যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা কোনোভাবেই ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। বিভিন্ন
ধরনের কারচুপি করে, অন্যায় পন্থা অবলম্বন করে ক্ষমতায় থাকতে চায় বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক, বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল। কালবেলাকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বর্তমান বৈশ্বিক এবং আভ্যন্তরীণ আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক পটভূমির বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা।
কালবেলা: দেশের বর্তমান সময়কে কীভাবে দেখছেন? চলতি প্রেক্ষাপটে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে?
ড. আসিফ নজরুল: আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার একতরফাভাবে নির্বাচন করলেও টিকে থাকা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হবে। দুটি কারণে তারা বাধার সম্মুখীন হবে। একটি হলো বিদেশি অর্থাৎ পশ্চিমা মহলের চাপ, অন্যটি অর্থনৈতিক। সরকারি লোকজনের টাকা-পয়সার অভাব নেই। নিত্যপণ্যের দাম ১০ গুণ বাড়লেও তাদের কিছু আসে যায় না। কিন্তু দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী কষ্টে রয়েছে। তাই আগামী নির্বাচন শুধু গণতন্ত্র রক্ষার জন্য নয়, এটা দেশ রক্ষার নির্বাচন। এই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু না হলে সাধারণ মানুষের জীবনে চরম ভোগান্তি নেমে আসবে, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশি একটি দলের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, টিকে থাকার জন্য সরকার আরও বেশি নিপীড়ন চালাবে। এবারের পরিস্থিতি একটু ভিন্নরকম। আমেরিকা এবং তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলো এবার জোরালোভাবে অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেখতে পাচ্ছি। এটা অবশ্যই একটি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা।
কালবেলা : কয়েক মাস পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। প্রতি পাঁচ বছর পর এরকম সংকট তৈরি হয়। বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক এ সংকট কীভাবে বিশ্লেষণ করেন?
ড. আসিফ নজরুল : এই মুহূর্তে বাংলাদেশ যে সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেটি একটু ভিন্ন আঙ্গিকের। একটি রাজনৈতিক দল সাজানো নির্বাচন করে অনেক বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। এমন সরকার আমরা আগে বাংলাদেশে দেখিনি। আমরা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে দেখেছি। তিনি সাজানো নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু বেশি দিন টিকে থাকতে পারেননি। আমরা খালেদা জিয়ার সরকারকে দেখেছি, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাজানো নির্বাচন করে টিকতে পারেননি। কিন্তু বর্তমান সরকার যেভাবেই হোক, দুটি সাজানো নির্বাচন করে টিকে আছে। এবারের পরিস্থিতিকে আমি একটু ভিন্নরকম বলছি। কারণ ১৫ বছরের মধ্যে এবার আমরা প্রথমবারের মতো দেখতে পাচ্ছি, আমেরিকা এবং তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলো অত্যন্ত নিবিড় ও জোরালোভাবে বাংলাদেশে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা প্রকাশ করছে। তারা অনেকেই বাংলাদেশের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার কথা বলছেন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেখতে পাচ্ছি। যদিও ভিসা নিষেধাজ্ঞাকে পুরোপুরি কোনো নিষেধাজ্ঞা বলা যাবে না; কিন্তু এটা অবশ্যই এক ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা। আর এ নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাকে বাংলাদেশে সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হচ্ছে। সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচনের পথে যারা বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাদের এ ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক ধরনের মুখোমুখি অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সমঝোতার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। যদিও মনে হচ্ছে, আমেরিকার ভিসা নীতি এবং আরও যেসব নিষেধাজ্ঞার কথা আসছে, সেগুলোতে সরকার অনেক বিরক্ত। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো ধরনের নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে না। বিরোধী দলকেও কোনো ধরনের নমনীয়তা প্রদর্শন করতে দেখা যাচ্ছে না। মধ্যবর্তী প্রপোজাল নিয়ে কেউ এগিয়ে আসছে না। সব মিলে মনে হচ্ছে আমরা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এক ধরনের সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
কালবেলা : ১৯৯১ সালের পর থেকে প্রায় প্রতিটা নির্বাচনের আগেই এক ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হতে দেখেছি আমরা। রাজনৈতিক দলগুলো এ সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারছে না কেন?
ড. আসিফ নজরুল : যারা ক্ষমতায় থাকে তারা কোনোভাবেই ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। তারা বিভিন্ন ধরনের কারচুপি করে, বিভিন্ন ধরনের অন্যায় পন্থা অবলম্বন করে ক্ষমতায় থাকতে চায়। আর বিরোধী দলে যারা থাকে তারা স্বভাবতই এটা হতে দিতে রাজি হয় না। রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় যাওয়ার মতো শক্তিমত্তা ও সমর্থন যাদের আছে বলে মনে করে, তারা এই কারচুপি ও অন্যায় পন্থার প্রচণ্ড বিরোধিতা করে। আবার অনেকেই বিরোধিতা করে নৈতিক জায়গা থেকে।
আমি সবসময়ই বলি, যারা ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে তারা একা একা ক্ষমতায় আসতে পারে না। তারা ক্ষমতায় আসে কারও ওপর ভর করে। পুলিশের ওপর ভর করে, জনপ্রশাসনের ওপর ভর করে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ওপরও ভর করে ক্ষমতায় আসে তারা। তাই সরকার জনগণকে খুশি রাখার চেষ্টা না করে শুধু পুলিশ, জনপ্রশাসন ও তাদের পক্ষের ব্যবসায়ীদের খুশি রাখার চেষ্টা করে। একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থই তাদের কাছে প্রাধান্য পায়। আর এ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী যেহেতু সরকারের অবাধ আনুকূল্য পায়, তাই তারা এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত মহলগুলো রাষ্ট্রীয় অর্থ ও সম্পদ লুটপাট করা শুরু করে। জনগণের প্রতি তারা কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা অনুভব করে না।
কালবেলা : টিআইবির একটি জরিপ বলছে, বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৬২ শতাংশ ব্যবসায়ী। রাজনৈতিক সংকটের পেছনে এটি কোনো ভূমিকা রাখছে কি?
ড. আসিফ নজরুল : অবশ্যই দেশকে সংকটে ফেলতে এটা একটা বড় কারণ। এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও লাভজনক ব্যবসা হচ্ছে এমপি হওয়া। এমপি হওয়ার সঙ্গে তারা সরকারি প্রকল্প পায়, ব্যাংক থেকে ইচ্ছেমতো ঋণ তুলে নিতে পারে, বিভিন্ন গণমাধ্যম ও শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত করার অবাধ অনুমতি পাওয়া যায়। তারা নিজের এলাকার জমিদার বনে যান। আর এসব কিছুর কারণ, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নেই। ফলে এখানে এমপি হওয়ার জন্য বিনিয়োগ করতে মানুষ পাগল হয়ে যাচ্ছে।
কালবেলা : এ ক্ষেত্রে সংবিধানের সত্তর অনুচ্ছেদের কোনো ভূমিকা আছে কি?
ড. আসিফ নজরুল : সরকারের বিরোধিতা করলে সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে এটা সম্পূর্ণ একটি ভুল ধারণা। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে আছে, যদি কেউ নিজ দলের সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেয় তখন তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে। সরকারের বিরুদ্ধে যদি কোনো এমপি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সমালোচনা করে, যদি সবচেয়ে কঠোরতম ভাষায়ও সমালোচনা করে তবুও তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে না। ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি আপনি দলের বিপক্ষে ভোট দেন এবং নিজে দল থেকে পদত্যাগ করেন—শুধু এ দুটি কারণেই সদস্য পদ চলে যেতে পারে। এমনকি একজন এমপি যদি সরকারকে সমালোচনা করার কারণে দল তাকে বহিষ্কার করে থাকে তবুও তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে না। শুধু এমপি যদি নিজে দল থেকে পদত্যাগ করেন তখন তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে।
৭০তম অনুচ্ছেদ কারও কথা বলার অধিকার নিয়ন্ত্রণ করেনি। নিয়ন্ত্রণ করেছে ভোট প্রয়োগের ক্ষমতা। আমাদের এমপিরা কথা বলার জন্য সংসদে যান না, তারা যান তোষামোদি করার সুযোগ প্রয়োগ করতে। আপনি যত বেশি প্রধানমন্ত্রীকে তোষামোদি করবেন, আপনি তত বেশি সচিবালয়, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে সুবিধা পাবেন। সব রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকার এবং সরকারি পক্ষের লোককে তোষামোদি করা এবং তাদের স্বার্থ পূরণ করা। তাদের যে কোনো অন্যায় আবদার পূরণ করা। বাংলাদেশ এখন আর রাষ্ট্রের পর্যায়ে নেই। রাষ্ট্র নামক বিশাল এক লুটেরা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আর এসব হয়েছে ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে।
কালবেলা : আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গণতন্ত্রে কোনো ধরনের অনির্বাচিত সরকার থাকার সুযোগ নেই। তাহলে বিএনপি কেন অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছে?
ড. আসিফ নজরুল : গণতন্ত্রে অনির্বাচিত সরকারের সুযোগ নেই বুঝলাম। কিন্তু আমাদের দেশে বড় বড় দুটি পদে যারা নির্বাচিত হন তারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। যেমন রাষ্ট্রপতির কথা বলা যায়। রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন না। তিনি সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশে নারী আসনের এমপিরা নির্বাচিত হন সংসদ সদস্যদের ভোটে বা সংসদ সদস্যদের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সেরকমই ছিল। সব সংসদ সদস্য একসঙ্গে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এ ব্যক্তিরা ক্ষমতায় থাকবেন। অর্থাৎ সেটাও পরোক্ষভাবে নির্বাচিতই হলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জনপ্রতিনিধিদের অর্থাৎ সংসদ সদস্যদের চাওয়ার ভিত্তিতে। এখানে রাষ্ট্রের মধ্যে একটি সামাজিক চুক্তি হয়েছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার কে? আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এ দুটি দল অন্তত বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলই সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেছে। অর্থাৎ জনগণের বৃহত্তম অংশের স্বার্থে যারা কথা বলে, তারাই বলেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা। বিএনপি আমলে যে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়েছে, সেটাও হয়েছে জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। সে সময় আওয়ামী লীগ সরকার বলেছিল—আমরা চিরকালের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে তাদের মনে যদি এতই সন্দেহ আসে তাহলে আমি তাদের একটি চ্যালেঞ্জ দিলাম। তারা একটি গণভোটের আয়োজন করুক তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে। নির্বাচনকালীন সময় মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় কি না, সেটি নিয়ে একটি গণভোট হোক। আমি বিশ্বাস করি, অন্তত দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ বলবে হ্যাঁ, আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে কি না, গণতন্ত্রের ভিত্তিতে কি না তারা এসব প্রশ্ন তুলছেন। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, আগের রাতে যারা নির্বাচন করেন তারাই এ প্রশ্ন তুলছেন!
আপনাকে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে হাইকোর্টে যখন চ্যালেঞ্জ হয়েছে তখন হাইকোর্টের মেজরিটি বিচারক দুবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছে। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইন বিশেষজ্ঞ যারা ছিলেন, যাদের আন্ডারে বিভিন্ন বিচারপতিরা জুনিয়র হিসেবে কাজ করতেন (আমি ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক সাহেবের কথা বলছি। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রধান বিচারপতি এবং বিচারপতি তাদের জুনিয়র ছিল, তারা এত বড় পর্যায়ের আইনজীবী)। তাদের আটজনের মধ্যে সাতজনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে তারা সুস্পষ্ট মত ব্যক্ত করেছেন। এমনকি আপিল ডিভিশনেও মাত্র একজন বেশি বিচারক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করতে বলেছিলেন। হাইকোর্টের সব বিচারপতির রায়ে বেশিরভাগ বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বলেছেন। দেশের সবচেয়ে বড় বড় আইন বিশেষজ্ঞ যারা রয়েছেন, যারা সংবিধান বোঝেন, আমার আপনার থেকে বেশি আইন বোঝেন, যারা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সাংবিধানিক আইনজীবী, তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশ বলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বৈধ।
কালবেলা : এবারের নির্বাচন কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এ ভিসা নীতির কারণে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে মনে করেন কি?
ড. আসিফ নজরুল : ভিসা নীতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কতটা প্রভাব ফেলবে সেটা জানি না, তবে এটা এরই মধ্যে কতটুকু প্রভাব রেখেছে সেটা বলতে পারি। বিএনপি এখন বড় বড় সভা করতে পারছে, মানুষ আগের চেয়ে একটু বেশি সাহস করে কথা বলতে পারছে। আমরা পুলিশ বাহিনীর নির্যাতন ও নিপীড়ন কিছুটা কম দেখতে পাচ্ছি। এটাই ভিসা নীতির ইম্প্যাক্ট। যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি প্রয়োগ করার আগে এ অবস্থা ছিল না। এর আগে র্যাবের ওপর স্যাংশন দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই স্যাংশনের আগে বাংলাদেশে কতগুলো গুম হয়েছে এবং স্যাংশনের পরে বাংলাদেশে কতগুলো গুম হয়েছে? এটা কম্পেয়ার করলে দেখা যাবে, গুমের সংখ্যা ১০ ভাগের ৯ ভাগই কমে গেছে। অর্থাৎ স্যাংশন কাজ করেছে। এ ভিসা নীতিও এক ধরনের স্যাংশন। কারও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এক ধরনের পদ্ধতি হলো স্যাংশন। ভিসা নীতি একটা শ্রেণির আচরণ নিয়ন্ত্রণ করছে। কারণ এ রাষ্ট্রের বড় বড় পর্যায়ে এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যারা রয়েছেন, তারা তাদের পরিবার নিয়ে আমেরিকায় থাকেন অথবা সেখানে পুঁজি পাচার করেছেন। অনেকের সন্তান আমেরিকাতে পড়াশোনা করে অথবা পড়াশোনা করবে। আমেরিকা, কানাডা অথবা ইউরোপ বাদ দিয়ে তারা তাদের কোনো কিছুই চিন্তা করতে পারেন না। তাদের ঠিকানা শুধু বাংলাদেশ নয়। তাদের ঠিকানা বাংলাদেশ এবং আমেরিকা, অথবা বাংলাদেশ এবং কানাডা। তাদের পরিবারের বেশিরভাগই থাকে বিদেশে। সুতরাং তার স্বার্থ তো ওই দেশের সঙ্গেই সম্পর্কিত।
সুতরাং ওই দেশ যখন ভিসা রেস্ট্রিকশন দেয় তখন সেটা তার জন্য এক ধরনের বিরাট স্যাংশনের মতো হয়ে দাঁড়ায়। ফলে এটা কিছুটা হলেও তাদের এক্সটার্নাল বিহেভিয়ারকে কন্ট্রোল করবে। আজকে সমাবেশের বা মতপ্রকাশের যতটুকু স্পেস তৈরি হয়েছে, এটা যদি বিরোধী দল ঠিকমতো ইউটিলাইজ করতে পারে, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা অনেক বাড়বে।
কালবেলা : মার্কিন ভিসা নীতি গণমাধ্যমের ওপরও প্রয়োগ করা হবে বলে বলা হচ্ছে। এই বিষয়ে আপনি কী মন্তব্য করবেন?
ড. আসিফ নজরুল : আমি মনেপ্রাণে গণমাধ্যমের লোক। আমার প্রথম পেশা সাংবাদিকতা। আমি সবসময় কলাম লিখি, টক শোতে যাই, সাংবাদিকদের সঙ্গে ওঠাবসা করি। আমি মনে করি, বাংলাদেশের অধিকাংশ সময়ে গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গণমাধ্যম বর্তমানে এই প্রশংসনীয় ভূমিকা বজায় রাখতে পারছে না সরকারের বিভিন্ন চাপের কারণে, গণমাধ্যমের একটি অংশের সরকারের লেজুড়বৃত্তির কারণে এবং তাদের স্বার্থপর ভূমিকার কারণে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমেরই কিছু লোক দাঁড়িয়ে গেছে। তারা ডেইলি স্টারের মতো পত্রিকার সম্পাদককে পদত্যাগ করতে বলে। তারা প্রথম আলোর মতো পত্রিকাকে বন্ধ করে দিতে চায়। অতীতে তারা সরকারবিরোধী মহলের সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলো বন্ধে সমর্থন দিয়েছে। গণমাধ্যমকর্মী নামধারী এ লোকগুলো গণমাধ্যমের শত্রু, গণতন্ত্রেরও শত্রু। কারণ গণতন্ত্র পাহারা দেওয়ার জন্য সরকার পছন্দ করে না এ ধরনের গণমাধ্যমের প্রয়োজন রয়েছে। সরকার পছন্দ করে না এ ধরনের গণমাধ্যম বন্ধের ক্ষেত্রে যাদের ভূমিকা আছে, তারা গণতন্ত্রের শত্রু। যেসব পত্রিকা বা মিডিয়া আউটলেট সরকারি লেজুড়বৃত্তি করে না, তাদের বিরুদ্ধে তারা নিরন্তরভাবে কথা বলে যাচ্ছে, প্রকাশ্যে বিবৃতিও দিয়েছে। তারা সাংবাদিক নামধারী এবং তারাই স্বাধীন সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় শত্রু। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যারা শত্রু তারা অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনেরও শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সেটা দেশের জন্য ভালো, দেশের গণতন্ত্রের জন্য ভালো এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য ভালো।
কালবেলা : নির্বাচন সামনে রেখে নতুন দল গঠন হচ্ছে। এটি কোনো বার্তা বহন করে কি?
ড. আসিফ নজরুল : আমি মনে করি আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচনে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। সরকার গত ১৫ বছরে এত বেশি বড় বড় অন্যায় করেছে যে, তারা কোনোভাবেই ক্ষমতা ছাড়তে রাজি নয়। তারা কোনোভাবেই জনগণের রায়ের সামনে দাঁড়াতে রাজি না। আমার ধারণা, তারা মোটামুটি নিশ্চিত যে, তারা নির্বাচনে হারবে। তারা জানে তারা কী কী অন্যায় করেছে। তারা জানে নির্বাচনে হারলে তাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। ফলে নির্বাচন শুধু তাদের কাছে নির্বাচন নয়, তাদের কাছে নির্বাচন মানে নিজের কৃতকর্মের সম্মুখীন হওয়া। সেই নির্বাচন কে চায়? তারা যে কোনোভাবেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন করার চেষ্টা করবে। এখানে কিছু সুবিধাবাদী দল গজাবে যারা দেশকে ভালোবাসে না, দেশের মানুষের স্বার্থ দেখে না। তারা বড় বড় কথা বলা শুরু করবে। তাদের মানুষ চেনে। তারা পরগাছা। আর এই পরগাছারা নির্বাচন সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখে না। তারা নির্বাচন সুষ্ঠু দেখানোর ক্ষেত্রে সামান্য ভূমিকা রাখে। তারা বড় কোনো সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে এসব পরগাছা দলের নেপথ্য জন্মদাতারা।
শ্রুতলিখন : মুজাহিদুল ইসলাম