কোনো সৎকর্মের সুযোগ এলেই সঙ্গে সঙ্গে তাতে অংশগ্রহণ করা সত্যিকার মুমিনের বৈশিষ্ট্য। সাহাবায়ে কেরাম ইবাদত-বন্দেগি, দান-সদকা ও ইসলামের যে কোনো কাজে অংশগ্রহণে পরস্পরে প্রতিযোগিতা করেছেন। কেননা তারা ইবাদতের পূর্ণ স্বাদ ও তৃপ্তি লাভ করেছেন। আল্লাহর ইবাদত যেন বান্দার কাছে নিরেট আচারসর্বস্ব না হয়ে পড়ে, সেদিকে সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে। কেননা বর্তমান সময়ে অধিকাংশের ইবাদত রুহশূন্য আচার-অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। মসজিদের মিনারে সুউচ্চ শব্দে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিত হচ্ছে অথচ মুসলমান আল্লাহর বিধান ছেড়ে মদ, জুয়া, সুদ, জেনা, চুরি, বেপর্দা প্রভৃতি বিষয়ে নিজেদের প্রলুব্ধ করছে। কোরআনের আয়াতগুলো তেলাওয়াত আমাদের হৃদয় কম্পিত হয় না। প্রতিদিনের ক্ষমা প্রার্থনা জিহ্বা ব্যতীত হৃদয়কে উদ্বেলিত করে না। এসবের একটাই কারণ—মুসলমান ইবাদতের অর্থ ও স্বাদ দুটিই ভুলে গেছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সচেষ্ট হতে হবে। মুমিন ও মুসলমান তার ব্যক্তি ও সমাজজীবন যত বেশি অনর্থক কথা ও কাজ থেকে দূরে থাকবে, সে তত বেশি ইবাদতের স্বাদ পাবে। সফল মুমিনদের গুণাবলি ব্যাখ্যায় আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা অনর্থক ক্রিয়াকলাপ থেকে নির্লিপ্ত।’ (সুরা মুমিনুন : ৩)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং যখন অসার ক্রিয়াকর্মের সম্মুখীন হয়, তখন ভদ্রভাবে সে স্থান অতিক্রম করে।’ (ফোরকান : ৭২)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইসলামের একটি সৌন্দর্য হচ্ছে—অনর্থক কর্মকাণ্ড পরিহার করা।’ (ইবনে মাজা : ৩৯৬৭)।
অনেক মানুষ এমন আছেন যারা ইবাদতকে ইসলামের আনুষ্ঠানিক কিছু কাজ মনে করে, শুধু আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্কের বিষয় বলে ধারণা করে, জীবনের সব ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে। এমন দাবি যারা করেন, কোরআনুল কারিম তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গিকে বাতিল বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাজিল করেছি, যেটি এমন যে, তাতে প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।’ (সুরা নাহল : ৮৯)। এমনিভাবে আল্লাহর নবীর জন্য যে দিকনির্দেশনা আল্লাহ দিয়েছেন, সেখানে ইবাদতে ব্যাপকতা আল্লাহ পরিষ্কার করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি বলুন, আমার সালাত, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য। তার কোনো শরিক নেই, আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি আর আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে আমি হলাম প্রথম।’ (সুরা আনআম : ১৬২-১৬৩)।
আলেমরা যুগে যুগে ইসলামের যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তাতেও প্রমাণিত হয় যে, ইবাদত সীমিত কোনো বিষয় অথবা আনুষ্ঠানিক বস্তু নয়। ইবাদতের ব্যাপকতা জীবনের সব ক্ষেত্রে বিস্তৃত। জনৈক ব্যক্তি সালমান ফারসি (রা.)-কে বললেন, তোমাদের নবী কি তোমাদের সব বিষয়ে জ্ঞান দিয়েছেন? এমনকি কীভাবে প্রস্রাব-পায়খানা করবে তাও? সালমান (রা.) জবাব দিলেন, হ্যাঁ, নবী করিম (সা.) আমাদের নিষেধ করেছেন কিবলামুখী হয়ে প্রস্রাব-পায়খানা করতে, তিনটির কম ঢিলা ব্যবহার করতে, ডান হাত দিয়ে ইস্তেঞ্জা করতে ও হাড্ডি অথবা শুকনা গোবর দিয়ে ইস্তেঞ্জা করতে। (মুসলিম : ২৬২)। প্রখ্যাত সাহাবি আবু জর গিফারি (রা.) এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, রাসুল (সা.) সব বিষয় আমাদের শিক্ষাদান করেছেন। এমনকি আকাশে উড়ন্ত পাখির দুটি ডানা কীভাবে নড়াচড়া করে তার গূঢ় রহস্য কী, তাও আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। (আল-মুজামুল কাবির : ১৬৪৭)।
ইবাদতের পরিপূর্ণতার জন্য দরকার ইসলাম সম্পর্কে সামগ্রিক জ্ঞানার্জন করা। আল্লাহ আমাদের তার ইবাদতের স্বাদ-আস্বাদনের মাধ্যমে তার আনুগত্য করার তওফিক দান করুন।
লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক