নির্বাচন করা না করা, প্রার্থিতা চাওয়া না চাওয়ার অধিকার অবশ্যই আছে ক্ষমতাসীন দলের বহুল আলোচিত নেতা নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমানের। তাকে যেন নমিনেশন দেওয়া না হয়, সেজন্য প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রকাশ্য জনসভায়। এ ক্ষেত্রে নমিনেশন পাওয়া, না পাওয়ার বিষয় আছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে নিজেকে আলোচিত বা ভাইরাল হওয়ার অধিকার কদ্দুর আছে তার বা অন্য নেতা-মন্ত্রীদের? তিনি এও বলেছেন, ‘যারা এখন নির্বাচন নিয়ে চিন্তিত, তারা আওয়ামী লীগ করার যোগ্যতা রাখে না।’
কী বললেন তিনি? কাকে কী বোঝালেন? বলতে বলতে এও বলেছেন, আর খেলা নয়, এবার হবে ফাটাফাটি। এর আগে সবসময় অজু-গোসলে পবিত্র থাকা, তসবিহ পড়া, ৭০ রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ার মতো নানা বায়বীয় কথায় ভাইরাল এ মাননীয়র বিশেষ বিশেষত্ব হচ্ছে, সবকিছুতে প্রধানমন্ত্রীকে কোনো না কোনোভাবে কোট করা। এতে তিনি তার গুরুত্ব তৈরিতে কামিয়াবি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ইমেজের কী দশা করে ছাড়ছেন। এখন যে সামনে ফাটাফাটি হবে, তা কি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে বলেছেন? নাকি এতে প্রধানমন্ত্রীর সায় ছিল বা আছে? তেমন কোনো গল্প যদি বানিয়ে আবার ভাইরাল হন তিনি?
চন্দ্রবিন্দু দিয়ে তাদের সম্বোধন করতে হয়। তারা মান্যবর। নামের পূর্বাপরে বলতে হয় মাননীয়, মহোদয়, মহাশয়সহ কত কিছু। এটা তাদের সাংবিধানিক প্রিভিলেজ। নিজ নিজ এলাকায় তারা শুধু মাননীয়, মহোদয় নন; মহামান্যের মতো। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, তত বেপরোয়া এ মান্যবররা। জনগণ মনে মনে যাই ভাবুক, জনগণকে ঠিকই নানা উদামকাণ্ড মেনে নিতে বাধ্য করে ছাড়ছেন তারা। যেখানে যার মন যা চায় করছেন, বলছেন। এর মধ্য দিয়ে নিজেরা ফ্রিস্টাইলে উদাম বা দিগম্বর হচ্ছেন। আর সরকারকে ফেলছেন মোটা দাগের প্রশ্নের মুখে। জনগণকে তোয়াক্কা না করতে করতে এখন আর সরকারকেও তোয়াক্কার দরকার মনে করে না তারা। যেন ধরেই নিয়েছেন, সরকার বা দলের শীর্ষ পর্যায় এখন আর তাদের কিছু করবে না বা করতে পারবে না। কদিন বাদেই নির্বাচন, সরকারও নানা ঝামেলায়। তাই তাদের বিরুদ্ধে কেন অ্যাকশনের সময়-সুযোগ-বাস্তবতা নেই সরকারের। তাই তারা যা ইচ্ছা বলবেন, করবেন, কাণ্ড ঘটাবেন! রাজধানী লাগোয়া নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান, মানিকগঞ্জের মমতাজ বেগম থেকে শুরু করে টাঙ্গাইলের বড় মনির-ছোট মনির কে বাদ থাকছেন কাণ্ডকীর্তিতে? তারা দেশকে-সরকারকে পেয়ে বসেছেন; নাকি তাদেরই কোনো আসরে পেয়েছে, কে জানে। কিছুদিন সরকারকে সমানে ডোবানোর কাজে জি কে শামীম, সম্রাট, সাবরিনা, পাপিয়া, খালেদ, সাহেদ, শোভন-রাব্বানীরা যারপরনাই অবদান রেখেছেন। আনিসুর রহমান, মমিনুল হক সাঈদ, মোল্লা কাউছাররাও কম করেননি। পঙ্কজ দেবনাথ ছাড়া তখন পর্যন্ত মন্ত্রী-এমপিদের নাম আসেনি। পরে দেখা যায়, তাদের নেপথ্য মদদদাতা কয়েক এমপি ও মন্ত্রী। পরে নানান ঘটনায় আলোচনায় আসতে থাকেন চট্টগ্রামের শামসুল হক চৌধুরী, ফেনীর নিজাম হাজারী, সুনামগঞ্জের মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, ভোলার নুরুন্নবী শাওন, নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজারের নজরুল ইসলাম বাবুসহ কয়েকজন। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও বাদ গেলেন না। প্রকল্প পাসের আগেই সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড-ইডিসিএল কারখানার জন্য ৩১ একর জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তার আত্মীয়স্বজনরা ঘটালেন অরুচিকর কাণ্ডকীর্তি। ওই জমি অন্যের নামে হস্তান্তর ও মূল্যবৃদ্ধির কার্যক্রমে লিপ্ত হওয়ার খবর ফাঁস হয় নিজেদের মধ্যে ভেজাল হওয়ার কারণে। চাঁদপুরে নদী দখল এবং চড়া দামে বিকিকিনিতে শিক্ষামন্ত্রীর জড়িত থাকার খবর ফাঁসের নেপথ্যও অনেকটা তেমনই। তার ভাই জেলা আওয়ামী লীগ নেতা জাওয়াদুর রহিম টিপুসহ বেশ কয়েক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ভুয়া দলিলের মাধ্যমে ৪৮ একরের বেশি খাসজমি দখলের কাণ্ড এ সময়ের জন্য সরকারকে শুধু বিব্রতকর নয়, রীতিমতো আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর মতো। শিক্ষামন্ত্রীর ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা সেই ডিসি অঞ্জনা খান মজলিসকে বদলিও হতে হয়েছে।
সরকারকে পোহাতে হচ্ছে এ ধরনের আরও যন্ত্রণা। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী শাহাবউদ্দিন কর্তৃক মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় দুবাই থেকে অবৈধভাবে আনা সোনা উদ্ধারে পুলিশকে দিয়ে এক যুবককে ধরে থানায় এনে পেটানোর ক্ষেত্রে সোনা চোরাকারবারি চক্রের নেতাকে সহায়তার অভিযোগের দায় নেওয়া যেন সরকারের নিয়তি। সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামানও কম যাননি। এ মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে ভুয়া রোগী বানিয়ে জটিল ছয় রোগের চিকিৎসা সহায়তার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাতের সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। সরকারের শেষ সময়ে এসে মহাশয়দের এ ধরনের কদাকার কাণ্ডকারখানার খবর ফাঁস হচ্ছে একের পর এক। সরকারের একেকটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দৈনন্দিন পরিচালনা ও উন্নয়ন প্রকল্প বাবদ প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে জনগণের করের টাকার সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং চুরি-দুর্নীতি প্রতিহত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর। অভিযোগ উঠলেই সেটাকে শতভাগ সত্য বলে ধরে নেওয়া যায় না। আবার অভিযোগ ওঠার পর বিশ্বাসযোগ্য ও নিরপেক্ষ তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত অভিযোগ থেকে দায়মুক্তিও পাওয়া যায় না। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মন্ত্রী-এমপিরা সব ধরনের আইনকানুন ও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকছেন। সরকারের যেন দায়িত্ব হয়ে পড়ে মাননীয়দের প্রোটেকশন দেওয়া, বা সরকারকে তা দিতে বাধ্য করেন তারা। যার জেরে দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে পিছু হটতে হয় না। দলের কোনো এমপি বা মন্ত্রীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের রেশ না কাটতেই অন্য একজন একই ধরনের ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন। গত মাস কয়েক অন্তত দুই ডজন মন্ত্রী-এমপি বিভিন্ন ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে সরকার ও দলকে বেকায়দায় ফেললেও নিজেরা বেকায়দায় পড়েননি।
ফটোশপের মাধ্যমে ‘নিজের শরীরের অংশের’ সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মুখমণ্ডল লাগিয়ে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিলেও আবদুল লতিফকে কয়েক দিন সাইডলাইনে রেখে সেভ করতে হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমেদকে হত্যার অভিযোগের পরও টাঙ্গাইলের আমানুর রহমান খান রানাকে যদ্দুর সম্ভব আড়ালে রেখে সেভ করতে হচ্ছে। পরিস্থিতির অনিবার্যতায় মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে কিছুদিন সাইজে রেখে এখন দলীয় পদ-পদবি দিয়ে মাঠে নামানো জরুরি হয়ে পড়েছে। লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে। নির্বাচন সামনে রেখে উপরোক্তদের বাইরে কয়েকজন নতুন করে নানা কাণ্ডে বেশ আলোচিত-সমালোচিত। জামালপুরের এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোজাফফর হোসেনের সঙ্গে আসাদুজ্জামান বাবুর টেলিফোনে ৩২ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের ফোনালাপ ও গালাগাল সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ বিনোদন জোগাচ্ছে। উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামকে চড়-থাপ্পড় ও কিল-ঘুসি মেরে সুপার-ডুপার হিট চট্টগ্রাম বাঁশখালীর এমপি মোস্তাফিজুর রহমান। বাঁশখালীতে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি মন্তব্য, পিস্তল হাতে মিছিলসহ নানা কাণ্ডে তিনি আলাদা হিরোইজমে বেশ নাম করেছেন। দলের প্রধান শেখ হাসিনার মনোনয়ন পাওয়া এ মাননীয়দের কেউ কেউ নিজেকে শেখ হাসিনার চেয়ে জনপ্রিয় এবং দলের জন্য অপরিহার্য মনে করেন। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, দলের কর্মীদের ওপরই মামলা-হামলা, নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করে রাখা, নানা দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততা, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক, মাদক কারবার, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগও আছে তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে। জলমহাল, সরকারি খাস পুকুর, বাড়িঘর দখল, টেন্ডারবাজি তো মামুলি।
এ ধরনের কিছু মহাশয়ের বিরুদ্ধে তৃণমূলের নেতাদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করে রেখেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে। ব্যবস্থা নেওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে তা ঝুলে গেছে। অভিযুক্তদের জন্য এটি আশীর্বাদের। এ ফাঁকে কেউ নেত্রকোনা-৫ (পূর্বধলা) আসনের বয়োবৃদ্ধ ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের মতো ২৬ বছর বয়সী কলেজ ছাত্রী নাদিয়াকে বিয়ে বা মানিকগঞ্জের মমতাজের মতো দ্বিতীয়-তৃতীয় স্বামীর প্রতিপক্ষের সঙ্গে মিতালি গড়ায় কোনো ভয় পাচ্ছেন না। মানিকগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য, আলোচিত কণ্ঠশিল্পী মমতাজ মাঝেমধ্যেই ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় গণমাধ্যমের শিরোনামে আসছেন। এবার তাকে টেনে এনেছেন বর্তমান স্বামী ডা. এ এস এম মঈন হাসান। পরিচয় গোপন রেখে দোসরা-তেসরা বিয়ে করতেইবা ভয় কী? নাম-পরিচয় গোপন করে ফারুক নামে আরেকটি বিয়ে করে জেলহাজত খেটে মুখ দেখাতে সমস্যা হচ্ছে না পাবনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি খন্দকার আজিজুল হক আরজুর। জনগণ তাদের কিছু বলে না। সব কীর্তি জানেও না। জানলেও সব সয়। চুপ থাকে। আবার পরিস্থিতির অনিবার্যতায় সরকারকে-দলকেও সইতে হচ্ছে। শুনতে হচ্ছে মানুষের গালমন্দ।
লেখক : ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন