উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, বাংলা মুদ্রণশিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি ১৮৬৩ সালের ১২ মে ময়মনসিংহ জেলার মসুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃদত্ত নাম ছিল কামদারঞ্জন। পাঁচ বছর বয়সের সময় পিতা কালীনাথ রায় ওরফে শ্যামসুন্দর মুন্সীর কাছ থেকে নিকটাত্মীয় ময়মনসিংহের জমিদার হরিকিশোর চৌধুরী তাকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করে নতুন নাম রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। সুপণ্ডিত জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় উপেন্দ্রকিশোরের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। স্কুলজীবনেই তিনি চিত্রাঙ্কনে দক্ষতা অর্জন করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুকাল অধ্যয়নের পর কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। ১৮৮৪ সালে সেখান থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন।
তরুণ বয়সেই উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি ঘটে। তৎকালীন শিশুকিশোর পত্রিকা সখা, বালক, সাথী, সখা ও সাথী, মুকুল ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৩ সালে ছাত্রাবস্থায় সখা পত্রিকায় তার প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। সমগ্র জীবনেই তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। ছড়া, কবিতা, গান, গল্প, নাটক, বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, রূপকথা, উপকথা, পৌরাণিক কাহিনি ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি রচনাসহ শিশুকিশোর সাহিত্যের প্রায় সব শাখায়। তার সম্পাদনায় ১৯১৩ সালে বিখ্যাত শিশুতোষ মাসিক পত্রিকা সন্দেশ প্রথম প্রকাশিত হয়, যা আজও কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি জনপ্রিয় শিশুকিশোর সাহিত্য পত্রিকা।
উপেন্দ্রকিশোর শিশুকিশোরদের জন্য বহুসংখ্যক সাহিত্য পুস্তক রচনা করেছেন, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ছোটদের রামায়ণ, ছোটদের মহাভারত, সেকালের কথা, মহাভারতের গল্প, ছোট্ট রামায়ণ, টুনটুনির বই এবং গুপী গাইন বাঘা বাইন। বইগুলোর প্রচ্ছদ এবং ভেতরের ছবিও তিনি নিজেই অঙ্কন করেন। উপেন্দ্রকিশোর তার প্রথম বই ছোটদের রামায়ণের চিত্রমুদ্রণমানে অসন্তুষ্ট হয়ে ১৮৯৫ সালে বিলেত থেকে তখনকার দিনের আধুনিকতম যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে নিজেই একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৬ সালের দিকে স্টুডিও, ডার্করুম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে নানা রঙের হাফটোন মুদ্রণ বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। বাল্যকাল থেকেই উপেন্দ্রকিশোর সংগীতচর্চার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তিনি পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম, সেতার, বাঁশি, বেহালা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাদনে দক্ষতা অর্জন করেন।
উপেন্দ্রকিশোরের মধ্যে এভাবে নানামুখী যোগ্যতার সমাবেশ ঘটলেও তিনি প্রধানত নির্মল আনন্দরসিক শিশুসাহিত্যিক রূপেই অধিক পরিচিত। এ শিশুসাহিত্য পরবর্তী সময়ে তার পারিবারিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়। কন্যা সুখলতা রাও ও পুণ্যলতা চক্রবর্তী এবং পুত্র সুকুমার রায় ও সুবিনয় রায় শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তার পৌত্র। ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর এই গুণী ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান ঘটে।