

বাংলাদেশের শহুরে জীবনে রাস্তা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, মানুষের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডেরও প্রধান অবলম্বন। কর্মজীবী মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, জরুরি সেবাকর্মী সবার জীবনের স্রোত বয়ে যায় এ সড়কের পথ ধরে। পণ্য পরিবহন, চিকিৎসা সহায়তা কিংবা প্রশাসনিক কাজের সুষ্ঠুতার সবকিছুই নির্ভর করে সুপরিকল্পিত ও নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার ওপর। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, নাগরিক জীবনের প্রাণরেখাটি নানা সংকটের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। দেখে মনে হয় যেন শহর এক অচলাবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
শহরের ফুটপাত বা সড়ক এখন আর শুধু পথচারী বা গাড়ি চলাচলের জন্য নয়; এটি যেন দখলদারিত্বের এক অঘোষিত মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। রাস্তার দুপাশে জমে ওঠা নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ, অবৈধভাবে বসে যাওয়া হাটবাজার, অস্থায়ী দোকানপাট কিংবা রিকশা-ভ্যানের অবাধ দাপট পথচারী ও চালকদের জন্য এক অন্তহীন দুর্ভোগ তৈরি করছে এবং প্রতিদিন তা বাড়ছে। খণ্ডিত ও খানাখন্দে ভরা রাস্তা যখন এমনিতেই চলাচলের অনুপযোগী, তখন তার ওপর এসব অর্বাচীন দখল পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে। অথচ এ দখলদারিত্ব রোধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ কিংবা নিয়মিত নজরদারি চোখে পড়ে না। রাস্তার নিরাপত্তাহীনতা এক ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। শহরের বহু গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতি কিংবা অকার্যকর সিগন্যালের কারণে প্রায়ই বহু যানবাহন চলাচল করে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। উল্টোপথে গাড়ি চালানো, সিগন্যাল ভাঙা, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো—এসব বেপরোয়া আচরণে প্রতিনিয়ত ঘটে দুর্ঘটনা, আহত-নিহতের স্বীকার হন বহু নিরীহ মানুষ। প্রতিদিন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যেন জীবন হাতে নিয়ে রাস্তা পার হয়। অনেক এলাকায় নেই কোনো ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস—ফলে রাস্তা পার হওয়া তাদের জন্য রীতিমতো এক দুঃস্বপ্নের মতো। সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিরাপদ চলাচলের প্রতিশ্রুতি শুধু বক্তৃতা ও নথিপত্রেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে; বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না।
প্রতিনিয়ত বাড়ছে জনসংখ্যা, বহুগুণে বাড়ছে ব্যক্তিগত ও গণপরিবহন; অথচ শহরের সড়ক-পরিসর রয়ে গেছে প্রায় অপরিবর্তিত। সংকীর্ণ সড়কে যখন একসঙ্গে বাস, ট্রাক, রিকশা, সিএনজি, মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করে, তখন জ্যাম ও দুর্ঘটনার সৃষ্টি হওয়া অবধারিত। অনেক এলাকায় সড়কের পাশে অবৈধ পার্কিং ও ফুটপাত দখলের ঘটনা সড়কের কার্যকারিতা আরও কমিয়ে দেয়। জরুরি অবস্থায় বা অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্যোগে ফায়ার এক্সিটের অভাবে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে মর্মান্তিক। উদ্ধারকাজ পরিচালনার মতো পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যায় না। নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, অব্যবস্থাপনা ও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির অভাব শহরের সড়কগুলোকে আজ মারাত্মকভাবে অকার্যকর করে তুলছে, যার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রতিদিনের যন্ত্রণায় তিক্ত-বিরক্ত জনতা। নাভিশ্বাস যেন আজ তার নিজের ওপরই।
শহরের সড়কগুলোতে বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। হাঁটু কিংবা কোমরসমান পানিতে ডুবে যায় অনেক পথ। রাস্তার পাশে উন্মুক্ত-বিপজ্জনক ড্রেনগুলো প্রতিদিনই কারও না কারও জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার শেষ নেই।
এমন পরিস্থিতিতে শুধু সরকারের নয়, নাগরিক সমস্যাগুলো বাস্তবিক সমাধানে কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোরও। সম্প্রতি বিএনপি জনসভায় মনোযোগী না হয়ে বরং নগরীর খাল পরিষ্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। জনদুর্ভোগ না বাড়িয়ে পরিবেশ ও অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করা সব রাজনৈতিক দলের অন্যতম দায়িত্ব হওয়া উচিত। যদি রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিযোগিতার মানসিকতা নিয়ে শুধু ভোটের মাঠে নয়, বরং জনকল্যাণমূলক কাজের ক্ষেত্রেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করে, তাহলে নগরজীবনের বহু সমস্যা সহজেই সমাধান হয়ে যায়। খাল পরিষ্কার, রাস্তা সংস্কার, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ—এসব ক্ষেত্রে দলীয় উদ্যোগ গ্রহণ শুধু নগরবাসীর আস্থা বাড়াবে না, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানোন্নয়নেও বড় ভূমিকা রাখবে। তাই, অন্য দলগুলোরও উচিত হবে এ ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপ থেকে শিক্ষা নিয়ে জনগণের জন্য বাস্তবসম্মত কর্মসূচি হাতে নেওয়া, নাগরিক জীবনে অন্তত কিছুটা হলেও স্বস্তির মুখ দেখানো।
অবৈধ দখলদারিত্বের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা অতি জরুরি। শহরের প্রায় প্রধান সড়ক এবং ফুটপাত হকার, দোকানদার, অবৈধ পার্কিং কিংবা স্থানীয় দখলদারদের কবল থেকে যত দ্রুত মুক্ত করা যায় ততই মঙ্গল। প্রয়োজনে হকারদের জন্য আয়ের ভিন্ন উপায় খুঁজে বের করতে হবে। পথচারীরা তো বাধ্য হয়েই গাড়ির ভিড়ের মধ্যদিয়ে চলাচল করে। এ বিষয়ে নগরবিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট গবেষকদের সমন্বয়ে গবেষণা করতে হবে। সমন্বিত উদ্যোগের বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়ে এ থেকে পরিত্রাণের পথ তৈরি করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ঘিঞ্জি ও চিপা গলির সমস্যাটি ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরের জন্য এক মারাত্মক অভিশাপ। পুরোনো শহরের অলিগলিগুলো এতই সংকীর্ণ যে, জরুরি সেবার গাড়ি যেমন অ্যাম্বুলেন্স বা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সেগুলোতে প্রবেশ করতে পারে না। এর ফলে সামান্য দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ডও সহসাই ভয়াবহ রূপ লাভ করে। শহর পরিকল্পনায় পুরোনো এলাকাগুলো পুনর্গঠন তথা জরুরি বহির্গমন পথ নিশ্চিত করতে হবে। বিলাসিতার বদলে একান্ত প্রয়োজনকে মাথায় রেখে যত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যায়, ততই মঙ্গল।
তৃতীয়ত, নির্মাণসামগ্রী ফেলে রেখে জনপরিসরের বেপরোয়া দখল আর নিরাপত্তাহীনতা; যা শহরের সড়ক-ব্যবস্থাকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলছে। কঠোর নিরাপত্তা বিধি, নিয়মিত পরিদর্শন এবং আইন লঙ্ঘনের জন্য অতি-জরিমানার মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
চতুর্থত, জলাবদ্ধতা ও উন্মুক্ত ড্রেনের সমস্যা কোনো অংশেই কম ভয়াবহ নয়। সামান্য বৃষ্টিতেই শহরের বেশ কিছু সড়ক ডুবে যায়, যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে। এক অঞ্চলের জলাবদ্ধতা পুরো শহরের যোগাযোগে স্থবিরতা ডেকে আনে, ট্রাফিক জ্যামের এ দুর্যোগ এবং দুর্ঘটনার কারণে নগরজীবনের ঝুঁকি প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে। টঙ্গীর মতো ম্যানহোলে পড়ে নারীর মৃত্যুর ঘটনা আর যেন না ঘটে। কার্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলে, উন্মুক্ত ড্রেন ঢেকে দিয়ে এবং নিয়মিত খাল ও জলাশয় পরিষ্কার করে আমাদের প্রাণপ্রিয় নগরীর জীবন বাঁচাতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
পঞ্চমত, ট্রাফিক সিগন্যালের অপর্যাপ্ততা ও সড়ক নিরাপত্তাহীনতা, যা শিশু, নারী ও বয়স্কদের চলাচলকে অত্যন্ত বিপজ্জনক করে তুলছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পর্যাপ্ত সিগন্যাল, জেব্রা ক্রসিং বা ফুট ওভারব্রিজ না থাকায় প্রতিদিন অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে। উন্নত সিগন্যাল ব্যবস্থা, সিসি ক্যামেরা, প্রশিক্ষিত ট্রাফিক পুলিশ এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। রোড-মার্কিংয়ে আরও বেশি যত্নশীল হতে হবে।
শহর পরিকল্পনায় জনগণের নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য এবং স্বস্তিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারের সক্রিয় পদক্ষেপ, প্রশাসনের জবাবদিহি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বয় ছাড়া এ বিপর্যয় থেকে উত্তরণের কোনো উপায় নেই। উন্নত ও নাগরিকবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে পরিকল্পিত সড়কব্যবস্থা, দখলমুক্ত ফুটপাত, নির্মাণকাজের নিরাপত্তা, আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের সমন্বিত প্রয়াস এখন জরুরি প্রয়োজন। পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। ট্রাফিক আইন মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তুলতেই হবে। তবেই আমরা একটি নিরাপদ, গতিশীল এবং আধুনিক নগরজীবনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পারব।
সব মিলিয়ে বলা যায়, দেশের শহরের সড়কব্যবস্থা এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। প্রতিদিনের যাতায়াত মানুষের কাছে যে বিভীষিকা স্বরূপ, তা কোনো আধুনিক নগর জীবনের সঙ্গে মানানসই নয়। এখনই সময় শহর পরিকল্পনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আনার, যেখানে মানুষের নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বস্তি থাকবে মূল অগ্রাধিকার।
সঠিক অর্থাৎ পরিকল্পিত নগরায়ণ, দখলমুক্ত সড়ক, উন্নত ট্রাফিক ব্যবস্থা এবং কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এ দুরবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানোর শুরুটা যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই ভালো। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, সিটি করপোরেশন, নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ নাগরিক—সবার সম্মিলিত প্রয়াসই পারে একটি নিরাপদ, দায়িত্বশীল এবং আধুনিক নগরজীবন গড়ে তুলতে। উন্নয়নের প্রতিটি পরিকল্পনা জনগণকেন্দ্রিক করে তুলতে হবে।
লেখক: ড. আবুল হাসনাত মো. শামীম: অধ্যাপক, গবেষক ও ট্রেজারার, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
ড. শেখ মনির উদ্দিন: সহযোগী অধ্যাপক, শিল্পী ও গবেষক, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন