শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৪, ০২:৩১ এএম
আপডেট : ১২ মার্চ ২০২৪, ০৮:৫১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আমরা রোবট দিয়ে দেশ চালাতে চাই!

আমরা রোবট দিয়ে দেশ চালাতে চাই!

এভাবে পরিচয় করিয়ে দিলে কেমন হয়: নাম-সোফিয়া, জন্ম-১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬। জন্মস্থান হংকং, সম্প্রদায়-হিউম্যানয়েড রোবট। শিক্ষাগত যোগ্যতা-সুপার হিউম্যানয়েড। নাগরিকত্ব-সৌদি আরব। হ্যাঁ, সৌদি আরব ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে সোফিয়াকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। সৌদি আরবে নাগরিকত্ব বড়ই কঠিন, সেই সৌদি সোফিয়াকে নাগরিকত্ব দিয়ে নিজেদেরই ধন্য করেছে। হিউম্যানয়েড রোবট সোফিয়াকে দিয়ে শুরু করার কারণ সে ২০১৭ সালে ঢাকায় এসেছিল। তার সঙ্গে এসেছিলেন তাকে তৈরি করা (বায়োলজিক্যালি পিতা না হলেও তাকে তৈরি করেছেন) ডেভিড হাডসন। সোফিয়া যখন বাংলাদেশে এসেছিল তখন তার বয়স ছিল এক বছর। বলা যায় শিশুকালে। তখনই আলাপ-আলোচনায় প্রশ্নোত্তরে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। সেই সোফিয়া এখন রকেটের গতিতে নিজেকে আপডেট করছে, অর্থাৎ জ্ঞানে-চিন্তায়-সংবেদনশীলতায় সমৃদ্ধ হচ্ছে। সোফিয়ার মতোই তৈরি হয়েছে অ্যামেকা, আলেক্স-সির মতো বুদ্ধিমান রোবট। আরও হচ্ছে। প্রতিটি মানুষকে আলাদাভাবে চিনতে পারা, প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া থেকে শুরু করে রসবোধ, এমনকি দুঃখ-বেদনাও ঢুকে যাচ্ছে রোবটের শরীরে। রোবট এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে শপিং মল, মিউজিয়াম এমনকি ইউনিভার্সিটিতে যারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট হিসেবে পরিচিত। মানুষের যেমন ভুলভ্রান্তি থাকে, এই রোবটদের সেরকম ভুলভ্রান্তি নেই। নিখুঁত, নিরলস তাদের কাজ। রোবট ইঞ্জিনিয়াররা বলছেন, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যেই, অর্থাৎ আগামী ছয় বছরের মধ্যে মানুষের হেন কোনো গুণাবলি নেই যা রোবটের মধ্যে প্রবেশ করবে না। মানুষের দেহের যে কোনো ধরনের রোগবালাই রোবট মুহূর্তের মধ্যে চিহ্নিত করে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। সম্প্রতি বিল গেটস একটি নিবন্ধে জানিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে রোবট চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিপ্লব এনে দেবে। যে কারণে মানুষের শরীরের কোষগুলো মরে যায় এবং বার্ধক্য দেখা দেয়, তা রোবট চিহ্নিত করে ফেলবে। অর্থাৎ ইন্টারনেটের পর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সহযোগিতায় আরও একটি প্রযুক্তি বিপ্লবের মুখে আছে বিশ্ব।

বর্তমান রোবটগুলো এআই জেনারেটেড হওয়ায় প্রতিমুহূর্তে তার বুদ্ধিমত্তা-ইনফরমেশন স্তর অবিশ্বাস্য গতিতে আপডেট হচ্ছে। অর্থাৎ এমন একপর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে, মানুষের চেয়ে রোবট সর্বার্থে নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠছে। এর বাণিজ্যিক উৎপাদনও শুরু হয়েছে। জার্মানি, তাইওয়ান, হংকং, জাপান, রাশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে উন্নত দেশগুলো রোবট উৎপাদন শুরু করেছে। ভারতও পিছিয়ে পড়তে রাজি নয়। গত সপ্তাহে ভারতের কেরালা রাজ্যের রাজধানী থিরুভানাথপুরামের কেটিসিটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে প্রথমবারের মতো আইরিস বা ইরিস নামের এক রোবটকে স্কুল শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত করা হয়েছে। কেটিসিটি গোটা ভারতের একটি মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভারতেরই দুটি শিক্ষাবিষয়ক ল্যাবের উদ্যোগে এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর রোবটটি তৈরি করা হয়। যদিও রোবটটি প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। কারণ সে অনেক শব্দ হলে সে তখন ভয়েস ডিটেক্ট করতে পারে না। চোখ না থাকায় মানুষকে চিহ্নিত করতে পারছে না। কিন্তু পারবে। শুরু তো করেছে! অচিরেই যে ভারত সুপার হিউম্যানয়েড রোবট তৈরিতে সক্ষম হবে, তা বলাই যায়। তার কারণ সময়মতো শুরু করেছে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংও ভারতের হাতে শুরু হয়নি। প্রথম সফটওয়্যার কনফারেন্সের আয়োজন করেছিল ন্যাটো ১৯৬৮ সালে। ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেলসিলভানিয়ায় প্রথম সফটওয়্যার ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ ভারত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ভারত সময়ের বিষয়টি বুঝতে পেরেছে যে, প্রযুক্তির আপডেটে কোনোক্রমেই পিছিয়ে থাকা যাবে না। তাই দেশটি ন্যাশনাল রোবটিক মিশন প্রোগ্রামের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। বিশ্বের শিল্প রোবটের ঘাঁটি তৈরি করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট তৈরিতে অনেক এগিয়ে গেছে মহারাষ্ট্রের অটোফিনা রোবটিকস। আরও বেশ কিছু সময়োপযোগী উদ্যোগ রয়েছে, আমরা সে আলোচনায় না যাই।

এ নিয়ে মাথায় একটা ভিন্ন চিন্তা ঢুকল। ইচ্ছা করলে স্যাটায়ার হিসেবে নিতে পারেন, আবার এর বাস্তবতাও ভেবে দেখতে পারেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমরা কতটা এগিয়েছি, উন্নত প্রযুক্তির দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারব কি না, অথবা দ্বারস্থ হয়েই থাকতে হবে কি না, সে হিসাব পরে। কেমন হয় যদি অদূর ভবিষ্যতে আমরা প্রশাসনে কনসালট্যান্ট বা অ্যাডভাইজার যে কোনো নামে সুপার হিউম্যানয়েড রোবট বসিয়ে দিতে পারি? বাংলাদেশে রোবটের শাসন ছাড়া আর কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না। রোবটের মামা-ভাগিনা বা স্ত্রী-শ্যালক নেই, তাই কারও প্রতি স্বজনপ্রীতি থাকবে না। রোবটের পেটে ক্ষুধা নেই, তাই সে ঘুষ খাবে না। রোবটের ভালো পোস্টিংয়ের লোভ নেই, তাই কোনো সরকারের পক্ষ নিয়ে অনিয়ম করবে না। রোবটের আরাম-আয়েশ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, তাই সে মানিলন্ডারিং করে উন্নত দেশে বাড়ি বানাবে না; দেশের রাজস্ব আয়, বৈদেশিক ঋণের টাকা লুটপাট করবে না, অপব্যয় করবে না। সে নির্লিপ্ত থেকে পরামর্শ দেবে আর জাতি সেই পরামর্শ অনুসারে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এতে কিন্তু জনগণের আস্থাও ফিরবে। রোবটের পরামর্শ অনুসারে কাজ করলে, জনগণও আর সত্য-মিথ্যা নানা অভিযোগ তুলে সহিংস হয়ে উঠবে না। কারণ আস্থাই হলো সব। মানুষ আস্থা পেতে চায়, তা যেখান থেকেই আসুক। এই আস্থা সম্পর্কে রোবটের বাইরের একটি ঘটনা বলি। আরজ আলী মাতুব্বরের বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গি বরিশালের অনেক মানুষ পছন্দ করত না। কিন্তু তিনি পেশায় ছিলেন আমিন বা চেইনম্যান। হতদরিদ্র মানুষ। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় বহু মানুষের জমি নিয়ে গোলমাল ফ্যাসাদ লেগেই থাকত। কেউ কারও সীমানার হিস্যা মানে না। তখন খোঁজ পড়ত আরজ আলী মাতুব্বরের। নির্লিপ্ত, নির্লোভ, পক্ষপাতহীন মাতুব্বর বহু বড় বড় জমি নিয়ে ভেজাল মিটিয়েছেন। কারণ তার ভূমির মাপ কেউ অস্বীকার করত না দক্ষতা ও পক্ষপাতহীন অবস্থানের কারণে। বহু রক্তারক্তি আরজ আলী মাতুব্বরের কারণে সেটলড হয়েছে। এর নাম আস্থা! রোবট মানুষ না। তাই ভবিষ্যতের মানুষ রোবটের ওপরই আস্থা রাখতে চলছে।

এখন একটু সিরিয়াস কথা বলি। আমার কোনো প্রযুক্তিজ্ঞান নেই। কিন্তু সাধারণ কমনসেন্স থেকে বলি, যা বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে জেনেছি। শিল্পোন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবটিকসে অনেক পিছিয়ে আছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট আর হিউম্যানয়েড রোবটের মধ্যে পার্থক্য আছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবটকে অনেকটা দক্ষ স্বয়ংক্রিয় শিল্প শ্রমিক বলা যায়। অনেক ধরনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট আছে। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে বটে, সেই তুলনায় এই প্রযুক্তি গুরুত্ব পায়নি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। যদি এখনই প্রতিযোগিতার মানসিকতা নিয়ে দেশ না নামতে পারে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের তরুণ কর্মশক্তিও অকেজো হয়ে পড়বে। সেটা কৃষি থেকে গার্মেন্টস সব ক্ষেত্রে। এজন্য এখনই প্রয়োজন অসংখ্য সায়েন্স ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা। সেই মাত্রার উদ্যোগ কিন্তু মোটেই চোখে পড়ছে না। সরকার এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু অতি দুঃখজনক সত্য হলো, এর কোনোটাই আধুনিক বিশ্বে তাল মেলানোর মতো নয়। এটি আমার কথা না, খোদ কোনো কোনো প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মুখ থেকে শোনা। তাই আগামী বিশ্বে উন্নত দেশগুলোর পাশে দাঁড়াতে এখনই গা-ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ানো প্রয়োজন। সুপার হিউম্যানয়েড রোবট না হোক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট আপডেট ও সৃষ্টিতে তো মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে!

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আলুর হিমাগারে মিলল লাখ লাখ ডিম

শিক্ষার্থীদের বাস নিয়ে প্রোগ্রামে তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগ

মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

যুদ্ধ শেষে গাজায় যে পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র

দেড় শতাধিক লোকসহ টুঙ্গিপাড়ায় যাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ

স্ত্রীর স্বীকৃতির দাবিতে নাদিমের বাড়ি ৪৩ বছরের নারীর অনশন

‘পিডাইয়া লম্বা করে দেন, বহু উপরের নির্দেশ’

পাকিস্তানের হাতে অত্যাধুনিক রকেট, আতঙ্কে শত্রুদেশগুলো

আন্তর্জাতিক আবৃত্তি উৎসব ১৭ মে

মহাসড়কে হঠাৎ গুলি, নারী আহত

১০

‘চট্টগ্রাম বন্দর একদিন পৃথিবীর অন্য দেশের কার্যক্রম পরিচালনা করবে’

১১

শাবিতে মাহিদ মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধন

১২

‘বারবার নীতি পরিবর্তন করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর আস্থা কমে যাবে ব্যবসায়ীদের’

১৩

হাজিদের স্বাগত জানাচ্ছে নারীরা!

১৪

কক্সবাজারের রূপে সাজবে পতেঙ্গার সি-বিচ

১৫

সরকার পরিবর্তনে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিকল্প নেই : মির্জা ফখরুল

১৬

ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে গরু ছিনতাইয়ের মামলা

১৭

উচ্চশিক্ষার জন্য নরওয়েতে যাচ্ছেন চুয়েটের ৮ শিক্ষার্থী

১৮

পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর পাওয়া গেল তরুণীর ঝুলন্ত মরদেহ

১৯

অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকায় আরেক ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শনাক্ত

২০
X