প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ছিলেন শিক্ষাবিদ, ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ এবং লেখক। তিনি ১৯২০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ছেদন্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আবুল কাসেম বরমা হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি (অনার্স) এবং এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারার পদে যোগ দেন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন।
আবুল কাসেমের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ। ছিলেন এর সাধারণ সম্পাদক। সংগঠনটির মাধ্যমে সর্বপ্রথম তিনি বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবি উত্থাপন করেন। এই লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা: বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এই মূল পুস্তিকায় আবুল কাসেম প্রণীত একটি সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবনাও ছিল এবং তাতে ছিল বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম এবং পূর্ব বাংলার অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি। তারই উদ্যোগে তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনে নেতৃত্ব দেয়। নূরুল হক ভূঁইয়াকে সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক এবং আবুল কাশেমকে কোষাধ্যক্ষ করা হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদই ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে এবং ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করে। ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে আবুল কাসেম ছিলেন আন্দোলনের মধ্যমণি। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবির সপক্ষে ব্যাপক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির পক্ষে যুবসমাজ এবং বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্রদের সমর্থন লাভে তার সাফল্য ছিল অভাবনীয়। ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত প্রথম প্রতিবাদ সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট সংঘটনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এই ধর্মঘটের ফলে তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকার বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। তিনি ছিলেন বাংলা সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। তার সম্পাদনায় পত্রিকাটি ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। তমদ্দুন মজলিশের মুখপত্র হিসেবে এই পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের আদর্শ ও লক্ষ্য প্রচারে সক্রিয় ছিল। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটি চালু থাকে।
ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ আবুল কাসেম কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় বাংলা মাধ্যম প্রবর্তনের অপরিহার্যতা উপলব্ধি করেন
এবং এ উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকায় ১৯৬২ সালে বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে বাংলা মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভের দ্বার উন্মুক্ত হয়। তিনি দীর্ঘ ১৯ বছর (১৯৬২-৮১) বাঙলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এর অধিকাংশ সময় তিনি কলেজ থেকে কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ১৯৯১ সালের ১১ মার্চ ঢাকায় মারা যান।