কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:২২ এএম
আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় নির্বাচন: যদি-তবে-কিন্তু-অথবা

মহসীন হাবিব
জাতীয় নির্বাচন: যদি-তবে-কিন্তু-অথবা

আর মাত্র তিন সপ্তাহেরও কম সময় রয়েছে নির্বাচনের। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার একটি নির্বাচন সম্পন্ন করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও দেশের একটি বৃহৎ দল বিএনপি ও নির্বাচন বয়কট করা কয়েকটি ছোট দল অবরোধ-হরতাল অব্যাহত রেখেছে এবং তাদের কট্টর সমর্থক কিছু মানুষ নাটকীয় কোনো পট-পরিবর্তনের আশা ছাড়েনি। আবার এটাও লক্ষ করা যাচ্ছে যে, হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি খানিকটা শীতল হয়ে পড়েছে। অন্তত এই মুহূর্তে। মানবাধিকার দিবস বা কুয়েতের আমিরের মৃত্যুর কারণে হরতাল স্থগিত বা পেছানো হয়। এটি তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে সরকার পতনের আন্দোলনের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য নয়। কুয়েতের আমিরের মৃত্যুতে রাষ্ট্র শোক জানাবে, রাজনৈতিক দলগুলো শোক জানাবে সেটা স্বাভাবিক। কুয়েত বাংলাদেশের বন্ধু দেশ, সহায়তাকারী দেশ। এসব দিবস দেখে রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়া ভালো, সেটাও অস্বীকার করছি না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কুয়েতের আমিরকে এ দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ চেনেই না এবং তার ছবিও কখনো দেখেনি। বিভিন্ন দেশে আমরা যখন আন্দোলন দেখেছি, তখন এ ধরনের দিবস বা শোককে মাথায় রেখেই আন্দোলনকারীরা তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যান। বাংলাদেশেও বিভিন্ন আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীরা দিন-ক্ষণ গুণে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দেয়নি। অর্থাৎ ইনিয়ে-বিনিয়ে যা বলছি তার অর্থ হলো—বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিএনপির নেতৃত্বে আন্দোলন দানা বাঁধতে পারেনি। শুধু চোরাগোপ্তা হামলা করে বাস-ট্রেনে আগুন দেওয়া গেছে, যা আন্দোলন না বলে নাশকতা বলাই ভালো। এ নিয়ে নানা তাত্ত্বিক আলোচনা করা যায়, সেদিকে না যাই। তবে একটি সত্য না বলা থেকে নিজেকে সামলাতে পারছি না। আর তা হলো, একটি আন্দোলনে জনগণের মধ্যে হোপ বা আশা তৈরি হতে হয়। জনগণের বিশাল একটি অংশ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয় ভাগ্য পরিবর্তন, দেশের ভবিষ্যৎ পরিবর্তন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন দিন আনার আশায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সরকারের প্রতি নানাবিধ অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও তারা রাস্তায় নেমে আসেনি। স্বীকার করতেই হবে, দুই রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের বাইরে যে বিশাল একটি জনশক্তি বাংলাদেশের রয়েছে, তারাই আন্দোলনের নিয়ামক। আমরা সর্বশেষ তাদের নামতে দেখেছিলাম ’৯০-এর আন্দোলনে ও ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর। সেই দুটো সরকার আন্দোলন হজম করতে পারেনি।

এখন দেশবাসীর বড় প্রশ্ন, কী হবে নির্বাচনে, কেমন হবে নির্বাচন, নির্বাচন-পরবর্তী সময় আন্দোলন-সংগ্রাম বিএনপি-জামায়াত ও সমমনারা কতটা অব্যাহত রাখতে পারবে। নিঃসন্দেহে এ প্রশ্নের উত্তর অপেক্ষা করছে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের ওপর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে বদ্ধপরিকর। তাতে দেশের অনেক মানুষ ভরসাও রেখেছে। তিনি হয়তো সত্যিই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন মনেপ্রাণে দেখতে চান। অর্থাৎ তিনি কোনোক্রমেই ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন দেখতে চান না। কিন্তু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নেতাকর্মী এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়া অন্যান্য দলের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে তুলছে। নির্বাচন একটি খোলা প্রতিযোগিতা। এখানে দেশের অন্য একটি বৃহৎ দল বিএনপি না থাকলেও তৃতীয় বৃহৎ দল হিসেবে জাতীয় পার্টি রয়েছে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ভরসা রাখলে জাতীয় পার্টির কাছে সুযোগ ছিল, অথবা তারা ভাবতে পারত সরকারবিরোধীদের ভোট কবজা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করার। তারা দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের চেয়েও অধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বারবার ‘সমঝোতার’ আলোচনায় বসেছে। আওয়ামী লীগ ২৬টি আসনে তাদের প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর মানে কি এরকম দাঁড়ায় না যে, একটি বৃহৎ দল হিসেবে তারা পার্লামেন্টে ২৬টি আসন সরকারের কাছ থেকে নিশ্চয়তা নিয়ে রাখতে চাইছে? খোলা মাঠে যার আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করার কথা, তারা নির্বাচনের আগেই সরকারের দয়া-দাক্ষিণ্যের দিকে তাকালে প্রতিযোগিতার মঞ্চে আর থাকে কী? অর্থাৎ তারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে বিশ্বাস আনেননি!

আওয়ামী লীগের আরও একটি লক্ষ্য হলো ভোটার টার্ন আউট। অর্থাৎ পর্যাপ্ত সংখ্যক, গ্রহণযোগ্য সংখ্যক ভোটার যদি উপস্থিত হয় তাহলে নির্বাচনকে মোটামুটি একটি সার্থকতা দেওয়া যাবে। কিন্তু ভোট যদি কারচুপিমুক্ত না হয়, তাহলে এ লক্ষ্য ব্যর্থ হবে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, ভোটাররা আগামী কয়েক দিনের প্রচার-প্রচারণা, প্রশাসনের দায়িত্ব, নিরপেক্ষতার দিকে তীব্র নজর রাখবে। যদি তাদের মধ্যে এ আস্থা তৈরি হয় যে, তার ভোটটি গুরুত্ব বহন করবে, অর্থপূর্ণ হবে, তাহলে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, বহু সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারবিরোধীরাও ভোটকেন্দ্রে যাবেন। তাদের কেউ হয়তো সরকারের অপেক্ষাকৃত বিরোধী লোককে অথবা নিজের কোনো পছন্দের অথবা আত্মীয়-বন্ধুকে ভোট দিতে যাবেন। আর যদি তারা প্রার্থীদের এবং প্রশাসনের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে বুঝতে পারেন যে, তার ভোটটি এবারও মূল্যহীন, তাহলে সরকারের ভোটার টার্ন আউটের লক্ষ্য সফল হবে না। সেইসঙ্গে নির্বাচন-পরবর্তী যে আন্দোলন দেখা দেবে তাতে তারা যোগ দিতে পারে। এটা বুঝতে অবশ্য আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।

নির্বাচন কমিশন তথা সরকার যদি সত্যিই কারচুপিহীন একটি নির্বাচন উপহার দিতে পারে, তাহলে যেসব দেশ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে বারবার তাগিদ দিয়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তারা ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি’ বলে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগে খানিকটা হলেও মনোবল হারাবে। যুক্তরাষ্ট্র বারবার বলেছে, বাংলাদেশে তাদের কোনো নির্দিষ্ট পছন্দের দল নেই। সেই বক্তব্যের থেকে পিছু হটতে কষ্ট হবে, নতুন কোনো ব্যাখ্যা দরকার হবে। আর সেই ব্যাখ্যায় যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যাবে না বলেই মনে হয়। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র শুধু বাংলাদেশ নিয়ে বসে নেই। শুধু ইসরায়েল-হামাস বা ইউক্রেন-রাশিয়া নয়, আরও কয়েকটি অঞ্চলে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার ভীষণ কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। মাত্র চার দিন আগে ভেনেজুয়েলা সৈন্য সমাবেশ শুরু করেছিল গায়ানা সীমান্তে। যদিও আপাতত দুই দেশ সংঘর্ষে না জড়ানোর ব্যাপারে দ্রুত একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে, তথাপি টেনশন রয়ে গেছে। কারণ গায়ানার এসিকিওবো অঞ্চলে যে বিশাল তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেখান থেকে ভেনেজুয়েলা নিজেদের দাবি ত্যাগ করেনি। ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট ইন্টারেস্ট রয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে ভেনেজুয়েলা সীমান্তে সৈন্য সমাবেশের প্রস্তুতি নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র গায়ানার সঙ্গে সামরিক মহড়ার ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার মধ্যে আবার টেনশন শুরু হয়েছে। যে ইরিত্রিয়ার সঙ্গে শান্তি স্থাপনের কারণে ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট আবি আহমেদকে ২০১৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়, সেই ইথিওপিয়া এখন বন্দরের সুবিধা পাওয়ার পথ খুঁজছে। কারণ ইথিওপিয়া দেশটি ল্যান্ডলক। একসময় আসাব বন্দর ছিল তাদের। কিন্তু তা এখন ইরিত্রিয়ার হওয়ায় অর্থনৈতিক বিশাল সুবিধা থেকে ইথিওপিয়া বঞ্চিত। ঐতিহাসিকভাবে দুই দেশের মধ্যে বহু সংঘর্ষ হয়েছে। ইথিওপিয়া আবার ইরিত্রিয়া সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করতে শুরু করেছে। ওই স্থানে এখন যথারীতি হাজির হয়েছে রাশিয়া ও চীন। ফলে যুদ্ধের আরেকটি ফ্রন্ট খোলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার বিশেষ কারণ। তাইওয়ান সমস্যা একটুও কমেনি। দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবমেরিন প্রবেশকে পরমাণু যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে উত্তর কোরিয়া জাপান সাগরে মাঝারিপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। এসব ঘটনা কিন্তু চলতি সপ্তাহেরই। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক বৈরী সরকার দেশে দেশে চাইবে না। তা ছাড়া এক ধরনের মানুষ যে ‘নিষেধাজ্ঞা’ ‘নিষেধাজ্ঞা’ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে, সে বিষয়টি এতটা সহজে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর দেবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিবিশেষের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং একটি দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা এক কথা নয়। আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে। তবে নির্বাচনটি যদি কারচুপিমুক্ত না হয়, যদি পুকুর চুরি ধরনের কিছু ঘটে, তাহলে অনেক পদক্ষেপই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নিতে পারে। আফটার অল, তারা ধনী দেশ। আমাদের অনেক ধরনের দায়বদ্ধতা তাদের কাছে আছে। পক্ষান্তরে যেসব দেশ বাংলাদেশের সরকারের ওপর আস্থা রেখেছে এবং ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে অভিহিত করেছে, তাদেরও নৈতিক সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে মনোবল ভেঙে যাবে। সুতরাং ৭ তারিখের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় অংশ না এলেও নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার মধ্য দিয়ে একে জায়েজ করা সম্ভব হবে। তা না হলে রাশিয়া যে ‘আরব বসন্ত’ ধরনের আন্দোলনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, তাকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হাইকোর্টে পুলিশ সদস্যের জামিন ইস্যুতে আইন উপদেষ্টার স্ট্যাটাস

নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে যাওয়া-আসা করলে কি ৪০ দিনের ইবাদত নষ্ট হয়ে যায়?

হঠাৎ অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন মার্কিন বিমানবাহিনীর প্রধান

ইসিকে ৪০ লাখ ইউরো সহায়তা দেবে ইইউ

ভারতীয়রা কেন অন্ধভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করে?

আ.লীগ কার্যালয়ে এবার বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের সাইনবোর্ড

চমক রেখে ভারতের এশিয়া কাপ স্কোয়াড ঘোষণা

স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে নতুন সচিব

ভারতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী : দুই দেশের সম্পর্ক কি স্বাভাবিক হবে?

১০

প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুকের সাক্ষাৎ

১১

সাতক্ষীরা সীমান্তে বিজিবির বিশেষ অভিযানে ভারতীয় মালামাল জব্দ

১২

ডাকসু নির্বাচন / বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্যানেল ঘোষণা

১৩

‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’ বার্তা ফাঁসকারী পুলিশ সদস্য রিমান্ডে

১৪

যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বপ্নভঙ্গের হতাশা

১৫

ভিসা নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকেও পাল্টা জবাব দিল ইসরায়েল

১৬

ছাত্র রাজনীতি বন্ধের এক বছর, কী ভাবছেন ইডেন শিক্ষার্থীরা

১৭

কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের নতুন সচিব রফিকুল ইসলাম

১৮

৪০ দিন আগেই কি মানুষ নিজের মৃত্যুর কথা বুঝতে পারে?

১৯

বনানীতে সিসা বারে রাব্বী হত্যায় ৪ আসামি রিমান্ডে

২০
X