প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের এ যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম সারা পৃথিবীর মানুষের কাছেই অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং এটি এখন প্রতিমুহূর্তের সঙ্গী বলা যেতে পারে। প্রযুক্তির এ ঢেউয়ের বাইরে থাকার বাস্তবতা এখন বোধহয় কোনো জাতির নেই। পুরো বিশ্বের প্রতিমুহূর্তের খবর নিমেষেই হাতের মুঠোয় এসে হাজির হয় বিভিন্ন মাধ্যমে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই তৈরি হয় চলমান যে কোনো ঘটনার ভালো-মন্দ নানা প্রতিক্রিয়া। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের ওপর এ মাধ্যমের ভূমিকা ও প্রভাব এখন ব্যাপক। সেই অর্থে বহু সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং প্রভাবিত হওয়ার একটি জায়গা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। দেশের তরুণ প্রজন্মের বিরাট একটি অংশ এ মাধ্যমের দেশীয় কিছু সেলিব্রেটি কর্তৃক প্রভাবিত হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে চিন্তার উদ্রেক করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তো এড়ানো সম্ভব নয়, তবে তরুণ প্রজন্ম যেন তাদের শিকড় অর্থাৎ দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়, সেটিই কাম্য।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নানা সুফল, সুবিধা যে রয়েছে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এর ইতিবাচক দিকের বাইরে নেতিবাচক দিকেরও জন্মও দিয়েছে, যা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশে ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ চলছে— এমন একটি আলোচনার ঝড় সম্প্রতি ওঠে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতেই সম্ভব হয়। যা-ই হোক, সেই আলোচনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ছিল বাঙালি সংস্কৃতির অবক্ষয়, যার জন্য অনেকাংশে দায়ী করা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেটকেন্দ্রিক সেলিব্রেটি গজিয়ে ওঠাকে। অভিযোগ করা হয়, এসব সেলিব্রেটি আমাদের আবহমান বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক নন। তাদের কর্মকাণ্ড শুধু ভাইরাল হওয়া এবং অর্থ উপার্জন। ফলে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা বা সেই চেতনাকে বাঙালি জাতির মননে প্রোথিত করার দায় তাদের নেই। চলছে অমর একুশে বইমেলা। রোববার কালবেলায় এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রুচির বদল ঘটিয়েছে সামাজিকমাধ্যম। বইমেলায় তরুণদের বড় একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কিছু সেলিব্রেটির বই সংগ্রহ করছেন। এসব সেলিব্রেটির বেশিরভাগই মূলত লেখক নন। এমনকি তাদের নানা কর্মকাণ্ড সামাজিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা মনে করি, বইমেলায় কিংবা ভার্চুয়াল জগতে বিরাট অংশের পাঠবিমুখ তরুণ প্রজন্ম আমাদের ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরই সাক্ষ্য বহন করে। এটা ভয়ানক ব্যাপার। কেননা একটি জাতির পরিচয় টিকে থাকে তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে। আর এটি সর্বদাই বয়ে নিয়ে যায় তরুণ প্রজন্ম। রুচির উৎকর্ষ ও অপকর্ষ বিষয়টি তাই সম্পূর্ণ সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। সংস্কৃতির অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে রুচির বিপর্যয় ঘটছে, তা তো এখন নানাভাবে স্পষ্ট। সমাজের শিক্ষিত মানুষ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে বিভিন্ন রকমের অনৈতিক ঘটনা সামনে হাজির হচ্ছে। এর থেকে আমাদের বের হতে হবে। এর জন্য দরকার সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। সমাজসচেতন জাতি গড়ে তোলা। আর এ কাজটি করতে গেলেই বই একটি বড় ভূমিকা রাখবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাঠাভ্যাসের জন্য পাঠাগার উদ্যোগ বাড়াতে হবে। কাজটি শুধু সরকারের একার নয়, প্রতিটি শিক্ষিত-সচেতন মানুষ ও পরিবারের এ দায়িত্বে এগিয়ে আসতে হবে। বই কে লিখেছেন, সেটা মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে জেনারেশন তৈরিতে তা কী ভূমিকা রাখছে। মূলধারার লেখকদের জ্ঞানগর্ভ বই অবহেলিত হওয়া ঠেকাতে পারে শুধু পাঠাভ্যাসসম্পন্ন জাতি গড়ে তোলা।