৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে আরও একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও কয়েকটি ছোট ছোট দলের ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে। কেন এ ভোট বর্জন, গোলমালটা কোথায়? বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনকে আস্থায় নিতে পারেনি। কারণ ২০১৪ ও ’১৮ সালের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা তাদের ভালো নয়। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেয়। বিএনপি এ ব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য আন্দোলনে নামে এবং ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৫৩টি আসনে ওয়াকওভার লাভ করে, অর্থাৎ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না। তখন জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৩৪টি আসন পেয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে, সেটা নিজেদের সিদ্ধান্তের কারণেই হোক বা বিদেশি বন্ধুদের পরামর্শেই হোক, কিন্তু সেই নির্বাচনে আরও একটি লজ্জাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৮টি, জাতীয় পার্টি ২২টি এবং বিএনপি ৬টি আসনে জয় পায়। নির্বাচন দুটি যে স্বচ্ছ হয়নি, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং সবার জন্য সমান সুযোগ নিয়ে হয়নি, সে কথা বহু আওয়ামী লীগ নেতাও বলেছেন। এসব ঘটনা সবারই জানা ও মুখস্থ। এরকম একটি পরিস্থিতিতে বিএনপি একেবারেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তের পর বিএনপি এবং সরকারবিরোধীরা আবার প্রাণ ফিরে পায়। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় যারা নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করবে তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা হবে। তারা কোনো দলের নামোল্লেখ না করলেও আওয়ামী লীগ এবং দেশবাসী ধরে নেয় যে, এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সরকার ও সরকার সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, সেইসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বারবার বলতে থাকে তারা কোনো নির্দিষ্ট দলের সমর্থক নয়, শুধু একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে না আনার বিষয়ে অনড় থেকে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন। যেহেতু ২০১৮ সালের নির্বাচনটিতে অংশ নিয়েও বিএনপি ভোট কারচুপির শিকার হয়েছিল, তাই তারা আর এ নির্বাচনে না এসে বরং আন্দোলন ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়।
এরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ একটি নতুন কৌশল অবলম্বন করে। তারা দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের যার যার মতো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য মুক্ত করে দেয়। আওয়ামী লীগের ধারণা হয়, পর্যাপ্তসংখ্যক ভোটার উপস্থিত হলে এবং সুস্থ ভোট হলে বহির্বিশ্বেরও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলার সুযোগ থাকবে না, অন্যদিকে নিজের দলের লোকরাই অধিকসংখ্যক নির্বাচিত হয়ে আসবে। এবং হলোও তাই। স্কটল্যান্ড, চীন, উজবেকিস্তান, ওআইসি, রাশিয়া, ফিলিস্তিন ও গাম্বিয়া থেকে আসা পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন নিয়ে অন্তত অসন্তোষ প্রকাশ করে বিবৃতি দেননি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা ডেমোক্রেটিক দলের সাবেক কংগ্রেসম্যান জিম বেটস বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক পর্যবেক্ষক এবং আমেরিকান গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজির প্রধান নির্বাহী আলেক্সান্ডার গ্রে বলেছেন, ‘আমি নিজের চোখে দেখেছি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচন দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ বিবৃতি কীভাবে নেবে তা জানি না, তবে এ বিবৃতি পুঁজি করেই আওয়ামী লীগ মনোবল বৃদ্ধি করে আগামী দিনের সরকার গঠনে মনোনিবেশ করবে। কিন্তু সুদূরপ্রসারী ফলাফলের দিকে তাকালে একাধিক নেতিবাচক পরিস্থিতি দেখা যেতে পারে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে এবং ভোটকেন্দ্রে যথেষ্ট ভোটার উপস্থিত করতে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা দলটির নিজ পায়ে কুড়াল মারার মতো অবস্থা তৈরি করতে পারে। এই ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে অনেকটা স্থানীয় নির্বাচনের মতো। বিভিন্ন আসনে আওয়ামী লীগের ঐক্যবদ্ধ নেতারা নির্বাচনে অংশ নিতে ভাগ হয়ে গিয়েছে। সেইসঙ্গে ভাগ হয়েছে সমর্থকরা। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে স্থায়ী একটি বিভাজন তৈরি হয়েছে। একসঙ্গে যারা মিছিল মিটিংয়ে যেত, তাদের মধ্যে মারামারি-হানাহানির সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন নির্বাচনী আসনে জয়লাভের আশায় কেউ কেউ বিএনপি বা জামায়াতকর্মীদের দ্বারস্থও হয়েছেন। ফলে এবারের নির্বাচন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নতুন মেরূকরণ ডেকে আনতে পারে। এখন দেখা যাক, আওয়ামী লীগ এই ক্ষত কীভাবে সারিয়ে তোলে অথবা সারিয়ে তুলতে উদ্যোগ নেয়।
এ নির্বাচনে আরও একটি ক্ষতিকর বিষয় দেখা গেছে। যেহেতু একই আদর্শের রাজনীতিবিদরা মাঠে তাই আদর্শিক বিষয়টি মুখ্য না হয়ে জনগণের সামনে প্রাধান্য পেয়েছে কে কতটা সুবিধা এনে দিতে পারবে এবং নির্বাচনে কে কত টাকা খরচ করতে পারবে। এ নির্বাচনে প্রার্থীদের দলীয় আদর্শের কথা বলে বেড়াতে হয়নি। বলতে হয়নি আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বা স্বাধীনতা যুদ্ধের স্পিরিট বেগবান করার কথা। যদিও নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া নির্বাচনী ব্যয় ছিল ২৫ লাখ টাকা, কিন্তু দেখা গেছে যে বা যারা অধিক অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে, তারাই নির্বাচনে জয়ী হয়ে এসেছে।
এ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী আরেকটি মোটামুটি বড় দল বা দেশের তৃতীয় বৃহৎ দল জাতীয় পার্টি একটি চরম ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় পার্টির প্রধান জি এম কাদের একজন সজ্জন মানুষ। যথেষ্ট লেখাপড়া জানা মানুষ। তিনি নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। দলটির উচিত ছিল সম্পূর্ণ বিরোধী দল হিসেবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা। তাতে সরকার নিজেদের ভোট, সেইসঙ্গে সরকারবিরোধী একটি বড় অংশের ভোট টেনে ভালো অবস্থানে যাওয়ার। কিন্তু সে সাহস কেন পেল না তা দলটিই ভালো জানে। যখনই সরকারের সঙ্গে আলোচনায় গেল এবং ২৬টি আসনে সসমঝোতা করল, তখনই তার বিরোধী দলের ইমেজ নষ্ট হয়ে গেল। আওয়ামী লীগের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ল। একদিকে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলো, অন্যদিকে তাদের প্রাপ্ত আসনও তলানিতে গিয়ে ঠেকল। জি এম কাদের বলেছেন, আমাদের আশঙ্কা ছিল, নির্বাচনে টেনে এনে আমাদের কোরবানি করা হতে পারে। বড় করে তার কাছে প্রশ্ন করা যায়, একটি দলের বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আপনারা সেই দলের সঙ্গে সমঝোতায় গেলেন কেন, কোন ভয়ে? খেয়ে না খেয়ে পূর্ণ উদ্যোগে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নির্বাচন করে দেখতেন। তাতে একটি বড় লাভ হতো যে, সারা দেশে জাতীয় পার্টির অবস্থা কেমন আছে তা পরিষ্কার হতে পারত। হয়তো জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিরও একটি সুযোগ ছিল, যা হাতছাড়া হলো।
দৃশ্যমান না হলেও আরও একটি নতুন সমস্যা আওয়ামী লীগের জন্য তৈরি হয়ে রইল। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র থেকে জিতে আশা অনেক প্রার্থীর মধ্যে এ ধারণা প্রকট হতে পারে যে, দলীয় ব্যানারের বাইরে থেকেও তারা নির্বাচনী এলাকা থেকে জয়ী হয়ে আসতে সক্ষম। কারণ তারা অনেকই এবার জিতে এসেছেন নৌকার মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করে। ভবিষ্যতে যদি দেখা যায় দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি, তাহলে আবার যে কোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে নেবেন। কারণ তাদের নিজেদের ব্যক্তি ইমেজের প্রতি আস্থা বেড়ে গেছে। অর্থাৎ এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দলীয় নিয়ন্ত্রণের খানিকটা বাইরে চলে গেল। এসব বিষয়ে সামনের দিনগুলোতে আওয়ামী লীগ কীভাবে মোকাবিলা করবে তা ভাবার বিষয়।
বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সদ্যই জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগের যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে বিভক্ত হয়ে তাদের একই ময়দানে সরকার ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে পারবে কি? এ প্রশ্নটি কিন্তু এখন বেশ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটিতে এরই মধ্যে বহু স্বাধীনতাবিরোধী ঢুকে পড়েছে। দলের বিভিন্ন কমিটিতে এমন সব লোকের অস্তিত্ব আছে যারা অস্থিমজ্জায় আওয়ামী বিরোধী ছিল। এ নতুন করে নির্বাচিত স্বতন্ত্রদের হাত ধরে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশের পথ তাদের জন্য আরও প্রশস্ত হলো বলে মনে হচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক