সিমিন হোসেন রিমি
প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০৪:২১ এএম
আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:০৫ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

তামাক আইন সংশোধন প্রয়োজন

তামাক আইন সংশোধন প্রয়োজন

তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তামাক ব্যবহার ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতাসহ বেশ কয়েকটি রোগের কারণ, যা একটি দেশকে উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির দিকে পরিচালিত করে। এ ছাড়া এটির ব্যবহার অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত ক্ষতির অন্যতম কারণ। এসব সমস্যা উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক নির্মূলের ঘোষণা দেন। ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমন ঘোষণার পরেও দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর এবং আশানুরূপ অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি।

বিশ্বের সর্বাধিক তামাক সেবন ও ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। কারণ দেশটির ৩৫.৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন (১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব)। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (জিএটিএস) ২০১৭ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ধোঁয়াযুক্ত (সিগারেট, বিড়ি ইত্যাদি) এবং ধোঁয়াবিহীন (জর্দা, গুল, সাদাপাতা ইত্যাদি) তামাক সেবন করেন। অন্যদিকে দ্য টোব্যাকো আটলাসের তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেন প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার জন; পাশাপাশি পঙ্গুত্ব বরণ করেন প্রায় ৪ লাখ মানুষ।

তামাকজনিত বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। The economic cost of tobacco uses in Bangladesh: A health cost approach, February ২০১৯-এ দেখা যায়, তামাকজনিত ব্যাধি ও অকালমৃত্যুর কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছর ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা বা ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এই বিশাল পরিমাণ প্রতিরোধযোগ্য রোগের পেছনে ব্যয় বাংলাদেশকে অনেকটা পিছিয়ে দিচ্ছে।

অন্যদিকে তামাক উৎপাদনের কারণে দেশের প্রাণ-প্রকৃতিও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তামাক চাষের জন্য প্রচুর পরিমাণে পানির প্রয়োজন হয়, যা পানির সম্পদকে হ্রাস করে। তামাক চাষে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার পানি ও মাটিকেও দূষিত করে। টোব্যাকো অ্যাটলাসের মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর বিড়ি-সিগারেটের বিষাক্ত বর্জ্য হিসেবে ৪০ হাজার ৪৯০ টন বাট এবং প্যাকেট পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ।

তামাকের ভয়াবহ এসব ক্ষতি থেকে বাঁচতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসির আলোকে জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা প্রয়োজন। কারণ বিদ্যমান আইনে ছয়টি দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের এসব দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো দিনদিন তাদের ব্যবসার পরিসর বৃদ্ধি করছে। যেমন বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে পাবলিক প্লেসে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ রাখার অনুমতি রয়েছে। এটি ব্যবহার করে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবহার পরিসর বৃদ্ধি করছে। শুধু আইনের এই দুর্বলতার কারণে ধূমপান না করেও কর্মক্ষেত্রে ৪২.৭ শতাংশ, গণপরিবহনে ৪৪ শতাংশ এবং বাড়িতে ৩৭ শতাংশ পরোক্ষ নারী-পুরুষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। তাই এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা প্রয়োজন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভীষ্ট লক্ষ্য ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি তথা সিএসআর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। তামাক কোম্পানিগুলো তথাকথিত সিএসআরের নামে নিজস্ব প্রচারণা চালায় এবং চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং তামাকের প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে শিশু ও তরুণদের তামাকের প্রতি আকৃষ্ট করে থাকে।

তামাক পণ্য জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কার্যকর করারোপ করা প্রয়োজন। তামাকজাত পণ্যের ওপর উচ্চ কর একইসঙ্গে তামাক ব্যবহার কমাতে এবং সরকারের রাজস্ব বাড়াতে সহায়তা করবে। বর্তমান কর কাঠামোয় কার্যকর করারোপ দেখা যাচ্ছে না। তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে অতিসত্বর কর কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে কার্যকর কর চালু করা প্রয়োজন। সব পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান (DSA)’ নিষিদ্ধ করা। বর্তমানে আইনের এই দুর্বলতা পরোক্ষ ধূমপানের হাত থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করতে পারছে না।

এ ছাড়া তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। কারণ তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হলেও তামাক কোম্পানিগুলো অর্থায়নের মাধ্যমে বিভিন্ন দোকানে শিশু ও তরুণদের তামাকপণ্যে আকৃষ্ট করতে দৃষ্টিনন্দনভাবে তামাকপণ্য প্রদর্শন করে। সংশোধনী প্রস্তাবটি শিশু ও তরুণদের ধূমপানসহ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে সহায়ক হবে।

ই-সিগারেটের মতো এমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টগুলো নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। কারণ এর মাধ্যমে নিকোটিন আসক্তি জন্মায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ ধরনের পণ্যের ব্যবহার বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে দিনদিন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই, যুব সমাজকে রক্ষা করতে এখনই এটি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে করতে হবে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকপণ্যের প্যাকেটে ভীতিকর ছবির আকার বৃদ্ধি করা হলে তামাক ব্যবহারকারীরা তামাক ব্যবহার ছাড়তে উৎসাহিত হয় এবং তরুণরা তামাক ব্যবহার শুরু করতে নিরুৎসাহিত হয়। একই সঙ্গে সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। এতে তামাক পণ্যের সহজলভ্যতা কমবে। ফলে তরুণদের মধ্যে তামাক ব্যবহার শুরু করার প্রবণতা কমে আসবে এবং স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে তামাক ব্যবহারের পরিমাণ হ্রাস পাবে।

আশার কথা হচ্ছে, বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ আবারও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে আইনটির খসড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় হয়ে বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে, হতাশার কথা হচ্ছে, জনস্বাস্থ্য রক্ষার বিবেচনায় আইনটি যে গতিতে সংশোধন হওয়ার প্রয়োজন ছিল সেটি হচ্ছে না। তাই জনস্বাস্থ্যকে অতিকর গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি দ্রুততার সঙ্গে সংশোধনী আনার দাবি জানাচ্ছি।

লেখক: প্রতিমন্ত্রী, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সভাপতিমণ্ডলী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কানে মোবাইল ফোন, ট্রেনে কাটা পড়ে পল্লিচিকিৎসকের মৃত্যু

সিরাজগঞ্জে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২

ঝিনাইদহ-১ উপনির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন নজরুল ইসলাম দুলাল

আটক পাঁচ ভারতীয় নাবিককে মুক্তি দিল ইরান

পরীর ঘরে ছেলের পরে মেয়ে

মাটি খুঁড়তেই মিলল কয়েকশ বছরের পুরোনো নৌকা

বাংলাদেশে সিন্ডিকেটের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যা প্রয়োজন

গরম কমলে বড় আন্দোলনে নামবেন মান্না

পঞ্চগড়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল

নোবিপ্রবিতে সি ইউনিটের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন

১০

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল মোটরসাইকেল আরোহীর

১১

আ. লীগ সরকারের সঙ্গে জনগণ নেই : মান্না

১২

আইপিএলে বাতিল হতে পারে ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’

১৩

জামিন পেলেন কেজরিওয়াল

১৪

নয়াপল্টনে জড়ো হচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা

১৫

‘অসিম ওর ছোট্ট বাচ্চাগুলোকেও ছেড়ে গেল’

১৬

কলেজশিক্ষার্থীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

১৭

স্ত্রীর দাবিতে তরুণীর অনশন, পালালেন আরিফ

১৮

মানিকগঞ্জে চিরনিদ্রায় শায়িত পাইলট রিফাত

১৯

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা / ‘সি’ ইউনিটে পাবিপ্রবিতে উপস্থিতি ৮৩.১৮ শতাংশ

২০
X