প্রক্রিয়াটি অস্বচ্ছ হয়, তখন আস্থার জায়গাটি দুর্বল হয়ে পড়ে। জনগণেরও জানার অধিকার আছে—এ প্রক্রিয়া এখন কোথায় আছে, গণভোটের প্রস্তাব কেমন, সরকারকে কমিশন কী সুপারিশ দিচ্ছে। প্রায় এক বছর ধরে যে প্রক্রিয়াটি চলছে, সেটি এখন এক ধরনের অন্ধকার কক্ষে আলোচনার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিএনপি ও আমাদের মধ্যে মতপার্থক্যের জায়গাটিও এখানেই। বিএনপি বলছে, ‘নোট অব ডিসেন্টে’ যেসব প্রস্তাব আছে, সেগুলো নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু আমরা মনে করি, অনেক ডিসেন্ট নোটেই এমন প্রস্তাব আছে, যা মৌলিক সাংবিধানিক সংস্কারের অংশ—যেমন উচ্চকক্ষের গঠন, সাংবিধানিক পদে নিয়োগ পদ্ধতি, কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো। এগুলো পরবর্তী সরকারের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিলে সংস্কারের অঙ্গীকারই ভেঙে যাবে।
আমাদের অবস্থান স্পষ্ট: এসব মৌলিক সংস্কার গণভোটের মাধ্যমেই অনুমোদিত হওয়া উচিত, যাতে জনগণের প্রত্যক্ষ সম্মতি থাকে। গণভোটের প্রশ্নটা কী হবে, সেটাও এখনো পরিষ্কার নয়। যদি গণভোটের প্রশ্ন এমনভাবে করা হয় যে ‘জুলাই সনদ অনুমোদিত কি না’, তাহলে ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর কার্যকারিতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে শেষ হয়ে যাবে। অথচ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবই সেই নোটে রয়ে গেছে।
আমরা বিশ্বাস করি, জুলাই সনদে স্বাক্ষর মানে কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়; এটি জনগণের প্রতি এক ধরনের নৈতিক দায়বদ্ধতা। তাই আমরা এমন কোনো নথিতে স্বাক্ষর দিতে পারি না, যার ভবিষ্যৎ অজানা।
তবে এটাও স্পষ্ট করে বলতে চাই—আমরা সংলাপের পথ বন্ধ করছি না। কমিশনের মেয়াদ যেহেতু বাড়ানো হয়েছে, আমরা আলোচনা অব্যাহত রাখতে চাই। যদি কমিশন বাস্তবায়ন প্রস্তাব ও জুলাই আদেশের খসড়া আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়, যদি স্বচ্ছতা ও আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়, তাহলে আমরা সহযোগিতার পথেই থাকব।
আমাদের লক্ষ্য বিরোধিতা নয়, বরং একটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক রূপরেখা গড়ে তোলা। কিন্তু সেই পথে হাঁটতে হলে বিশ্বাসের ভিত্তি তৈরি করতে হবে, যা বর্তমানে দুর্বল। আমরা চাই, কমিশন ও সরকার জনগণের সামনে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করুক, জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ কী এবং কীভাবে তা বাস্তবায়িত হবে।
জুলাই সনদ কেবল একটি রাজনৈতিক চুক্তি নয়—এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার এক নতুন দিকনির্দেশ। আমরা চাই এ দিকনির্দেশ বাস্তবায়নের আগে যেন কোনো নতুন বিভ্রান্তি বা প্রতারণা না ঘটে। তাই আপাতত আমরা দূরে থাকলেও, আমাদের উদ্দেশ্য বিরোধিতা নয়—বরং দায়িত্বশীল সতর্কতা।
যেহেতু কমিশনের মেয়াদ আরও বাড়ানো হয়েছে, আমরা কমিশনের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখতে চাই। বাস্তবায়ন পদ্ধতি সরকার যদি আমাদের সঙ্গে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করে এবং জুলাই আদেশ বা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশের যে টেক্সটটি থাকবে, সেটি যদি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করা হয়, তাহলে আলোচনার মাধ্যমে, যেহেতু এখনো সময় আছে, আমরা ভবিষ্যতে কমিশন ও সরকারের সঙ্গে যে কোনো ধরনের সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত আছি।
লেখক: যুগ্ম আহ্বায়ক
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)
মন্তব্য করুন