একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কিছু জিনিস লাগে। মানুষের মৌলিক চাহিদার তালিকা হলো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। তবে আমার বিবেচনায় মানুষের মৌলিকতম চাহিদা হলো—বলতে পারা, প্রতিবাদ করতে পারা, বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা। ‘আমি মানি না’ চিৎকার করে এটা বলার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা যাওয়ার সময় ভারতকে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দুই ভাগ করে দিয়েছে। আজকের বাংলাদেশের মানুষও পাকিস্তান আন্দোলনে শামিল ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই বাঙালি বুঝে যায় এ স্বাধীনতা আমাদের নয়। পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ—পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। এমন অদ্ভূত রাষ্ট্র বিশ্বে বিরল। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দুই অংশের ভৌগোলিক দূরত্বই প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার। তবে দুই অংশের মধ্যে মানসিক দূরত্ব ছিল কোটি কিলোমিটার, আসলে অলঙ্ঘনীয়। ধর্ম ঘোচাতে পারেনি সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দূরত্ব। পূর্ব পাকিস্তানে মানুষ বেশি হলেও শাসকের ভূমিকায় বসে যায় পশ্চিমারা। তারা বন্ধু না হয়ে প্রভু বনে যায়। বাঙালি বুঝে যায়, স্বাধীনতা এলেও তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। ব্রিটিশদের বদলে পাকিস্তানিরা এসেছে মাত্র।
পাকিস্তানিরা প্রথমে আঘাত হানে আমাদের ভাষায়, সংস্কৃতিতে। স্বাধীনতার পরের বছরই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব আসে। প্রস্তাব আসে আরবি হরফে বাংলা লেখারও। পাকিস্তানিদের এ ধরনের প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষের মনে গভীর ক্ষোভের জন্ম দেয়। বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা যুক্তি দিয়ে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ১৪৪ ধারা শিক্ষার্থী রাজপথে নামলে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ অনেকে। তারপর আন্দোলন আরও গতি পায়। আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানিরা নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানেও বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এভাবে ভাষা আন্দোলনের ক্ষোভকে প্রশমিত করা গেলেও বাঙালির হৃদয়ে যে ক্ষোভের আগুন জ্বলে, তা প্রশমিত হয়নি। বরং দিনে দিনে তা আরও তীব্র হয়েছে। বায়ান্নর আন্দোলন শুধু ভাষার নয়; সে আন্দোলন ছিল আসলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের সূচনা। সেই সংগ্রামের পথ বেয়েই ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় আসে ’৭১। আর একাত্তরে ৯ মাসের রক্ষক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে আসে স্বাধীনতা।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নিছক একটি দিনের আন্দোলন বা শুধু ভাষার আন্দোলন নয়। পাকিস্তানি শাসকরা বারবার আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের কৃষ্টি, আমাদের ঐতিহ্যের ওপর হামলা করেছে। বারবার আমরা একুশের চেতনায় রুখে দাঁড়িয়েছি। এই প্রতিবাদী চেতনা আমাদের এগিয়ে দিয়েছে। ৭২ বছর পরও একুশে ফেব্রুয়ারি আজো সমান প্রাসঙ্গিক। শুধু বাংলাদেশ নয়; বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষ আজ একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে অনুপ্রেরণা নেয়। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এসেছে স্বাধীনতা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল উদার, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ একটি রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। তার কন্যা শেখ হাসিনা দিয়েছেন অর্থনৈতিক মুক্তি। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের বিস্ময়। একটি সমৃদ্ধ ও আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে আজ বাংলাদেশের অন্যরকম মর্যাদা। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রশ্নে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে, বেছে নেওয়ার স্বাধীনতার বিবেচনায় বাংলাদেশ এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। একুশের মূল যে চেতনা, ‘আমি মানি না’ চিৎকার করে এটা বলতে পারা এখন কঠিন। মতপ্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে অনেকটাই। গণতান্ত্রিক পরিসরও ছোট হয়ে আসছে। অনেক দিন ধরেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া অংশগ্রহমূলক নয়।
তার চেয়ে বড় কথা হলো—ব্রিটিশরা গেছে, পাকিস্তানিরা গেছে; কিন্তু আজো বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি তার প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি। এখন আমাদের শত্রু আমরাই। ইংলিশ মিডিয়াম, ইংলিশ ভার্সন, মাদ্রাসা শিক্ষা—নানামুখী কারিকুলামের চাপে বাংলা আজ কোণঠাসা। হেফাজতের চাপে পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে হামলা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা করতে হয় পুলিশেরে ব্যারিকেডের ভেতরে। সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিকশিত তো হয়ইনি, বরং কোণঠাসা হয়েছে। আবহমান কাল ধরে চলে আসা গ্রামবাংলার যাত্রাপালা, কবি গান আজ উঠেই গেছে প্রায়। গ্রামের মানুষের অন্যতম বিনোদন ধর্মের নামে অশ্লীল ওয়াজ।
একুশের চেতনা হলো সব ধর্মের, সব মানুষের স্বাধীনতা। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারও ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া নয়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছে। এখন সাংস্কৃতিক মান উন্নয়ন করতে হবে। শুধু রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই শেষ কথা নয়। একুশের চেতনা বাস্তবায়নে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক, উন্নত সাংস্কৃতিক চেতনার পরমতসহিষ্ণু রাষ্ট্র গড়তে হবে। একুশের প্রেরণায় সেই স্বপ্নের সোনার বাংলার পথেই হোক আমাদের যাত্রা।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ