মোস্তফা কামাল
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৪, ০৩:৪৭ এএম
আপডেট : ০২ মার্চ ২০২৪, ০৭:৩৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ধর্ষক-শিক্ষক-ভক্ষক: দর্শক চারদিক

ধর্ষক-শিক্ষক-ভক্ষক: দর্শক চারদিক

পাবনায় স্বামীকে জিম্মি করে স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণকারীদের পরিচয় শুধুই ধর্ষণকারী, বখাটে, রূপে বা দেখতে মানুষ। ধর্ষক সেলিম, শরীফ, রাজীব, রুহুল, লালন, সিরাজদের মধ্যে বাস-ট্রাকের হেলপার-ড্রাইভার ধরনের কেউ নেই। দলীয় ক্যাডার, ছাত্র বা শিক্ষকও নেই। ওই দম্পতি জুমার রাতে একটি মাহফিল শুনে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ফিরছিলেন। মাহফিল শুনে রিকশায় আত্মীয়ের বাড়িতে ফেরার পথে এ তরুণরা তাদের আটকায়। জানতে চায়, তারা স্বামী-স্ত্রী কি না? আরও নানান প্রশ্নে বিভ্রান্ত করতে থাকে। একপর্যায়ে অস্ত্রের মুখে স্বামীকে আটকে ওই নারীকে পাশের একটি ভুট্টাক্ষেতে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে। ওই নারীর স্বামী জিম্মিদশা থেকে ছুটে স্থানীয় বাসিন্দাদের বিষয়টি জানান। পরে এলাকাবাসী ধাওয়া দিয়ে তরুণদের একজনকে আটকায়। কিছু লাথি-উষ্ঠা-কিল-ঘুসি মেরে ছেড়ে দেয়। বাকিরা চম্পট দেয় আগেই। ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুলিশ তাদের ধরতে পারছে না বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার নিয়ে প্রশাসনের তেমন তোড়জোড় আছে বলে মনে হচ্ছে না তার। সংক্ষেপে ঘটনা এদ্দুরই।

ঘটনাটি এমন সময়ে ঘটেছে যখন চারদিকে শিক্ষাঙ্গনে একের পর এক ধর্ষণের ঘনঘটা। রাজধানীর নামকরা ভিকারুননিসা স্কুল-অ্যান্ড কলেজ আর ঢাকা লাগোয়া দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর। মাঝে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ, পুণ্যভূমি সিলেটের এমসি কলেজ বা পাহাড়ের সৌন্দর্যঘেরা নয়নাভিরাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। অথবা ফেনীর সোনাগাজীর ফাজিল মাদ্রাসা। পরিমল আর মানিক-মোস্তাফিজে সব একাকার। কদিন পরপর ঘটে চলা এসব লিখতে গেলে কলম থেমে যায়। বলতে গেলে জিহ্বা আটকে যায়। শুধু দর্শক হয়ে থাকার উপায়ও নেই একজন গণমাধ্যমকর্মী, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকার কারণে। পরিমল জয়ধরের পরে, ভিকারুননিসা নূন স্কুলের আরেক শিক্ষক মুরাদ হোসেনকে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগের প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়। এ মাসেই গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন বিভাগের একজন ছাত্রী। ঠিক এক মাস আগে নোয়াখালীর চাটখিলে চার ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে মাদ্রাসা শিক্ষক সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বলাৎকারের শিকার শিশুদের বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। আগের মাসে মানিকগঞ্জে ৯ বছর বয়সী শিশুকে যৌন নির্যাতন করে গ্রেপ্তার হন জাহাঙ্গীর নামের আরেক মাদ্রাসা শিক্ষক। একেবারে শিশু থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী, কেউই যৌন নির্যাতন থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। খুব এক্সট্রিম পর্যায়ে না গেলে এসব খবর সামনে আসে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ যা করার করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুল মতিনও বাদ দেননি এ কর্ম।

বাস বা লঞ্চ টার্মিনালে ধর্ষণ, চলন্ত বাসে-ট্রেনে ধর্ষণের মতো ঘটনার সঙ্গে আমরা পরিচিত। কোথাও কোথাও সহপাঠী বা প্রেমিক কমিউনিটির কারও কারও এ ক্রিয়া-কর্মের খবর মেলে। মাঝেমধ্যে মিলছে শিক্ষাগুরুদের কায়কারবারও। এ কাজে শিক্ষক না শিক্ষার্থী, কে বেশি এগিয়ে?—এ নিয়ে কিছু জরিপ কাজ আছে। কাজটি কে কার কাছ থেকে শিখছে এ আলোচনাও আছে। তবে সম্প্রতি বেশি এগিয়ে শিক্ষকরা। দুয়ের মাঝে প্রতিযোগিতা—সেই তুলনায় না গিয়ে বাস্তবতা হচ্ছে, শিক্ষক আর শিক্ষার্থী উভয়ই ধাবমান-আগোয়ান। জাহাঙ্গীরনগরে স্বামীকে আটকে স্ত্রীকে ধর্ষণের মতো ঘটনা, সিলেট এমসি কলেজসহ আরও কোনো কোনো শিক্ষালয়ে ঘটেছে। জাহাঙ্গীরনগরে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করে পার্টি দেওয়ার ঘটনা আরও পুরোনো। এ কাজে শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কে এগিয়ে এ নিয়ে নানান কথা আছে। কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এমন অদম্য এগিয়ে যাওয়ার রসায়নে রিকশা ড্রাইভারের পুলক জাগলে আটকাবে কে? ক্যাম্পাসে অটোচালকের দ্বারা নিপীড়নের শিকার হওয়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী, যা মর্মে মর্মে মালুম করেছে। গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনাও বেশি সামনে গড়ায়নি। হরহামেশা চলতে থাকা এমন কাণ্ডকীর্তির সব খবর আসে না। চেপে যাওয়া বা আড়াল করার একটি প্রবণতা আছে। অভিযোগ করলে উল্টো অভিযোগকারীকেই দোষারোপের সংস্কৃতিসহ পড়াশোনায় বড় আঘাত আসতে পারে ভেবে চুপ থাকার ঘটনা অনেক। সেখানে শোষক শ্রেণি বড় কড়া এবং যূথবদ্ধ। তাই দুঃখজনক নানা প্রশ্ন ও সামাজিকতার অনিবার্য বাস্তবতায় ভুক্তভোগীদের ধর্ষণ-নাজেহালের অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে হয়। যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলে মাঝেমধ্যে কিছু অভিযোগ পড়ে। ঘটনার ভয়াবহতা ও জঘন্যতার কারণে কিছু কিছু সামনে এসে যায়। ২০১১ সালে ভিকারুননিসার শিক্ষক পরিমল জয়ধরের ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ দেশে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগরে ঘটল আবারও ধর্ষণের ঘটনা। ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সিলেটের এমসি কলেজের সামনে থেকে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও আলোচিত। এর আগের বছর ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাতকে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার রুমে শ্লীলতাহানির কথা এখনো অনেকের মনে থাকার কথা। মাঝে বা আগে-পরে আরও নানা ঘটনার ঘনঘটায় সম্প্রতি আবারও যোগ হলো, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মুরাদ হোসেনের নাম।

শিক্ষা প্রশ্নে শিক্ষকরা কখনো কখনো মা-বাবার চেয়েও বড় অভিভাবক। নিরাপত্তার জায়গাও। বাস্তবটা এখন বড় নিষ্ঠুর। যেখানে শিক্ষকরাই নিরাপদ নন, সেখানে বাস-ট্রাক-লঞ্চ শ্রমিক তো নস্যি। স্টেশন, ঘাট, টার্মিনাল আর বিদ্যাপীঠের তফাতটা হয়ে পড়ছে মামুলি। শুধু আইন-আদালত দিয়ে এই অনাচার রোধ করা অসম্ভব, তা এরই মধ্যে প্রমাণিত। বিচারের প্রতি ওই ভয় উঠে গেছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান তো আছেই। ভয় পাচ্ছে না কেন ধর্ষকরা? ধর্ষণ মানেই ধর্ষণ। আর এ কর্মের কর্মীর পরিচয় ধর্ষক হওয়াই বাঞ্ছনীয়। হোক শিক্ষক আর শিক্ষার্থী, ড্রাইভার আর হেলপার। এদের বাঁচানো বা এদের পক্ষে সাফাই গাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত। ভিকারুননিসার মুরাদকেও বাঁচানোর চেষ্টা হয়েছে বিদ্যাপীঠটির অভ্যন্তর থেকে। বলা হয়েছে, ‘অভিযোগটি এক বছর আগের। এরই মধ্যে তিনি হজ করে আসার পর এরকম ঘটনা আর ঘটেনি বিধায় তাকে বরখাস্ত না করে শেষবারের মতো সতর্ক করার সুপারিশ পর্যন্ত জানানো হয়েছে। এমন আশকারার সমান্তরালে আরেকটি বেদনার কীর্তি হচ্ছে—তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ডান কোনায় স্বাক্ষরকারী তিনজনই নারী। লজ্জা-নৈতিকতার কোনো পর্যায়ের তারা!

যৌন নিপীড়নে শিকারদের বড় অংশই বাকি জীবনে এই ভয়াবহ ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। আমাদের দেশে এসব মানুষের কথা বলার, চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। এই নিপীড়ন একেকটা মানুষের জীবনকে তছনছ করে দেয়। দর্শকের গ্যালারিতে না থেকে, সবারই উচিত এই নিপীড়ন প্রতিরোধে সোচ্চার হওয়া। একেকটি ঘটনা আলাদা আলাদাভাবে ডিল করলে চলবে না। কারণ এতে করে আইসবার্গের শুধু চূড়াটিই ধরা পড়বে, সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। যৌন হয়রানি বন্ধে পূর্ণাঙ্গ আইনের পাশাপাশি অপরাধের সংজ্ঞা, শাস্তি ও বিভিন্ন ধাপে পরিবর্তন জরুরি। যৌন হয়রানি বন্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিকারের সুনির্দিষ্ট আইন জরুরি। রাস্তাঘাট-স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির ঘটনা চলছে। অথচ বিদ্যমান আইনে এসব অপরাধের বিষয়ে অনেক ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া যৌন হয়রানির শিকার হলে লোকলজ্জার ভয়ে অনেকে মামলা করতে চায় না। অনেকে মামলা করলেও সাক্ষীর অভাবে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। শিক্ষাঙ্গনের বিষয়টি আরও আলাদা। কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন রোধে কিছু আইন আছে বাংলাদেশে, কিন্তু ডেভেলপমেন্ট সেক্টর বাদে সেগুলো কেউই তেমন জানে না, মানেও না। সেক্সুয়াল এক্সপ্লোটেশন অ্যান্ড অ্যাবিউস বিষয়ে স্ট্রিক্ট কোড অব কন্ডাক্ট থাকা উচিত। আর সবার আগে দরকার নৈতিকতা।

লেখক: ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

টানা চারটি লিগ জয়ীদের এলিট ক্লাবে ম্যানসিটি

হেলিকপ্টার পাওয়ার বিষয়ে যা জানাল রেড ক্রিসেন্ট

রাইসির সঙ্গে হেলিকপ্টারে আর যারা ছিলেন

উন্নয়নের নামে রাতের আঁধারে শাহবাগে গাছ কাটার অভিযোগ

সবশেষ বিহারে ছিলেন এমপি আনার

‘অভিবাসী কর্মীদের জন্য আরও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাজ করছে সরকার’

ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিখোঁজ, যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র

স্বামীর মোটরসাইকেলের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে নারীর মৃত্যু

তবুও প্রার্থী হলেন সেই নাছিমা মুকাই 

গাজীপুরে কারখানার ১০ তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে নারী শ্রমিকের মৃত্যু

১০

রাজশাহীতে আগুনে পুড়ে ছাই ১০ বিঘার পানের বরজ

১১

বিয়েবাড়ি থেকে কনের পিতাকে তুলে নিয়ে টাকা দাবি

১২

ঠাকুরগাঁওয়ে নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর , এলাকায় উত্তেজনা

১৩

ঈশ্বরদীতে ফেনসিডিলসহ রেল নিরাপত্তা বাহিনীর সিপাহি আটক

১৪

এমপি আনোয়ার খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ওসিকে নির্দেশ

১৫

উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ১১৬ কোটিপতি প্রার্থী : টিআইবি

১৬

রাইসির জন্য দোয়ার আহ্বান

১৭

‘শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুদৃঢ় হয়েছে’ 

১৮

প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা সিটির কাছেই থাকল

১৯

বাংলাদেশকে লক্কড়ঝক্কড় দেশে পরিণত করেছে আ.লীগ : প্রিন্স

২০
X