মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:০২ এএম
আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮:৩৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলামে দায়িত্বশীলদের মর্যাদা ও কর্তব্য

ইসলামে দায়িত্বশীলদের মর্যাদা ও কর্তব্য

পৃথিবীর কোথাও মানুষের পক্ষে একাকী বসবাস করা সম্ভব নয়। মানুষকে সৃষ্টিই করা হয়েছে জোড়ায় জোড়ায়। পৃথিবীর যেখানেই কোনো একজন মানুষ উপস্থিত হবে, সেখানেই সে একটি সমাজ তৈরি করবে। এজন্য বলা হয়, মানুষ সামাজিক জীব। আর কোথাও একাধিক মানুষের সমাবেশ ঘটলেই প্রয়োজন হয় ঐক্য ও একতার, একজনের নেতৃত্বে বাকিদের একতাবদ্ধতার। মহান আল্লাহ সংঘবদ্ধতায় বিশেষ বরকত রেখেছেন। দেখা যায়, কয়েকজন মানুষ একত্রে কোনো কাজ করলে তাতে অনেক বরকত হয়। আল্লাহর সাহায্যও থাকে এর মধ্যে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘সংঘবদ্ধ লোকের ওপর আল্লাহর হাত রয়েছে।’ (তিরমিজি : ২১৬৭)। এজন্য সামাজিক ও সংঘবদ্ধ জীবনযাপন না করে আলাদা হয়ে চলা পছন্দনীয় নয়। এমন অবস্থায় শেষ বিদায়কে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বলে ব্যক্ত করা হয়। সংঘবদ্ধতা হবে তো এর মধ্যে একজন আমির বা দায়িত্বশীল অবশ্যই থাকবেন, যিনি এ সংঘবদ্ধ লোকদের নেতৃত্বের দায়িত্ব নেবেন। সাধারণ মানুষ তার নির্দেশনা অনুযায়ী চলবে। আখেরাতের পুঁজি সঞ্চয় করে কামিয়াব হবে। নেতৃত্বদান ও দায়িত্বশীলতার অনুভূতি পেশ করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তিনজন লোক সফরে থাকলে, তাদের একজনকে আমির বানানো উচিত।’ (আবু দাউদ)। এখানেই চলে নেতৃত্বের প্রসঙ্গ। ইসলামে নেতৃত্ব ও দায়িত্ব সম্পর্কে রয়েছে বিশদ নির্দেশনা।

ইসলামে ন্যায়পরায়ণ শাসকের ব্যাপারে বিশেষ মর্যাদা ঘোষিত হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘ন্যায়-নীতিবান শাসক কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে তার ডান পাশে দ্যুতিময় মিম্বারের ওপর অবস্থান করবে। অবশ্য আল্লাহতায়ালার উভয় পাশই ডান। তারাই সেসব বিচারক বা শাসক, যারা নিজেদের বিচার-বিধানে, নিজেদের পরিবার-পরিজনে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ইনসাফ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে।’ (সহিহ মুসলিম : ৪৮২৫)। ন্যায়পরায়ণ বাদশা যখন আল্লাহর কাছে দোয়া করে, মোনাজাতে হাত তোলে, তখন আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন। নেতৃত্ব ও দায়িত্ব ইসলামে এক প্রকার আমানত। ন্যায়পরায়ণ শাসক একই সঙ্গে আমানত রক্ষার সওয়াবও লাভ করবেন। তবে এর জন্য সতর্কতাও জরুরি। নেতার জন্য মানুষের কল্যাণ কামনা, সবরকমের প্রয়োজনের প্রতি সুদৃষ্টি রাখা এবং এর উৎকর্ষতার ফিকির করা শুধু তার দায়িত্বই নয়; বরং ফরজে আইন বা অবশ্য কর্তব্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।’ (সুরা মুমিনুন : ৮)। আমানত আল্লাহর হোক আর মানুষের হোক, অঙ্গীকারও আল্লাহর হোক বা মানুষের হোক, এর খেয়াল রাখা মুমিনের গুণ। দায়িত্ব গ্রহণ করাও আল্লাহ ও মানুষের সঙ্গে অঙ্গীকার করার মতো। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে আমানত রক্ষা করে না তার ইমানের দাবি যথাযথ নয় এবং যে অঙ্গীকার পূরণ করে না তার দ্বীন যথাযথ নয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৩১৯৯)। হজরত আলি (রা.) বলেন, কোনো ব্যক্তির কদর ও মূল্যায়ন অনুমিত হয় তার দায়িত্বশীলতার অনুভূতির মধ্য দিয়ে। প্রজ্ঞাপূর্ণ এ উক্তিটি নিয়ে যতই চিন্তা-ফিকির করা হবে, সেটা কম হবে।

আরবিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘সাইয়িদুল কওমি খাদিমুহুম’, অর্থাৎ ‘জাতির নেতারা তাদের খাদেম বা সেবক।’ জনগণের ওপর কর্তৃত্ব করার জন্য নয়, বরং সমাজের সেবা করে সুখ-দুঃখে তাদের পাশে থাকবেন, তাদের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা পালন করবেন এবং জনগণের আস্থা অর্জন করে নেতারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। নেতা কোনো অবস্থায়ই তার অধীন লোকদের মধ্যে বৈষম্য করবেন না। সবার সঙ্গে ইনসাফভিত্তিক আচরণ করবেন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-জাতীয়তা বা অঞ্চল নির্বিশেষে সবাই নেতার কাছ থেকে ইনসাফ পাবেন। এমনকি শত্রুর প্রতি ইনসাফের আচরণ করতে নির্দেশ করে ইসলাম। আমরা কালেমা পড়ে এই অঙ্গীকার করে নিয়েছি যে, আমরা নবীওয়ালা কাজ করব। আমাদের মধ্যে যদি এর অনুভূতিই না থাকে তাহলে এটা অনেক বড় ক্ষতির কারণ। নবীজি (সা.) বলেন, ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, শোনো, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ২৫৫৪)। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তিকে আল্লাহ জাতির দায়িত্ব অর্পণ করেন; কিন্তু সে তাদের কল্যাণকর নিরাপত্তা বিধান করল না, সে বেহেশতের গন্ধও পাবে না।’ (মিশকাত : ৩৫১৮)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি মুসলিম জনগণের শাসক নিযুক্ত হয়, অতঃপর সে প্রতারক বা আত্মসাৎকারীরূপে মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (বোখারি : ৭২৩৯)

একজন নেতা কেমন হবেন, তার সর্বোত্তম আদর্শ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তার নেতৃত্বের একটি বিশেষ দিকের প্রতি মহান আল্লাহ ইঙ্গিত করেছেন। নেতা কখনো কঠোর হবে না, নেতাকে হতে হবে উদার, নম্র, কোমল, লজ্জাশীল, দয়াশীল ও ক্ষমাশীল। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! আল্লাহর অনুগ্রহে আপনি মানুষের জন্য খুবই নম্র স্বভাবের হয়েছেন। আপনি যদি উগ্র স্বভাব ও পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী হতেন, তবে এসব লোক আপনার চারপাশ থেকে দূরে সরে যেত, অতএব তাদের ক্ষমা করে দিন। তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করুন এবং ইসলামের কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন। অবশ্য কোনো বিষয়ে আপনার মতো সুদৃঢ় হয়ে গেলে আল্লাহর ওপর ভরসা করুন। বস্তুত আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন যারা তার ওপর ভরসা করে কাজ করে।’ (সুরা আলে ইমরান, ১৫৯)। মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) ক্ষমার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বিশ্ব ইতিহাসে এমন আরেকটি খুঁজে পাওয়া যাবে না।

মানুষ যত যোগ্য ও শক্তিশালী হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত সে মানবীয় দুর্বলতার অধিকারী মানুষ মাত্র। মানুষের ভুল হয় ও হবে, পাপ হয় ও হবে। ভুল ও পাপ নিয়েই মানুষ। কোনো মানুষ যেন পাপে না জড়ায়, সেজন্য রয়েছে আল্লাহর নির্দেশনা, পাপে জড়ালেও রয়েছে ক্ষমার সুযোগ। তেমনি কোনো মানুষ ভুল করলে থাকে সামাজিক নিয়ম ও ভুল শোধরানোর সুযোগ।

একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির দায়িত্বের অনুভূতি যখন খতম হয়ে যায় তখন এর প্রতিক্রিয়া বহুদূর পর্যন্ত গড়ায়। অধীনস্থ লোকরা এতে মারাত্মক প্রভাবিত হয়। কর্মক্ষমতা কমে যায়। এদিক লক্ষ করে আমাদের হিসাব করতে হবে যে, আমাদের ত্যাগ-কোরবানি আল্লাহর জন্য না অন্য কিছুর জন্য। মহান আল্লাহ সবাইকে বোঝার ও আমল করার তাওফিক দিন।

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১৪ মে : নামাজের সময়সূচি

মঙ্গলবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর ভিডিও ধারণ, আটক ২

হত্যা মামলায় বৃদ্ধের যাবজ্জীবন

বগুড়ায় স্ত্রী হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি গাজীপুরে গ্রেপ্তার

মতলব উত্তরের যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক নোমান বহিষ্কার

গরম নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

সরকারি গাছ কেটে মামলা খেলেন বিএনপি নেতা!

নাটোরে শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে ধর্ষণ, যুবকের যাবজ্জীবন

এসএসসিতে পাশের খবরেও কাঁদছেন মুরাদের বাবা-মা

১০

বগুড়ায় রিটার্নিং কর্মকর্তার ওপরে চটলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী সফিক

১১

বিয়ের ৫ মাস পর দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে যুবক খুন

১২

চবিতে বহিরাগতদের মোটরসাইকেল প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা

১৩

যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীকে নির্যাতন, কারাগারে স্বামী

১৪

আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে আ.লীগ নেতাকে জরিমানা

১৫

ফুফাতো ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে মামাতো ভাই খুন

১৬

গভর্নরের সঙ্গে পিটার হাসের ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক 

১৭

হাসপাতালে লিফটে আটকে রোগী মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটির কাজ শুরু

১৮

সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ বাতিলের দাবি

১৯

উন্নয়নের নামে নিধন হচ্ছে বনায়ন, কাটা পড়বে ১৫ হাজার গাছ

২০
X