মাছুম বিল্লাহ
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:১৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষককে কেন বারবার রাস্তায় নামতে হয়

শিক্ষককে কেন বারবার রাস্তায় নামতে হয়

মাধ্যমিকের বেসরকারি শিক্ষকরা টানা দশ দিনের আন্দোলন শেষে মূল বেতনে ১৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়া আদায় করে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গেলেন। এ আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পোষানোর জন্য বার্ষিক পরীক্ষা পর্যন্ত শনিবার ক্লাস নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। এটি ভালো উদ্যোগ! কিন্তু শিক্ষার্থীদের আসলে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কি পোষানো সম্ভব?

শিক্ষকদের অবস্থা নিয়ে যাদের সঠিক চিন্তা করার কথা ছিল, তারা কখনোই তা করেননি। দেশের শিক্ষার বিশাল অংশই চলে বেসরকারি পর্যায়ে। অথচ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বৈষম চরমে। কোনো সরকারই তেমন কোনো পদক্ষেপ কখনো নিতে চায়নি, যখন শিক্ষকরা সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে, ঢাকায় এসে বলপ্রয়োগ করেন, তখনই সবাই একটু নড়েচড়ে বসেন। দেশে এত বছরে এত গণতন্ত্রের দাবিদার সরকার এলো আর গেল কিন্তু কেউই বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য সঠিক কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথম সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের অভিন্ন বেতন স্কেল প্রচলন করলেন ১৯৮০ সালে। সেই ঘোষণায় বহু বছর জিইয়ে রাখা একটি বৈষম্য অন্তত দূর হয়, কিন্তু অনেকটাই বাকি! এরশাদ আমলে শিক্ষা প্রায় জাতীয়করণ হয় হয় অবস্থা, কিন্তু তৎকালীন শিক্ষা সচিব নাকি বাধা দিয়েছিলেন এই বলে, ‘এত বড় চাপ আপনার নেওয়ার কী দরকার।’ পরে সেটি আর হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে সাহস দেখিয়েছিলেন কিন্তু এতে সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি বরং ক্ষেত্রবিশেষে বেড়ে গেছে। প্রথমত, প্রাথমিকে কয়েক ধরনের শিক্ষা বিদ্যামন, সবগুলোকে জাতীয়করণ করা হয়নি বা বাকিগুলোর কী অবস্থা হবে, সে নিয়ে তেমন কোনো কথাও শোনা যায়নি। দ্বিতীয়ত, সব এলাকার অর্থাৎ, গড়পড়তা প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করার দরকার ছিল না। এতে শিক্ষকদের চাকরি সরকারি হয়েছে কিন্তু শিক্ষার মান তলানিতে চলে গেছে। কারণ, প্রাথমিক শিক্ষার এত বড় পরিধি মানসম্পন্নভাবে সামাল দেওয়ার শক্তিশালী মেকানিজম নেই। রাষ্ট্রের পক্ষে এত বড় ব্যবস্থাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না এবং হচ্ছে না। কারা প্রাথমিক শিক্ষার বিশাল বহর পরিচালনা করবে তারও কোনো নির্দিষ্ট প্রেসক্রিপশন ছিল না। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার দায়দায়িত্ব চলে যায় আমলাদের হাতে। সুবিধা যা হওয়ার তাদের হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষার তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। তারপর ২০১৩ সালে হাসিনা সরকার আরও ২৬ হাজার রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করল। এ পদক্ষেপের ফলে একেবারে মানহীন শিক্ষকরা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নাগরিক গড়ার দায়িত্ব পেলেন। ফলে শিক্ষার মান একেবারে তলানিতে চলে এলো। শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু শিক্ষার বারোটা বেজেছে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে গেছে, একই সংসারে অনেক সময় দেখা যায়, বড় বোনকে বাদ দিয়ে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে বড় বোনের বিয়ের বহু সমস্যা হয়। জাতীয়করণের ফলেও সেটিই হয়েছে। মাধ্যমিককে জাতীয়করণ না করে শুধু প্রাথমিককে করায় এখন বহু সমস্যা দেখা দিয়েছে। গোল্লায় যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া! এমনিতেই ক্লাস হয় না। যা হয়, তা ঠিকঠাক হয় না। শিক্ষার্থীদের যা জানার কথা তার ধারেকাছেও তারা নেই। সেই অবস্থায় কদিন পরপর শিক্ষকদের সবকিছু বাদ দিয়ে ঢাকায় আসতে হয়। পুরো জাতি ও পৃথিবীর সামনে উন্মোচন করতে হয় বাংলাদেশের শিক্ষকরা কত অসহায়! আসলে শিক্ষকদের অবস্থা কোথাও ভালো নেই। উন্নত বিশ্বেও শিক্ষকদের সমস্যা আছে, সেটি অন্য ধরনের। আমি নিজে দেখে এসেছি আফ্রিকার দেশগুলোতে শিক্ষকদের কী অবস্থা! রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলগুলো দেখে এসেছি। একটি প্রতিষ্ঠানে একজন অধ্যক্ষ ছাড়া রাষ্ট্র থেকে অন্য কেউ বেতন বা অর্থ সহায়তা পান না। বাকিদের জিজ্ঞেস করলাম সংসার কীভাবে চলে। উত্তরে বললেন, স্কুলের পর অন্য কিছু করতে হয়। পরীক্ষার সময় বছরে এক-দুবার কিছু অর্থ আদায় হয়, তখন কিছু পাওয়া যায়। নিয়মিত মাসিক কোনো বেতন নেই। কারণ, ওই সরকার! তৃতীয় বিশ্বের সব সরকারই এমন। তারা পুলিশ লালনপালন করবে, সেনা লালনপালন করবে, প্রশাসনের লোকজন লালনপালন করবে রাষ্ট্রের সামর্থ্য না থাকলেও বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। কারণ, তারা যে সরকারকে রক্ষা করবেন! কিন্তু শিক্ষকদের বেলায় সবাই নির্বিকার। বেসরকারি শিক্ষকরা বর্তমানে মূল বেতনের শতভাগ রাষ্ট্র থেকে পেয়ে থাকেন। এ পর্যন্ত নিয়ে আসতে তাদের শত শতবার রাস্তার নামতে হয়েছে। কিন্তু এটি কেন?

আমাদের মতো দেশে শিক্ষামন্ত্রীদের আর শিক্ষা প্রশাসনের বড় বড় কর্তার তো ফিতা কাটা ও সিগনেচার করা আর প্রধান অতিধি হলে হবে না, পার্টির নেতা বসালে হবে না; এখানে বসাতে হবে শিক্ষা যারা জানেন, শিক্ষা নিয়ে ভাবেন, শিক্ষা সমস্যা সমাধান করতে পারেন। যারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক। যারা বিদেশের মাটিতে নিজ দেশের গরিব মারা টাকা দিয়ে বাড়ি করেন, তারা এসব মন্ত্রণালয়ে বসে কী করবেন?

শুধু মাধ্যমিক নয়, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত জাতীয়করণ করা প্রয়োজন। তবে গড়পড়তায় সব জাতীয়করণ করার প্রয়োজন নেই। বড় বড় জেলা শহরে ঐতিহ্যবাহী কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোর পড়াশোনার মান ভালো, অর্থসংকট নেই, শিক্ষকদের মানও ভালো। কিছু কমিউনিস্ট দেশে গ্রামে ডাক্তার বা শিক্ষক চাকরি করলে তাদের বেতন দেওয়া হয় দ্বিগুণ। এটি ভালো উদ্যোগ। দেশেও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করা প্রয়োজন। তাহলে গ্রামের শিক্ষার্থীরা ভালো শিক্ষক পাবে আর শিক্ষকরা পাবেন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখতে হবে অসহায়, পিছিয়ে পড়াদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে হোক আর রাষ্ট্রীয় সহায়তার মাধ্যমে হোক, শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ প্রসারিত করা। দ্বিতীয়ত, যারা শিক্ষাদান করবেন তাদের যেন পড়াতে গিয়ে পেটের চিন্তা না করতে হয়। সেটি জাতীয়করণ করে হোক আর যে কোনো বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমেই হোক। তা না হলে শিক্ষার মানোন্নয়নের সুযোগ সংকুচিত হবে।

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক এবং ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইট্যাব) প্রেসিডেন্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকায় বাড়ছে শীত, তাপমাত্রা নামল ১৫ ডিগ্রিতে

ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেটা থুনবার্গ আটক

বিপিএলের ইতিহাসে এর আগে এমনটি কখনোই ঘটেনি

আজ ৫ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

ঘন কুয়াশায় ২ নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ

ভেনেজুয়েলায় মার্কিন অবরোধ সমর্থনকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির আইন পাস

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

২৪ ডিসেম্বর : আজকের নামাজের সময়সূচি

দলীয় কর্মসূচি থেকে ফেরার পথে কৃষক দলের আহ্বায়ক নিহত

মাদারীপুরে তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি গ্রেপ্তার

১০

যশোর-৪ আসনে বাপ-ছেলের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ

১১

গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিন প্রথিতযশা পেলেন গুণীজন সংবর্ধনা

১২

বিমান বিধ্বস্ত হয়ে লিবিয়ার সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা নিহত

১৩

লিবিয়ার সেনাপ্রধানকে বহনকারী বিমান যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

১৪

কাবুলের রাস্তায় একা হাঁটতে পারেন না রশিদ খান

১৫

ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের ‘মাইনরিটি ঐক্যজোট’র আত্মপ্রকাশ

১৬

রাবিতে নির্বাচনে জামাতপন্থিদের ভরাডুবি

১৭

ইবনে সিনায় সাশ্রয়ী খরচে স্বাস্থ্যসেবা পাবেন সিএমজেএফ পরিবার

১৮

জাতীয় নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী গ্রেপ্তার

১৯

জামায়াতে যোগদান করায় বিএনপি নেতা বহিষ্কার

২০
X