দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক যে সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা এবং ১৯৫৯ সালে যে শিশু অধিকারের ঘোষণা গৃহীত হয়, তাতে প্রতিটি শিশু শিক্ষা লাভের অধিকার এবং তা যথাযথ বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করা হয়। এ দুটি ঘোষণাতেই প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে শিক্ষাজীবনের শুরু, প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পার হয়ে মাধ্যমিক তারপর উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা। উচ্চশিক্ষা নেওয়ার সামর্থ্য ও সুযোগ সবার জোটে না, আবার কেউ কেউ প্রাথমিক শিক্ষাজীবনের শেষ মুহূর্তে আর্থিক ও পারিবারিক সীমাবদ্ধতার কারণে পড়ালেখা করতে পারে না। শিক্ষা লাভের অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। এ অধিকার প্রতিটি শিশুর ও নাগরিকের জন্য সমভাবে লাভ করার সুযোগ সৃষ্টি এবং এর ক্ষেত্রটা তৈরি করার দায়িত্ব সরকারের। শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের যে অধিকার তা দিতে হবে। এ ধারণাকে সামনে রেখে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে উনিশ শতকের শেষভাগে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে জাপান উনিশ শতকেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভের নানা উদ্যোগ হাতে নেয় এবং তা কার্যকর করে। বুনিয়াদি শিক্ষা একটি দেশের উন্নতি, অগ্রগতির জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন, শুধু প্রতিটি শিশুর মানবিক গুণাবলিকে পরিশুদ্ধ করার ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা নয়। প্রাথমিক শিক্ষা একজন শিশুকে শুধু যোগ-বিয়োগ, ভাষাজ্ঞান নয় বরং শিশুর মানসিক বিকাশ বুদ্ধি-বিচারের ক্ষমতা, মাঠে-ময়দানে, কল-কারখানায় দক্ষ কর্মী বাহিনীতে পরিণত করার ক্ষেত্রেও প্রাথমিক শিক্ষা নানাভাবে সহযোগিতা এবং দক্ষতার জন্ম দেয়। আবার মানুষের উদ্যমশীলতা আনয়ন এবং মৌলিক চাহিদা-পুষ্টি, আশ্রয়, পোশাক, স্বাস্থ্যসেবা এসব কিছু মেটাতেও প্রাথমিক শিক্ষা মানুষকে সহযোগিতা করে। যার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক যে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা হয়, তাতে শিশুকে বাধ্যতামূলক এবং প্রতিটি নাগরিকের অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যার ফলে ১৯৭২ সালে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদে ঘোষণা করা হয়েছে, একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে সমাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ রেখে সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের সুযোগ করবে সরকার।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এ কাজটি করা হয়নি সুন্দরভাবে। সার্বজনীন শিশু শিক্ষার কথা বলা হলেও একই দেশে বসবাসরত একই ভাষাভাষী, স্বাধীন দেশের নাগরিকরা আজ নানামুখী শিশু শিক্ষা গ্রহণ করে বড় হচ্ছে। এতে নানামুখী চিন্তার প্রসারের কারণে দেশে বৈষম্য বাড়ছে, যা কোনোক্রমেই একটি দেশের জন্য শ্রেয় নয়। বর্তমান সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষাকে আধুনিক করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন, সেই অনুযায়ী কিছু কিছু পদক্ষেপও নিয়েছেন। যার পথ ধরে প্রণীত হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯। এটি ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষানীতির আদলে রচিত তবে আধুনিক ও আজকের সময়ের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রণীত শিক্ষানীতি। অতীতে প্রত্যেক সরকার শিক্ষানীতি প্রণয়ের জন্য একটি কমিটি করেছে এবং যথারীতি ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে এর ফল প্রকাশ করেছে, কিন্তু বর্তমান সরকার এমনটি করেনি। শিক্ষা কমিশন করেছেন, তাদের নীতি প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা পদক্ষেপও নিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা হলো শিক্ষার মূল ভিত্তি। একটি উর্বর মাঠ হলো প্রাথমিক স্তর, এখানে যদি সঠিক বীজ বুনতে না পারি তবে কোনো অবস্থাতেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব নয়। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, জিপিএ ৫ প্রাপ্তির এ মহোৎসবের মধ্যেও অধিকাংশ জিপিএ-প্রাপ্ত শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকে উঠতে পারছে না। যার একটি চিত্র গত বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে আমরা লক্ষ করেছি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, জাতীয় কবি নজরুল, আমাদের সাকিব, মাশরাফী, মুহিত কেউ ক্লাসের প্রথম ছাত্র নয় কিন্তু ব্যক্তিজীবনে তারা সফল। এভাবে এ-প্লাস প্রাপ্তির প্রতিযোগিতা থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের বের করে আনতে হবে। পরীক্ষার মধ্য দিয়ে একশ্রেণির সার্টিফিকেট বিলাসী নাগরিক তৈরি ছাড়া আর কিছুই বানানো হচ্ছে না। এ পাগলামি বন্ধ হওয়া খুবই জরুরি। আনন্দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পড়তে দিন, তাদের বেড়ে উঠতে দিন যোগ্য নাগরিক হিসেবে, এ-প্লাস প্রাপ্তি, গাইড ও সাজেশনসনির্ভর অযোগ্য নাগরিক হিসেবে নয়। বিবেক, দক্ষতা, জ্ঞাননির্ভর আগামী প্রজন্ম তৈরির প্রতিযোগিতায় নামতে হবে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের একজন শিক্ষার্থীকে যেভাবে অবৈধ কাজের সঙ্গে আমরা অভিভাবক, শিক্ষক, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, এর ফল কারও জন্য শুভ হবে না, কারও স্বার্থে আসবে না। একদিন এ শিশুরা আমাদের বিবেকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রশ্ন করবে, তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট করার কারণ জানতে চাইবে। সেদিন আমরা কী জবাব তাদের দেব। এ অবস্থার জন্য আমাদের শিক্ষার সার্বিক কাঠামোই দায়ী। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে তৈরি করতে হবে এক নিবিড় সুসম্পর্ক। অন্যথায় মনে রাখবেন, কোনোমতেই আধুনিক শিক্ষার যে চিন্তা, তা ফলপ্রসূ হতে পারে না, হবে না, হয়নি। গুণগত শিক্ষার ধারেকাছেও আজ আমরা নেই, বহুদূরে। আমাদের সবার কাছে এখন প্রতিযোগিতা কত ভাগ পাস ও কতজন জিপিএ ৫। শিক্ষার মানের সঙ্গে ভৌগোলিক অঞ্চল, শিক্ষকের বয়স, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানের দিকটি বিবেচনায় আনতে হবে। ধনী-গরিবের ব্যবধান কমিয়ে এনে শিক্ষার একটি সার্বিক অবস্থা তৈরি করা দরকার। জাতি হিসেবে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় স্থান করার জন্য শিক্ষার চিত্রের মানের পরিবর্তন সর্বাজ্ঞে। প্রত্যেকের ধ্যানে ও মনে-মননে লালন করতে হবে যোগ্য নাগরিক গড়ে তোলার বৃহৎ স্বপ্নটি, অন্যথায় জাতি হিসেবে আরও অসুন্দর সময়ের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। যারা আজকের শিক্ষার্থী, তাদের এভাবে শেষ করবেন না, ওরা আমাদের জাতির স্বপ্নচারী—দেশের শেষ সোনার টুকরো।
লেখক : শিক্ষাবিদ-নজরুল গবেষক
মন্তব্য করুন