সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৪, ০২:৪৮ এএম
আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:২৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকা যেন ভিক্ষুকের হাট

ঢাকা যেন ভিক্ষুকের হাট

ঢাকা যানজটের শহর, মশার শহর, ঢাকা নিকৃষ্ট বায়ুর শহর, ঢাকা আগুনের শহর। ইদানীং মনে হচ্ছে ঢাকা ভিক্ষুকের শহর। এ শহরে ভিক্ষুক অনাদিকাল থেকেই ছিল। কিন্তু এখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে উঠেছে এ অত্যাচার। পুরো রাজধানীতে যেন ভিক্ষুকের ঢল নেমেছে। পথ চলতে তারা মানুষের কাছে হাত পাতছে, গাড়ি থামলে জানালায় আঘাত করছে। ছোট বাচ্চা থেকে অতি বয়স্ক নারী-পুরুষ সব শ্রেণির ভিক্ষুকে ভরপুর এ শহর।

তবে কি দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে? অভাবী মানুষের সংখ্যা বাড়ায় ভিক্ষুক বাড়ছে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর সহজ নয়। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন যে, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, মানুষের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, বেকার হয়ে পড়া, কর্মসংস্থানের অভাবসহ সার্বিক অর্থনীতির শোচনীয় পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে চারদিকে অভাব আঁচ করা যায়।

অনেকে বলে থাকে, পবিত্র রমজান মাসে অনেকেই ভিক্ষা করতে ঢাকায় আসে, যারা বাস্তবে ভিক্ষুক নয়। অনেকে বলে থাকে, ভিক্ষাবৃত্তি একটি ব্যবসা হিসেবে দাঁড়িয়েছে এ শহরে। এসব মেনে নিয়েও বলতেই হবে শহরে প্রকৃত ভিক্ষুক ব্যাপক হারে বাড়ছে। বাড়ি, অলিগলি, বাজার, শিক্ষাঙ্গন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, হাসপাতাল; সবখানেই শুধু ভিক্ষুক আর ভিক্ষুক। পঙ্গু, অন্ধ, খোঁড়া, বয়স্ক মানুষের সঙ্গে শারীরিকভাবে ভালো মানুষকেও ভিক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে।

সরকারের উন্নয়নের যে বিশাল প্রচার, তার সঙ্গে এ ভিক্ষুকের উপদ্রব যায় না। দ্বিতীয়ত প্রশ্ন উঠবেই যে, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন কর্মসূচি থাকা সত্ত্বেও ঢাকা শহরে কেন ভিক্ষুক? সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী হয়তো বলবেন যে, ঢাকা শহরে ভিক্ষুকদের উৎপাত নিরসনে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

দশ বছরেরও বেশি সময় আগে ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল ও পুনর্বাসনের জন্য একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল সরকার। তবে সেটি যে ব্যর্থ হয়েছে তা শহরের যে কোনো স্থানেই দৃশ্যমান। শুধু ঢাকা নয়, সব শহরেই একই চিত্র। কোনো উদ্যোগেই ভিক্ষুক কমছে না। শহরের বড় রাস্তা ছেড়ে, ঘনবসতি এলাকা পূর্ণ করে ভিক্ষার হাত এখন পুরো শহর এলাকারও অলিতে গলিতে। উন্নয়নের যত প্রচেষ্টাই থাকুক, যত কথাই বলা হোক, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় মানুষ অভাব সামলে নিতে পারছে না এবং সে কারণেই শহরে অভাবী মানুষ হাত পাতছে মানুষের কাছে। বাস্তবতা হলো, বাড়িতে-বাড়িতে, পাড়ায়-পাড়ায় এখন যে হারে ভিক্ষুক আসে সেটি কয়েক বছর আগেও এমন ছিল না।

তবে প্রকৃত অভাবীর পাশাপাশি প্রচুর পেশাদার ভিক্ষাজীবী যে আছে, সেটাও অস্বীকার না করেও বলতে হবে যে, ঢাকা এখন ভিক্ষুকের হাট। রাস্তায়, ফুটপাতে, ট্রাফিক সিগন্যালে, পাড়ায়-পাড়ায় বাড়িঘরের সামনে শুধু ভিক্ষুক আর ভিক্ষুক। সারা দেশের রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, এয়ারপোর্ট, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজের সামনে, মাজার, বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাটে অজস্র ভিক্ষুক। পুরো দেশ দূরে থাক, শুধু এ ঢাকা শহরে কত ভিক্ষুক আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও জানা নেই।

ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, কূটনৈতিক এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তি এবং সামগ্রিকভাবে রাজধানীকে ভিক্ষাবৃত্তিমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একসময় ঢাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সক্রিয়তাও ছিল। এখন অভিযান বন্ধ থাকায় ভিক্ষুক বাড়ছে দেদার। রাজধানীর গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডি এলাকা ভিক্ষুকদের জন্য নিষিদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এই তিন এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। গুলিস্তান, ফার্মগেট বা যাত্রাবাড়ীর চেয়ে এখন এসব অঞ্চলেই ভিক্ষুকের সংখ্যা বেশি। তাই ভিক্ষুকমুক্ত সাইনবোর্ড এখন এক প্রহসনে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের আইনে ভিক্ষাবৃত্তিকে সহায়তাকারী বা এ ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত অপরাধে অন্তত তিন বছরের কারাবাসের বিধান রয়েছে। সরকারও এ ধরনের কাজে উৎসাহদানকারী চক্রের দমনে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা নানা সময়ে বলেছে। কিন্তু তারপরও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। ২০১০ সালে দেশে ভিক্ষাবৃত্তির মতো অমর্যাদাকর পেশা থেকে নিবৃত্ত করার লক্ষ্যে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর আবাসন, ভরণ-পোষণ এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে এ কাজে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। এ কাজে বিভিন্ন এনজিওকে যুক্ত করা হয়েছিল। উদ্যোগ ছিল ভিক্ষুকদের নিজ নিজ জেলায় পুনর্বাসন করার। কিন্তু সেগুলো কোনো কাজে আসেনি।

তাহলে সমাধান আসলে কোথায়? শাসনব্যবস্থা পরিচালনাকারীদের সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। প্রথমে ভাবতে হবে বৈষম্য নিয়ে। আর্থিক অসাম্য দূর না হলে আমাদের সব সংকল্প ব্যর্থ হয়ে যাবে। যারা নীতিনির্ধারণী জায়গায় আছেন, তাদের মানতে হবে যে পরিস্থিতি সঙ্গিন। সমস্যাটি সমৃদ্ধির নয়, আর্থিক প্রবৃদ্ধির হারেরও নয়। অতিমারির ধাক্কা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও শুধু নয়। উৎপাদনের সমস্যাও নয়, সমস্যাটি বণ্টনের, সমস্যা রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে। মানুষের জন্য সৃষ্ট রাষ্ট্র তার শাসনপ্রণালিতে মানুষের জন্য কোনো ভাবনা রেখেছে কি না, সমস্যা সেখানে।

আমাদের প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয় বাড়ার বড় গল্প চালু আছে। কিন্তু সেই বৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে কি না, সেটা ভাবা হয়নি একদম গভীরে গিয়ে। অথচ মানুষের আর্থিক বৃদ্ধির ভাগীদার হওয়ার অধিকার অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধি, অধিকতর মানুষের ক্রমশ অভাবের অতলে পৌঁছে যাওয়ার দৃষ্টান্ত এই ভিক্ষুক বেড়ে যাওয়া। অতিমারি, হরেক ধাক্কায় নাজেহাল এ বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের কথা কোথাও সেভাবে উচ্চারিত হয় না। ধনী আরও ধনী হচ্ছে আর গরিব আরও গরিব। আর দরিদ্র শ্রেণির মানুষেরই একটি অংশ বেকার, কর্মহীন বা অসুস্থ হয়ে ভিক্ষাবৃত্তির পথে পা বাড়াচ্ছে।

ভিক্ষাবৃত্তি কোনো স্বীকৃত পেশা নয়, কোনো শোভন পেশাও নয়। শারীরিকভাবে অক্ষম, দৈহিকভাবে প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের পাশাপাশি আছে বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত ও স্বামী পরিত্যক্তা নারীরা। এর বাইরে বেকারত্ব, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ও কর্মসংস্থান সংকটের কারণে যেমন ভিক্ষুক বাড়ছে, তেমনি আছে শ্রমবিমুখতা।

অর্থনৈতিক শোচনীয় অবস্থার কখনোই অস্বীকার করা যায় না। দেশের মানুষ কষ্টে আছে। দেশের প্রতিটি অর্থনৈতিক সূচকই এখন নিম্নগামী। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এমআরটি, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেলসহ বড় বড় মেগা প্রজেক্ট হয়েছে ঠিকই, তবে সেইসঙ্গে চিন্তা করতে হবে সাধারণ মানুষের জীবনমান নিয়ে। অভাব-অনটনে পড়েই মানুষ ভিক্ষুকে পরিণত হচ্ছে, এই তত্ত্ব উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। বহু মানুষ এখন দুবেলা ঠিকমতো খেতে পারছে না। সরকারি বিবিএসের হিসাবেই বর্তমানে দেশের চার কোটি মানুষ ঋণ করে খাবার কেনে। অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য এসব মানুষকে ধারকর্জ করে চলতে হচ্ছে। বাস্তবে হয়তো বিবিএসের এ হিসাবের চেয়ে আরও বেশি মানুষ এখন এ ধরনের জীবনযাপন করছে। ঠিকমতো খাবার খেতে না পারায় ক্ষুধার জ্বালায় অনেকে বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামছে।

ভিক্ষাবৃত্তি একটি সামাজিক অনাচার—এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর প্রতিকার খুঁজতে হবে সরকারকে। অবশ্যই প্রচুর অভাবী মানুষ বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করছে, তবে অনেকে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। ভিক্ষাবৃত্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন চক্র। আমরা জানি সারা দেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করা সম্ভব নয়। কিন্তু কোনো পক্ষকেই প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদারকি বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।

ভিক্ষুক পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা আমরা অনেক শুনেছি। এগুলোতে কোনো কাজ হবে না। সরাসরি ভিক্ষাবৃত্তিকে নিষিদ্ধ করতে হবে। ভিক্ষাবৃত্তি যেমন কোনো পেশা নয়, তেমনি ভিক্ষা দেওয়ার নামে কোনো একজনকে করুণা করাও কোনো সুনাগরিকের কাজ নয়।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাজায় ২ শতাধিক সাংবাদিক নিহত, জাতিসংঘের সতর্কতা জারি

সৌদি আরব পৌঁছেছেন ১৭৬৯৪ হজযাত্রী

বুটেক্সের হলে থামেনি চুরির ঘটনা, ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা

ছুটির দিনেও ঢাকার বাতাস 'অস্বাস্থ্যকর'

সিলেট হয়ে ঢাকায় ফিরবেন খালেদা জিয়া

কাতার গেলেন সেনাপ্রধান

সংবিধান বানায় শাসকরা, গঠনতন্ত্র জনগণ : ফরহাদ মজহার

সৌদি আরবকে ভয়ংকর এআইএম-১২০ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

কাশ্মীর ইস্যুতে জাতিসংঘে যেতে পারে পাকিস্তান

ঢাকার আবহাওয়া আজ কেমন থাকবে

১০

গাজায় আরও বড় সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল

১১

স্থবির পরমাণু আলোচনা, কী বলছে ইরান

১২

সিরিয়ায় একযোগে ব্যাপক বিমান হামলা চালাল ইসরায়েল

১৩

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হচ্ছেন হেফাজতের নেতাকর্মীরা

১৪

রাবিতে স্ক্যাবিসের প্রকোপ, আক্রান্ত ২০০ শিক্ষার্থী

১৫

নাটোরে ১৮ বছরের না হওয়া কাজ ৬ মাসের মধ্যে করব : দুলু

১৬

০৩ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৭

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৮

০৩ মে : টিভিতে আজকের খেলা

১৯

০৩ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

২০
X