কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ০৬:২০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর দাবি ব্যবসায়ীদের

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা অপরিহার্য। এটি শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ থাকলে বা বিকল্প জ্বালানি উৎসের (যেমন নবায়নযোগ্য শক্তি) ওপর বিনিয়োগ করলে আমদানিনির্ভরতা কমে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার হয়।

শিল্পকারখানা-বিশেষ করে টেক্সটাইল, সিমেন্ট, সার এবং অন্য ভারী শিল্প পরিচালনার জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের প্রয়োজন হয়। জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়- যা দেশের রপ্তানি আয়, কর্মসংস্থান এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়াও বিদেশি উদ্যোক্তারা জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা না পেলে এদেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয় না। ফলে এফডিআই কমে যায়, যা দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এ অবস্থায় জ্বালানি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথটি দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বাড়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা থেকে দেশকে সুরক্ষিত রাখে বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি জ্বালানি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যাংক সুদ ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান, রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকখাত মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু ও আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে সহসভাপতি প্রার্থী ব্যবসায়ী নেতা ও ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিফ শামীম।

দেশের শীর্ষ এই তিন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাই মনে করেন, জ্বালানি নিরাপত্তায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি হলো এমন একটি অবস্থা-যখন কোনো দেশ তার প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে এবং বিদেশি উৎস যেমন- আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো জ্বালানি সংকটের ঝুঁকি কমানো এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জ্বালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হলে অভ্যন্তরীণ জ্বালানি উৎসের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য দেশের নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, তেল বা অন্য খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান এবং উত্তোলন বৃদ্ধি করার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে হবে বলে মনে করেন তারা।

এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার বিশেষ করে সৌরশক্তি, জলবিদ্যুৎ বা বায়ুশক্তির মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের ব্যবহার বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এগুলো পরিবেশবান্ধব, অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী এবং দেশের নিজস্ব সম্পদ। এই খাতগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ালে আমদানিকৃত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর চাপ কমে আসবে।

এ প্রসঙ্গে আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, যেকোনো উৎপাদনমুখী শিল্পের জন্য গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট একটি গুরুতর সমস্যা এবং এর সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তিনি গ্যাস-বিদ্যুৎতের অভাবে অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। অবিলম্বে এর সমাধাম না হলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য সরকারের নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, এসব দিক বিবেচনায় এলডিসি উত্তরণের সময়সীমা ছয় -বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করা হচ্ছে। অবকাঠামো খাত উন্নয়নে আমাদের আরও প্রস্তুতি দরকার।

বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, আগামী একবছরের মধ্যে যদি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ করা যায় তবে আমেরিকার বাজারে আমরা একক আধিপত্য ধরে রাখতে পারবো। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আগামী ৭- ৮ বছরের মধ্যে আমাদের নিজস্ব গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে যাবে। বছরে ৮-৯ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে এলএনজি আমদানিতে। অথচ আমাদের প্রস্তুতি কোথায়? তিনি বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঙ্কট তৈরি পোশাকখাতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে গ্যাস নির্ভর শিল্পে। দেশে বর্তমান দুটো ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল চালু আছে। এই অবকাঠামো উন্নয়নে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।

সাকিফ শামীম বলেন, জ্বালানির দাম বাড়লে বা আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ কমে গেলে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে এবং পন্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। সুতরাং, একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা অপরিহার্য। এজন্য, আমাদের নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষ করে অপশোর গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি অথবা বৈদেশিক বিনিয়োগের উদ্যোগ নিতে হবে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর জোর দিতে হবে। গ্যাসের ঘাটতি দীর্ঘদিনের। জ্বালানি সংকটে ধুঁকছে ৩৩% বিদ্যুৎকেন্দ্র। ডলার সংকটের কারণে আমদানির জন্য নিয়মিত ডলার পাওয়া কষ্টসাধ্য হচ্ছে। তবে বর্তমান সরকারের উদ্যোগ গ্রহণের ফলে এ অবস্থার উন্নতি সাধন হয়েছে। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪৭ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক। গ্যাসভিত্তিক ৬৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১১ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা পালাক্রমে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বাকি ৮ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার মধ্যে গড়ে উৎপাদিত হচ্ছে ৬ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। দিনে এখন ৩৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে সব মিলিয়ে ৩০০ কোটি ঘনফুট।

তিনি বলেন, গ্যাসের সরবরাহ আসে মূলত দুটি উৎস থেকে। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন ও বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি। কিন্তু বেশি দাম দিয়েও এখন গ্যাসের অভাবে অনেক কারখানা চালানো কষ্টসাধ্য হচ্ছে। এর মধ্যে এলএনজি সরবরাহ কমে গেছে। আমদানি করা এলএনজি রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। নানা সঙ্কটে এ দুটি টার্মিনালও সব সময় সক্রিয় থাকে না।

সাকিফ শামীম বলেন, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পরিবর্তে খোলা বাজার বা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা হচ্ছে। স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম অনেক বেশি থাকে, যা সামগ্রিক আমদানি ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেয়। এ অবস্থায় এলএনজি আমদানির জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্থায়ী ও বৃহৎ অবকাঠামো তৈরি করা হলে তা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে খরচ কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে যা এলএনজি আমদানির ব্যয় কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে। ভাসমান টার্মিনালের পরিবর্তে স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল বা ল্যান্ড-বেজড টার্মিনাল নির্মাণ করা হলে দীর্ঘমেয়াদে আমদানি খরচ কমে আসবে। এই ধরনের টার্মিনালের ধারণক্ষমতা অনেক বেশি থাকে এবং এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ খরচও তুলনামূলকভাবে কম। এছাড়া পাইপলাইন নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ করতে হবে। পর্যাপ্ত অবকাঠামো থাকলে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সাথে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আমদানি করতে পারবে।

সাকিফ শামীম আরও বলেন, গত ২০ বছরে বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। ছোট ছোট কিছু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে বাপেক্স। রাষ্ট্রীয় গ্যাস অনুসন্ধান সংস্থা- বাপেক্সকে কার্যকরি এবং শক্তিশালী করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সমুদ্রসীমা বিজয়ের এক যুগ পরও বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানে সুখবর নেই। অপরদিকে মিয়ানমার বংগোপসাগরে রাখাইন বেসিনে অপশোর গ্যাস উত্তোলনে কার্যকরীভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় গত বছর ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলো না চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর বাইরে ফার্নেস তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে ৬৫টি। মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৬ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এর মধ্যে ২৫ থেকে ২৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালানির অভাবে নিয়মিত উৎপাদন করতে পারছে না। দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর না দিয়ে আমদানির দিকে ঝোঁকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ জ্বালানিস্বল্পতা। এ কারণে শিল্পোৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। সেই সঙ্গে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিও অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। অর্থনীতিতে ঝুঁকির অন্যান্য ক্ষেত্র হচ্ছে প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া, সম্পদ ও আয়বৈষম্য এবং সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়া ও বেকারত্ব। তিনি বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য সৌর শক্তি, পারমাণবিক শক্তি ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দেওয়া প্রয়োজন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২২ আগস্ট : আজকের নামাজের সময়সূচি

স্বাস্থ্য পরামর্শ / রান্নায় সরিষার তেলে ঝুঁকি ও অসংক্রামক রোগ

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে আবারও দুর্ঘটনা, নিহত আরও ৩

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে ৫৮% মার্কিনি : রয়েটার্স

স্পেনের বাইরে লা লিগার ম্যাচ খেলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাল ফুটবলাররা

দুবাইয়ে যাওয়ার ৪ মাস পরই ৩ কোটির লটারি জিতলেন প্রবাসী

এনজো ফার্নান্দেজের মুখে রিয়াল মাদ্রিদের নাম, বাড়ছে গুঞ্জন

কেশবপুরে নারী সমাবেশ/ / ধানের শীষের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি

সাভারে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের দাওয়াতি মাসের শুভ উদ্বোধন

তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন, নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীও হবেন : এ্যানি

১০

দলবদলের বাজারে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর রেকর্ড ভাঙা খরচ

১১

ধর্মগড় সীমান্তে বিজিবির হাতে আটক চার বাংলাদেশি

১২

হাসিনাকে ফেরত পাঠানো নিয়ে মোদিকে ওয়েইসির প্রশ্ন

১৩

জাকসুতে প্যানেল দ্বন্দ্ব, পদত্যাগ করে বাগছাস নেতার মিষ্টি বিতরণ

১৪

সৈয়দপুর বিমানবন্দরে যাত্রীসেবা আন্তর্জাতিক মানের করতে চাই : বেবিচক চেয়ারম্যান

১৫

‘আ. লীগ বিদ্যুৎ খাতে চুরির লাইসেন্স দিয়েছিল’

১৬

আ.লীগ নেত্রী রুনু গ্রেপ্তার

১৭

ইসির ইউটিউব চ্যানেল চালু, মিলবে যেসব তথ্য

১৮

শিশু ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ, গ্রেপ্তারের দাবি শিক্ষার্থী

১৯

চার বিভাগে ভারী বর্ষণের সতর্কতা জারি, পাহাড়ধসের আশঙ্কা

২০
X