ইলিয়াস হোসেন
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যে কথা কেউ শোনে না

সম্ভাবনা যেখানে সম্ভব না

সম্ভাবনা যেখানে সম্ভব না

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালে। দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। নতুন স্বপ্ন নতুন আশা নিয়ে যাত্রা করে বাংলাদেশ। কিন্তু শুরুতেই হোঁচট খায় দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রের বাঁকবদলে। নিপীড়িত মানুষের পাশে থেকে দিনের পর দিন নিজেকে বঙ্গবন্ধু হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তিনিই শাসক দল ও সরকারপ্রধান হয়ে ক্ষমতার মোহে জমিদারি আচরণ শুরু করেন। তার কথাই আইন। স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হলেও দলীয় নেতাকর্মী এবং স্বজনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকদের চেয়ে থিয়েটার রোডের গল্পবাজদের সঙ্গ উপভোগ করেন বেশি। খন্দকার মোশতাক আর তাজউদ্দীনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেন অতি আত্মবিশ্বাসের দম্ভে। স্বাধীন দেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বিতর্কিতভাবে। জবরদখল ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একচেটিয়া প্রভাবে নির্বাচনী ইতিহাস শুরু হয় কলঙ্ক দিয়ে। সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, গণতন্ত্রের কবরও রচনা করেন তিনি। মুক্তিকামী জনতার অবিসংবাদিত নেতা হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করলেও, সার্বভৌমত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। সারা দুনিয়ার জন্য এক পররাষ্ট্রনীতি, আর ভারতের জন্য ভিন্ননীতি তাকে সমালোচিত করেছে। রক্তের দাগ শুকানোর আগেই জুলফিকার আলি ভুট্টোকে স্বাধীন বাংলাদেশে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়েও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন শেখ মুজিব। প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব ও জনপ্রিয়তার অহমিকায় রাষ্ট্র পরিচালনায় লেজেগোবরে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। পরিবারসহ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে তিনি তার ভুলের মাশুল গুনেছেন। বাংলাদেশ জুড়ে তার সরব উপস্থিতি মুহূর্তেই বিস্মরণের বিরাণ পাথারে রূপ নেয়। একটি নতুন দেশের সম্ভাবনার গল্প সর্বনাশা বিষাদে ছেয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেনানিবাসে ক্যু-পাল্টা-ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতার পাদপ্রদীপে আসেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান। নিজের ও পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। ৯ মাস যুদ্ধের পর মুক্ত-স্বাধীন দেশে চাকরিতে ফিরে যান জিয়া। সেনানিবাসে উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদের নানারকম পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাঝে তিনি ছিলেন আশ্চর্যরকমের নির্লিপ্ত। অর্পিত দায়িত্ব ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মধ্যবিত্ত সুখী জীবনই ছিল তার ব্রত। কিন্তু ভাগ্যের খেলায় দেশ রক্ষায় তিনি চলে আসেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রথমে সেনাশাসক পরে নির্বাচিত সরকারপ্রধান হয়ে জনগণের সামনে মেলে ধরেন নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। বহুদলীয় গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ-জামায়াতসহ সবাইকে দেন রাজনীতি করার সুযোগ। একপর্যায়ে তিনিও গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। সৎ, মেধাবী ও পরিশ্রমী জিয়া ও তার দল খুব কম সময়েই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ক্ষণজন্মা এ পুরুষ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে এবং বাস্তবায়ন করতে পারতেন। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জনশক্তি-পোশাক শিল্প-নিরাপত্তায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন তিনি। তার জাদুকরী নেতৃত্বে দীর্ঘদিনের ঝানু রাজনীতিবিদরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। শুধু কথামালা নয়, উৎপাদনমুখী রাজনীতি চালু করেন তিনি। কিন্তু কপালের লিখন তো খণ্ডানো যায় না! এত এত ভালো উদ্যোগের মাঝেও তো ভুল হয়ে যায়। সুযোগসন্ধানীরা সে সুযোগ নিতে ওত পেতে বসে থাকে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মতো বিতর্কিত ব্যক্তিকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করাটা বিরাট ভুল ছিল বলে মনে করেন অনেকে। সবাইকে নিয়ে তার দেশ গড়ার উদ্যোগের সমালোচনা করেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। তারা মনে করেন, রাজনীতির সুযোগ পেয়ে আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত তার বিরুদ্ধে কাজ করেছে। আদর্শের দিক দিয়ে দল দুটি বিপরীত মেরুর হলেও জিয়াকে অভিন্ন শত্রু মনে করত। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য জামায়াত আর শেখ মুজিবের পর ক্ষমতা গ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগ জিয়াউর রহমানকে প্রতিপক্ষ মনে করে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত তিনি সামাল দিতে পারেননি। প্রায় ২১টি ক্যু মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। তবে, অসততা-স্বজনপ্রীতি তাকে স্পর্শ করতে পারেনি কখনো। যে কারণে জিয়ার আদর্শকে এখনো সম্ভাবনাময় মনে করা হয়।

সেনানিবাসে ঘাপটি মেরে থাকা ভারতপন্থি কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্রেই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন শহীদ জিয়া। পরবর্তী সময়ে এরশাদ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করায় সে অভিযোগের সত্যতা মেলে। তবে দুঃখের বিষয়, জিয়াবিরোধী অভ্যুত্থানে বিভ্রান্ত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাও ছিলেন। জিয়া সরকার ও তার দলে মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি কয়েকজন স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতিকও স্থান পান। তেল-জল যেমন মেশে না, তাদের মাঝেও সে দূরত্ব কোনো দিন ঘোচেনি। জিয়া হত্যার পর ক্ষমতা হারিয়ে বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে রাজপথে থিতু হয়। জিয়ার আমলে পাইপলাইনে থাকা সম্ভাবনা, প্রতিশ্রুতি হাতিয়ে উন্নয়ন দেখায় এরশাদ। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দিয়ে বিএনপি আর ঘরে ফেরেনি। তবে, এরশাদের কূটকৌশলের কাছে মাঝেমধ্যে বশ্যতা স্বীকার করেছে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত। তা না হলে হয়তো এরশাদ ৯ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারত না। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের আগে একাধিক সম্ভাবনা নষ্ট হয়েছে আওয়ামী লীগের বেইমানির কারণে। পরে অবশ্য তিন জোটের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে এরশাদের পতন হয়। তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী দেশ পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। ‘১০টি আসনের বেশি পাবে না’—শেখ হাসিনার এ ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। রূপরেখা অনুযায়ী সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাসহ বেশ কিছু সংস্কার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয় খালেদা জিয়ার সরকার। এরই মধ্যে, সরকারকে একমুহূর্তের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেবে না বলে ঘোষণা দেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় জামায়াত। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া সম্ভাবনা তিন জোট মিলেই ‘সম্ভব না’ করে দেয়। নূর হোসেন, ডা. মিলন, সেলিম-দীপালি-দেলওয়ার-বসুনিয়া-জগলু-জিহাদসহ অসংখ্য শহীদের রক্ত পানি হয়ে যায়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে প্রথমে প্রশ্নবিদ্ধ; পরে উধাও করে দেওয়া হয়। মাঝে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আনা এক-এগারোর সরকার প্রথম তিন মাস সম্ভাবনা জাগিয়েছিল। পরে তারা স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। সেফ এক্সিটের নিশ্চয়তা আদায় করে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা দিয়ে বিদায় নেয়। ২০০৮ সালের ওই নির্বাচন পাতানো বলে সমালোচনা থাকলেও মেনে নেয় সব দল। কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণের পর নির্বাচনের পুরো ধারণাই পাল্টে দেন শেখ হাসিনা। আজীবন প্রধানমন্ত্রী থাকার বাসনায় রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাকে পথে বসিয়ে দেন তিনি।

দেড় দশক লড়াই-সংগ্রামের পর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ফ্যাসিস্ট সরকারকে পালাতে বাধ্য করে দেশের আপামর জনগণ। শিক্ষার্থী-জনতার এ গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে বিএনপি-জামায়াতসহ ভুক্তভোগী দলগুলো। দেড় সহস্রাধিক শহীদ ও কয়েক হাজার আহত ব্যক্তির আত্মত্যাগে নির্বাসিত গণতন্ত্র ফেরার সম্ভাবনা দেখা দেয় রক্তাক্ত এ জনপদে। ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলো দিন-রাত বৈঠক শুরু করে আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে। দেশ-বিদেশ থেকে উন্নত জীবন ত্যাগ করে অনেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রাণবন্ত করে তোলে। বিশাল সম্ভাবনা দেখা দেয় আকাশে-বাতাসে। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আলাদা আলাদা এজেন্ডা, প্রত্যাশার চাপ বাড়তে থাকে। সরকার এবং অংশীজনরা বারবার ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের কথা বললেও নির্বাচন নিয়ে সংশয় কাটছে না। সাধারণ মানুষ মনে করছে, উপদেষ্টারা আরও অনেক দিন উপদেশ দিতে চান। তারা জনতার উপদেশ শুনতে চান না। ক্ষমতা প্রায় নিশ্চিত মনে করে বিএনপির কিছু নেতাকর্মী আওয়ামী আচরণ করছেন। মওকা পেয়ে জামায়াত এসব প্রচার করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। আন্দোলনে অকুতোভয় শিক্ষার্থীরা মুনশিয়ানা দেখালেও তাদের গড়া দল এনসিপিতে সমন্বয়ের প্রচণ্ড অভাব দেখা যাচ্ছে। তাদের অতিকথন আর রহস্যময় মিত্রের কারণে অবস্থান অস্পষ্ট হচ্ছে। আন্দোলনে বিক্ষুব্ধতা অন্যতম অনুষঙ্গ। কিন্তু রাজনৈতিক চর্চায় বিচক্ষণতা জরুরি। ভয়ভীতি দেখানোর কৌশল সবসময় কাজ করে না। তা ছাড়া, দলে শৃঙ্খলার অভাব ও নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজির অব্যাহত অভিযোগ ভালোভাবে নিচ্ছে না মানুষ। আন্দোলনের গ্রাফিতিই শেষ কথা নয়। প্রতিদিন দেয়াল লিখন পড়তে হয়। আন্দোলন দেখতে দেখতে এবং প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে মানুষ মহাবিরক্ত। সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে। নিয়ন্ত্রণহীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নাজুক অর্থনীতির কারণে হতাশা বাড়ছে। কেউ কেউ এখন এক-এগারোর মতো ভয়ংকর সরকার কামনা করছে। এজন্য আমলা-ব্যবসায়ীদের দায় থাকলেও জাতি রাজনীতিবিদদেরই দুষবে। এটা হলে সব সম্ভাবনা উড়ে যাবে। রক্তে কেনা সম্ভাবনাগুলো সম্ভব করতেই হবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকায় খেলবে আফগানিস্তান, তবে প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ নয়

জোবায়েদ হত্যায় বর্ষাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা 

ইমপোর্ট কুরিয়ার সেকশন থেকে আগুনের সূত্রপাত : বেবিচক চেয়ারম্যান

নির্বাচনে এআই’র অপব্যবহার রোধে সেন্ট্রাল সেল করা হবে : সিইসি

রিজওয়ানের অধিনায়কত্ব হারানোর আসল কারণ ফাঁস!

দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ পিঠ ও কোমরের বিপদ ডেকে আনছে

কুয়াশায় ঢেকে গেছে সড়ক, যানবাহন চলছে হেডলাইট জ্বালিয়ে

বিদেশ থেকে যতটুকু স্বর্ণ আনলে দিতে হবে না শুল্ক

শুভেচ্ছা বার্তায় পরিণীতিকে যা বললেন প্রিয়াঙ্কা

এক মাস আগেই জোবায়েদকে হত্যার পরিকল্পনা করেন বর্ষা

১০

জবি ছাত্র জোবায়েদকে হত্যার পরিকল্পনা করে বর্ষা-মাহীর 

১১

জাপানের ইতিহাসে প্রথমবার নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত

১২

যুক্ত হলো তৃতীয় এয়ারবাস ৩৩০, ইউএস-বাংলার এয়ারক্রাফট বেড়ে ২৫

১৩

সিরিজ জিততে যে একাদশ নিয়ে মাঠে নামতে পারে বাংলাদেশ

১৪

গাজায় দেড়শ টনের বেশি বোমা ফেলেছে ইসরায়েল

১৫

নতুন পে-স্কেল কার্যকর কোন মাসে?

১৬

পিরিয়ডের সময় ঝাল খাওয়া কি ঠিক

১৭

অযত্নে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার ফেরি

১৮

মারা গেছেন কিংবদন্তি অভিনেতা গোবর্ধন আসরানি

১৯

বিচ্ছেদ গুঞ্জনে দেব ও রুক্মিণী

২০
X