রাতজুড়ে তাণ্ডবের পর প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল উত্তর দিকে অগ্রসর ও দুর্বল হয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রিমালের তাণ্ডবে বিভিন্ন জেলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ১২ জন মারা গেছে। সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে খুলনার উপকূল কয়রায় বেড়িবাঁধ ভেঙে অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। একই সঙ্গে খুলনার দাকোপ উপজেলায় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। উপজেলার শিবসা ও ঢাকী নদীর বাঁধ ভেঙে তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের কামিনীবাসিয়া গ্রামের ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে চিংড়ির ঘের, ভেঙে গেছে কাঁচা ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। ভারি বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলের ক্ষেত, উপড়ে গেছে বহু গাছ। অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভারি বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে খুলনা মহানগরীর নিম্নাঞ্চল। ঝড়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য গাছ উপড়ে পড়েছে। সড়কের দুই পাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড ভেঙে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
রিমালের প্রভাবে রাজধানীতে সোমবার ভোর থেকে ঝরছে বৃষ্টি। সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে ও বইছে টানা বাতাস। সকালের বৃষ্টিতে রাজধানীর অনেক এলাকার রাস্তাঘাটে পানি জমেছে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে অফিসগামী রাজধানীবাসীকে। কেননা যানবাহন পেতে অনেককে পোহাতে হয়েছে ভোগান্তি। বরগুনার প্রধান তিন নদনদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-৭ ফুট উচ্চতার জোয়ার প্রবাহিত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে জেলা শহরসহ সেখানকার উপকূলের অনেক গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সদর উপজেলা এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের পালের বালিয়াতলী ও বদরখালী ইউনিয়নের বাওয়ালকর এলাকায় বাঁধ ভেঙে ১০-১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
অবশ্য এ পরিস্থিতি কোনো ব্যতিক্রম কিছু নয়। বারবার এর মুখোমুখি হয়েছে বঙ্গোপসাগরের আশপাশের অঞ্চলগুলোর মানুষ। ভবিষ্যতেও বারবারই এর মুখোমুখি হতে হবে। এর কারণ পৃথিবীর যে অঞ্চলে আমরা থাকি, সেখানে পাশাপাশি অবস্থান করছে দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত প্রবণতা। তাই বারবার ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের মুখে পড়াই এ অঞ্চলের নিয়তি।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, শুধু বঙ্গোপসাগরেই কেন? ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে আরব সাগর যে অবস্থানে আছে, সেখানেও তো একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হওয়া সম্ভব। মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ স্থলভাগের পূর্বদিকের কিনারায় যেমন বঙ্গোপসাগরের অবস্থান, ঠিক তেমনি ওই স্থলভাগের পশ্চিম দিকের কিনারায় আরব সাগর রয়েছে। আরব সাগরে যে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় না, তা নয়। তবে সেসব ঝড়ের বেশিরভাগই পশ্চিম দিকে চলে যায় অর্থাৎ মধ্য এশিয়ার উপকূলে গিয়ে আঘাত হানে। কারণ, প্রথমত ভারতের পশ্চিম উপকূলজুড়ে বিস্তৃত পাহাড়ে বাতাস বাধা পায়। দ্বিতীয়ত, মধ্য ভারতের চেয়ে মধ্য এশিয়ার দিকে নিম্নচাপের তীব্রতা অধিকাংশ সময় বেশি থাকে। তবে এ কথাও ঠিক, বঙ্গোপসাগরে যত ঘূর্ণিঝড় জন্ম নেয়, আরব সাগরে তত বেশি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় না। আরব সাগরের চেয়ে বঙ্গোপসাগর অনেক বেশি উত্তাল বা অশান্ত বলেই এমনটা হয় বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগ বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী দেশগুলো তাদের দায় নিচ্ছে না। সুতরাং এটা আমাদেরই মোকাবিলা করতে হবে। যেখানে যে পদ্ধতিতে দুর্যোগ মোকাবিলা করা দরকার, সেখানে তাই করতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে দুর্যোগ প্রতিরোধে টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে এখন আমাদের প্রধান দায়িত্ব ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করা, যেন তারা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে।