

ঢাকা শহর যেন তার নাগরিকদের সঙ্গে এক নীরব যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এ যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছে সেসব নিম্ন ও মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী মানুষ, যারা প্রতিদিন পরিশ্রম করে শহরটিকে সচল রাখে। বাসা ভাড়ার লাগামহীন বৃদ্ধি তাদের জীবনে যে অসহনীয় চাপ তৈরি করেছে, তা এখন আর কোনো ব্যক্তিগত দুর্ভোগ নয়; এটি স্পষ্টতই একটি নগরব্যবস্থার ব্যর্থতা।
রাজধানীর মতিঝিলে অফিস করে বাড্ডায় থাকা সিদ্দিকুর রহমান কিংবা শেওড়াপাড়ায় দুই রুমের বাসায় থাকা আনিসুর রহমানের গল্প আলাদা নয়, বরং একই চিত্রের অসংখ্য প্রতিলিপি। আয়ের অর্ধেকের বেশি বাসা ভাড়ায় চলে যাওয়া, বেতন বাড়লেও জীবনযাত্রার খরচ সামঞ্জস্য না হওয়া, বছরের শেষ মাসে ভাড়া বৃদ্ধির আতঙ্ক, এসব যেন মধ্যবিত্তের জীবনের নতুন স্বাভাবিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের জন্য ঢাকা এখন স্বপ্নের শহর নয়, বরং বেঁচে থাকার সংগ্রামের এক কঠিন প্রান্তর।
অন্যদিকে বাড়িওয়ালাদের যুক্তিও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। বহু মানুষ সারাজীবনের সঞ্চয়, ব্যাংক ঋণ আর দেনা করে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা ভাড়া বাড়ানোর পক্ষে নিজেদের যৌক্তিকতা তুলে ধরছেন। কিন্তু সমস্যাটা এখানেই, দুপক্ষের যুক্তি থাকলেও সমাধানের দায়িত্ব কার এবং কেন দীর্ঘদিন ধরে এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে?
বাংলাদেশে বাসা ভাড়া নিয়ন্ত্রণের আইন থাকলেও তার প্রয়োগ কার্যত শূন্য। ১৯৯১ সালের আইন অনুযায়ী দুই বছরের মধ্যে মূল ভাড়া বাড়ানোর সুযোগ নেই, অথচ বাস্তবে প্রতি বছরই বাসা ভাড়া বাড়ানোকে স্বাভাবিক রীতি হিসেবে দেখা হয়। সিটি করপোরেশন ২০০৭ সালে এলাকাভিত্তিক ভাড়ার হার নির্ধারণ করলেও তা কার্যকর হয়নি। ফলে পরিস্থিতি যে যেখানে পারে সেভাবেই চলছে। এ আইনি শূন্যতা বাড়িওয়ালাদের একতরফা ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে আর ভাড়াটিয়াদের করে তুলেছে ক্রমাগত অসহায়।
এদিকে ঢাকায় জনসংখ্যার চাপও ভাড়া বৃদ্ধির পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৩ হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করে। এ যেন মানুষের নয়, ঘনত্বের বিভীষিকা। আবাসনের চাহিদা বাড়ছে কিন্তু কম আয়ের মানুষের জন্য পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প নেই বললেই চলে। এর ফলে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, যা শেষমেশ ভাড়াটিয়াদের ওপর অর্থনৈতিক বোঝা হিসেবে চাপছে।
সাবলেটের বাড়তি প্রবণতাও এ সংকটের এক সামাজিক প্রতিচ্ছবি। মানুষ এখন নিজেদের বাসার একটি রুম ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছে সংসার চালাতে। এটি স্পষ্ট করে যে, বাসা ভাড়া আর কেবল আবাসন সমস্যা নয়; এটি সামাজিক নিরাপত্তার মৌলিক কাঠামোকেই নড়বড়ে করে দিচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে ডিএনসিসির উদ্যোগে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া আলোচনার টেবিলে বসা নিঃসন্দেহে এক ইতিবাচক পদক্ষেপ। এলাকাভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণ, বার্ষিক ভাড়া বৃদ্ধির সীমা ঠিক করা, আইন প্রয়োগে মনিটরিং ও ভ্রাম্যমাণ আদালত—এসব কঠোরভাবে কার্যকর করতে না পারলে সংকট আরও গভীর হবে।
আমরা মনে করি, ঢাকার বাসা ভাড়া প্রসঙ্গে আর বিলম্ব চলবে না। নগর কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প, ভাড়াটিয়া-বাড়িওয়ালার স্বার্থের ভারসাম্য নিশ্চিত করা এবং কার্যকর আইন প্রয়োগ করতে হবে এখনই। না হলে এ শহরে হাজারো সিদ্দিকুর, আনিসুর, সাজ্জাদের মতো প্রত্যেক পরিশ্রমী নাগরিকের জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠবে আর ঢাকা হবে মানুষের নয়, কেবল পুঁজির শহর। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন একটি মানবিক ও বাসযোগ্য ঢাকা। যেখানে বসবাসের নিরাপত্তা হবে অধিকারের, আতঙ্কের নয়।
মন্তব্য করুন