বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের যে কোনো নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন ঢাকায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার ভি মন্টিটস্কি। সেইসঙ্গে তিনি এও জানিয়েছেন, রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ছাড়া অন্য কোনো নিষেধাজ্ঞা বৈধ মনে করে না। একই দিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের সতর্কবার্তা তৈরি পোশাক খাত নিয়ে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের স্থায়িত্ব শ্রম অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। হাস বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এবং বাংলাদেশে পরিচালিত মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য একটি স্থিতিশীল ও প্রত্যাশিত পরিচালনার পরিবেশের জন্য শক্তিশালী শ্রম আইন ও বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক।
৭ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বিশ্বের দুই সুপার পাওয়ারের এমন পাল্টাপাল্টিতে বিগত স্নায়ুযুদ্ধের নমুনা দেখছেন কেউ কেউ। বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময়, ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন বৈরী গণপ্রজাতন্ত্রী চীন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সালের জুলাই ৪ তারিখে বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি দিয়ে ব্যাপক সাহায্য দিতে থাকে। পঁচাত্তরের আগস্ট ট্র্যাজেডির পর এ সাহায্য আরও বাড়তে থাকে। নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সময় আবারও পুরোনো সেই পাল্টাপাল্টির ছাপ। এবারের বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কোন পরাশক্তি বিজয়ী হয়, তা দেখার অপেক্ষা কোনো কোনো মহলে।
এ ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়ায় দেরি করেনি ক্ষমতাসীনরা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞার ভয় নেই জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের বাইরে বাংলাদেশের আরও অনেক বন্ধু আছে। বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সব দেশ একমত নয়। মেসেজ হিসেবে এটিও কম নয়। ঢাকায় এমন পাল্টাপাল্টির আগের দিন ৭ ডিসেম্বর বুধবার বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ ব্রিফিং করেছেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনের কো-অর্ডিনেটর অ্যাডমিরাল জন কিরবি। যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন প্রেস সেন্টারে বিশেষ ব্রিফিংয়ে এবার কড়া বার্তায় কিরবি স্পষ্ট জানান, বাংলাদেশের জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে যা দরকার, তা-ই করবে যুক্তরাষ্ট্র। আর রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিয়ে প্রোপাগান্ডার অভিযোগ তুলেছেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস হস্তক্ষেপ করছেন—রাশিয়ার এমন অভিযোগের বিষয়ে বলেন, এটি রাশিয়ার পরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়। পিটার হাসের কাজের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, রাষ্ট্রদূত এবং তার টিম যেভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেইভাবে তারা বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, বিরোধী দল, সরকারসহ সমাজের সব স্তরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে। বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা পূরণে তাদের কঠোর পরিশ্রম অব্যাহত থাকবে। এ ক্ষেত্রে ইন্ডিয়া টুডের একটি প্রতিবেদনের সূত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থনে ভারত, চীন এবং রাশিয়ার একজোট হওয়ার বিষয়ে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বাংলাদেশের জনআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আছে-থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান স্পষ্ট করে কিরবি জানান, পিছু হটেনি যুক্তরাষ্ট্র। বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার ধরনও বর্ণনা করেন কিরবি।
বর্ণনায় বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে তাদের কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায় বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের অধীন থেকে কাজটি হয় যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়-অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোলের মাধ্যমে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দেশের ওপরও এ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সংশ্লিষ্টদের সম্পত্তি জব্দ করা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র তার বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য অর্জন কিংবা জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র তখন দুই ধরনের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেয়। একটি হচ্ছে কোনো দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কিংবা লেনদেন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া। দ্বিতীয়টি—নির্দিষ্ট কিছু পণ্য বা সেবার আমদানি-রপ্তানি নিষিদ্ধ করা। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুমতি ছাড়া সেসব দেশের সঙ্গে কোনো ব্যবসা করতে পারবে না।
স্যাংশন, ভিসা নিষেধাজ্ঞার কদিন ধরে বাণিজ্যক নিষেধাজ্ঞার কানাঘুষা ও গুজব-গুঞ্জনে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প সেক্টরে অস্থিরতা চলছে। বাণিজ্যিক স্যাংশন এলে ক্রেতারা পোশাক নেবে না, এলসি খোলা যাবে না—এমন আতঙ্কের কথা লুকাননি বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। দেশের পোশাক খাতের প্রধান ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে নানা ধরনের চাপ আসছে বলে জানিয়ে সংকট উত্তরণে এ খাতের অংশীদারদের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি। জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা ভিজিট করে গেছে, সেটারও প্রেশার সইছেন তারা। ক্রেতারা এরই মধ্যে ক্লজ দিয়ে গেছে। স্যাংশন আরোপ হলে পেমেন্ট দূরের কথা, তারা গুডস নেবে না, গুডস দিলেও পেমেন্ট দেবে না। এ ক্লজে আমাদের ব্যাংক এলসি খুলবে না। সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা সুখকর নয়। ক্ষমতায় থেকেও ক্ষমতার জন্য সমানে বোলিং-ব্যাটিংয়ে সময় পার হচ্ছে সরকারের। একদণ্ড বিরতি বা দম নিচ্ছে না। সর্বোচ্চ কাজে লাগাচ্ছে প্রতিটি মিনিট-সেকেন্ডকে। আবার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিটি আজকের পরিস্থিতি আগামীকালের মতো থাকবে না বলে নিশ্চিত সরকার। ৭ জানুয়ারি নির্বাচন পর্যন্ত সময়-পরিস্থিতি আরও বদলানোর তথ্য-সাবুদও আছে সরকারের কাছে। যেই যুক্তরাষ্ট্র দেশে দেশে সরকার পাল্টায়, উতলাবস্থা তৈরি করে সে দেশটিতেই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রের খবরও সরকারের জন্য প্রণোদনাদায়ক। কয়েক ডজন শীর্ষ মার্কিন সেনা কর্মকর্তা বাইডেন সরকারকে সরাতে চান বলে পেন্টাগনের রিপোর্টটি কেবল বাংলাদেশ নয়, মার্কিনবিরোধী আরও কোনো কোনো দেশের সরকারের জন্য আনন্দের। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রতিক্রিয়া আটকে রাখতে পারেননি। তাকে সরাতে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুর কারসাজি আবারও উল্লেখ করেছেন তিনি। বাংলাদেশেও প্রতিক্রিয়া একদম কম নয়। সেইসঙ্গে পর্যবেক্ষণ ব্যাপক। ১০ ডিসেম্বরই-বা কী হয়, রয়েছে সেই অপেক্ষাও।
কূটনৈতিক-রাজনৈতিক এজেন্ডায় ক্ষমতাসীনরা এবার ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে রাজধানীতে সমাবেশের উদ্যোগ নিয়ে পরে আবার থেমে যায়। দল থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের অনুমতি না মেলায় সে সমাবেশ হচ্ছে না। দিনটি বিএনপি খুব প্রিয়। তারা সেদিন মানববন্ধনের কর্মসূচি দিয়েছে। সরকারের অনুমতি পাবে কি না, তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। এবারের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র আবার কোনো নিষেধাজ্ঞা দেবে বলে গুঞ্জন ঘুরছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে এলিট ফোর্স র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এ নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল। প্রতিবছর মানবাধিকার দিবসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, মানবাধিকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বিভিন্ন রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। চট্টগ্রামের কক্সবাজারে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ক্রসফায়ারের ঘটনার সূত্র ধরে তৎকালীন র্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদসহ বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ওই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছেন সেই সময় র্যাবের মহাপরিচালক এবং বর্তমান পুলিশের আইজিও। এবার যখন বাংলাদেশ একটি নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে এবং যখন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে অত্যন্ত সোচ্চার অবস্থানে রয়েছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে কী ধরনের প্রতিবেদন দেয়, তা নিয়ে জনমনে নানান আগ্রহ, উৎসাহ-উদ্দীপনা রয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে গুজবও প্রচার হচ্ছে। নির্বাচনের আগে ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা জারির গুঞ্জনও ব্যাপক। কিন্তু সরকার এসব নিয়ে কেয়ার করে না বলে জানান দিচ্ছে। ভেতরে ভেতরে ভয়ও পিছু ছাড়ছে না। আবার সরকারের এরই মধ্যে কিছু অর্জনও যোগ হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের কিছু ভূমিকা ইতিবাচক হিসেবে দেখছে পশ্চিমা বিশ্ব। কিন্তু গোলমাল স্থানিকের সুযোগে আন্তর্জাতিক তথা ভূরাজনীতিতে।
নির্বাচন নিয়ে ঢাকায় পিটার ডি হাস স্টাইলে ইসলামাবাদে কদিন ধরে কর্মব্যস্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডোনাল্ড ব্লুম। পাকিস্তানে ব্লু নামে বেশ পরিচিত তিনি। তবে গণমাধ্যমে সংক্ষেপে ব্লুম। তার দেখাদেখি পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। বৈঠকসহ আতিথেয়তা নিচ্ছেন-দিচ্ছেন। পাকিস্তানের পিএমএল-এনের শীর্ষ নেতা নওয়াজ শরিফের সঙ্গে লাহোরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডোনাল্ড ব্লুর সাম্প্রতিক বৈঠক দেশটিতে বেশ আলোচিত। গণমাধ্যমের খবর হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনে নওয়াজের দলের প্রস্তুতি এবং দেশটির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-পিএমএল-এনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাদের আলোচনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের গুরুত্ব বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। নমুনা কিছুটা বাংলাদেশের মতোই, যা হয়েছে ঢাকায় হাস ও বিভিন্ন দলের মধ্যে। বাংলাদেশে হাস-পর্বে এখন একটি কমা বা সেমিকোলন চলছে। ফুলস্টপ পড়েনি। সামনের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে রাজনৈতিক দলের বাইরেও সোচ্চার বিশ্বের অনেক প্রভাশালী দেশ ও সংগঠন। ঠিক তপশিল ঘোষণার আগে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিকে এশিয়া সাব-কন্টিনেন্টে প্রভাবশালী ডোনাল্ড লুর চিঠিও আরেক কূটনীতি। যার সঙ্গে পাকিস্তানের ইমরান খানের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকে মেলানোর একটি চর্চা চলছে। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ বা খানের সঙ্গে শেখকে মেলানোর বাস্তবতা না থাকলেও পট-প্রেক্ষাপট মিলিয়ে তুলনা টানার চেষ্টা রয়েছে। ঘুরছে কিছু জিজ্ঞাসাও।
লেখক : ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন