বর্ষার আগমনের বার্তা বাহক কদম ফুল যেন হারিয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে। ‘বাদল দিনের প্রথম প্রহর কদম ফুল’-এর হাসি তো ভুবন ভোলানো। বর্ষায় সবার আগে যে ফুলের নামটি উঠে আসে তা হলো কদম। বৃষ্টি-ধোয়া বাতাসে কদম ফুলের ঘ্রাণ যেন ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্বপ্নের কোনো রাজ্যে। হলুদ ও সাদার মিশ্রণে কদম ফুলের পাপড়িতে লেগে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা যেন হীরের সুভাস ছড়ায়।
কি গ্রাম, কি নগর-শহর, সর্বত্রই বর্ষার আগমনি বার্তা দেয় কদম। কদম ফুল না ফুটলে যেন বৃষ্টি ঝরে না। কদম ফুলের ঘ্রাণ জানান দেয় নবযৌবনা বর্ষার আগমনি বার্তা। বর্ষা মানেই গুচ্ছ গুচ্ছ কদম ফুলের সুবাস। পথ চলতে চলতে কিংবা বাসে ছোট শিশু ছাড়াও কিশোরীর হাতে শোভা পায় তরতাজা একগুচ্ছ কদম ফুল। হাত বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে—আফা নিবেন? মাত্র ১০ টাকা। যে ‘কদম’ নিয়ে এত কিছু, আষাঢ়ের বার্তাবাহক সেই প্রিয় ‘কদম’ যেন হারিয়ে যেতে চলেছে আজ। গ্রামে এই ফুল বেশি পাওয়া যায়।
তবে এখন আর আগের মতো কোথাও চোখে পড়ে না কদম। কদম এখন যেন একটি দুর্লভ ফুলের নাম! গাছে কদম ফুটেছে, রিমিঝিমি বৃষ্টিতে থই থই চারিধার। জ্যৈষ্ঠের তীব্র তাপদাহে তপ্ত দেহ-মনে স্বস্তির ছোঁয়া নিয়ে ফিরে এলো ‘আষাঢ়’।
বাংলা বর্ষ পরিক্রমায় এ মাসটির সঙ্গে প্রকৃতির যেন নিবিড় সম্পর্ক। আর কদম ছাড়া আষাঢ় কল্পনাই করা যায় না। এক সময়ে বাড়ির আঙিনায়, রাস্তার দুপাশে কদমগাছ ছিল চোখে পড়ার মতো। আর আষাঢ়ের পুরো সময়টাই ফুলে ফুলে ভরে থাকত গাছ। সাদা-হলুদের মিশ্র রঙের কদম ফুলে ছেয়ে যেত গাছ, যা দেখে তৃপ্ত হতেন সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ। আর এসময়ে গ্রামের শিশু-কিশোরসহ দুরন্ত কিশোরীরা কদমতলায় ‘কদম’ ফুল নিয়ে খেলা করত। মানুষ তার প্রিয়জনকে উপহার দিত কদম ফুল। কিন্তু আজ তা ধীরে ধীরে একেবারেই হারিয়ে যেতে চলেছে। যেন দাগ পড়েছে কদম ফুলের সৌন্দর্যে।
জানা যায়, লাভের অঙ্কের হিসাব মিলানোর জন্য মানুষ আর তার বাড়ির আঙিনায় কদম ফুলের গাছ লাগাতে চাইছে না। কদম গাছের জায়গায় এখন তারা মেহগনি, রেইনট্রিসহ নানা দামি-দামি কাঠের গাছ রোপণে ঝুঁকছে। আষাঢ়-শ্রাবণ দুমাস বর্ষাকাল। বলা হয়ে থাকে, বর্ষা ঋতুতেই জীবনের প্রথম কাব্য রচনা করেন বাংলার কবিরা। এ ঋতু দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় ভাটি বাংলার লোককবি/বাউলরা। আর বর্ষার এ আষাঢ়কে বরণ করতে এমন একদিন হয়তো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে—যে দিন ‘কদম’ ছাড়াই আমাদের মাঝে আষাঢ় আসবে! তবে প্রকৃতির মাঝ থেকে কদমগাছ হারিয়ে গেলেও বাংলা সাহিত্যের রিমিঝিমি আষাঢ় কদম ফুলকে তার সঙ্গী করে রাখবে চিরতরে।
হরিপুর পরিবেশবাদী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অক্সিজেন-এর সভাপতি মোজাহেদুর ইসলাম ইমন বলেন, কদমগাছ আগে যেভাবে পাওয়া যেত, এখন তা আর পাওয়া যায় না। কারো বাড়িতে কদমগাছ থাকলে সেটা কেটে ফেলা হচ্ছে। প্রকৃতির এই ভেষজ গাছ আমাদের সংরক্ষণ করা জরুরি না হলে এই গাছ দিন দিন বিলীন হয়ে যাবে।
ঠাকুরগাঁওয়ের একমাত্র ওষুধ শিল্পপ্রতিষ্ঠান এ আর ল্যাবরেটরিজের (আয়ুর্বেদিক) গবেষক ও হাকীম আব্দুল হাই বলেন, আদিকাল থেকেই কদমগাছের বিভিন্ন অংশ ও এর ফুল প্রাকৃতিক শোভাবর্ধনের পাশাপাশি মানবদেহের নানা রোগের চিকিৎসায় ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ভেষজ ঔষধিগুণে ভরা কদমপাতা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী। এর ব্যবহারে ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরে ইনসুলিনের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে রাখে।
তিনি বলেন, ব্যথানাশক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। কদমের ছাল জ্বরের ওষুধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। পায়ের তালু জ্বলা, ব্রণ সৃষ্ট ক্ষত ও গ্রন্থিস্ফীতি রোগে এর ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। এ ছাড়া কদম ফুল সেদ্ধ করা পানি দিয়ে কুলকুচি করলে মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়।
মন্তব্য করুন