কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৪, ০৩:০৭ এএম
আপডেট : ২৫ জুন ২০২৪, ০৯:১৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সাত দুগুণে চোদ্দো!

মহসীন হাবিব
সাত দুগুণে চোদ্দো!

সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’র মতোই হিসাব মেলানো যাচ্ছে না কোনো ক্রমেই। মেলে শুধু যোগীন্দ্রনাথ সরকারের মজার দেশ ছড়ার সঙ্গে। ছড়ার খানিকটা আমরা আরেকবার উচ্চৈঃস্বরে পড়ি:

এক যে আছে মজার দেশ, সব রকমে ভালো

রাত্তিরেতে বেজায় রোদ দিনে চাঁদের আলো!

আকাশ সেথা সবুজবরণ গাছের পাতা নীল;

ডাঙায় চড়ে রুই কাতলা, জলের মাঝে চিল!

সেই দেশেতে বিড়াল পালায় নেংটি ইঁদুর দেখে ছেলেরা খায় ‘ক্যাস্টর-অয়েল’ রসগোল্লা রেখে!

থাক এ পর্যন্ততই, আলবৎ তাই! ছড়ার শেষ পঙক্তিতে যোগীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মজার দেশের মজার কথা বলবো কত আর;/চোখ খুললে যায় না দেখা মুদলে পরিষ্কার।’ এখন আমরা চোখ বুজে দেখতে পারি, কিছু দেখতে পাই কি না। হ্যাঁ, দেখতে পাই। যোগীন্দ্রনাথের ছড়াকেও বাংলাদেশই কেবল পেছনে ফেলে দিয়েছে! এক অদ্ভুত দেশে পরিণত হয়েছে। আমি চেষ্টা করি ভারত-পাকিস্তানের রাজ্য বা প্রদেশের খবর থেকে শুরু করে উগান্ডা বা হাইতির রাজনৈতিক পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখতে। ইন্টারনেট আমাদের এ সুবিধা এনে দিয়েছে, কেন এস্তেমাল করব না? হলফ করে বলতে পারি, পৃথিবীর কোনো প্রান্তে বাংলাদেশের মতো ‘মজার দেশ’ নেই। ঘুষ, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুক অবস্থা আছে অনেক দেশে। উপমহাদেশের ভারত-পাকিস্তানও ঘুষ দুর্নীতির সমস্যায় আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো এমন মজার ঘুষ-দুর্নীতি তাণ্ডব কোথাও নেই!

প্রথমে আসি কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকা মতিউর রহমানের কাণ্ডে। তার ছেলে একটি ছাগল কেনেন হাট থেকে। দাম ১৫ লাখ টাকা মাত্র! খোঁজ নিয়ে দেখেছি, বাজারে একটি হাতির মূল্য ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা, যদি সে হাতি দাঁতাল হয়। কারণ হাতির শরীরের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ ওই দাঁত দুটো। একেকটি দাঁতের মূল্য বাংলাদেশি টাকায় ১ থেকে দেড় লাখ টাকা। এ ছাড়া হাতি শুধু কাজে লাগে দরিদ্র মাহুতের দোকানে দোকানে গিয়ে ৫-১০ টাকা তোলা তুলতে। অতীতে হাতি গাছের গুঁড়ি টানত, এখন সে কাজটি মেশিনের। অতীতে হাতি সার্কাস দেখাত, এখন কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল সার্কাস দেখায়। সে যাই হোক, কিন্তু ছাগলের শিং তো কোনোই কাজে লাগে না, শুধু শরীরের মাংসটুকু ছাড়া। একটা ছাগলের ১০ কেজি বা ১৫ কেজি মাংস হতে পারে। তার বাজারমূল্য কোনোক্রমেই ২০ হাজার টাকার বেশি নয়। সেই ছাগল কোরবানির পশুর বাজার থেকে যদি কেউ ১৫ লাখ টাকায় কেনে, তাহলে মজার দেশের মানুষ তাকে নিয়ে একটু মজা তো পাবেনই। আর সেটাই হলো কাল। বেরিয়ে এলো পি অব দ্য আইসের নিচের বিশাল দেহ মতিউর রহমান। এনবিআরের এই সদস্য মতিউর রহমানের অবিশ্বাস্য রকমের ধন-সম্পদ গড়ে তোলার কাহিনি বের হয়ে এলো মাত্র একটি ছাগল কেনাকে কেন্দ্র করে। এতদিন কেউ জানেনি? সাধারণ মানুষ ভেবেছে, বড় কর্মকর্তা, তার তো অগাধ সম্পদ থাকবেই। কিন্তু দেশে একটি দুর্নীতি দমন কমিশন আছে। আছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। আরও আছে কয়েকটি অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা। তারা কেউ জানল না? শেষ পর্যন্ত কি না সন্তানের উদ্ভট চাহিদাই তাকে পশুর হাট থেকে বের করে সংবাদের শিরোনাম করল! আজব দেশের আজব ঘটনার এখানেই শেষ নয়। কর্তৃপক্ষের কানে এ ঘটনা গণমাধ্যমের দ্বারা প্রবেশ করায় তাকে বর্তমান কর্মস্থল থেকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে যুক্ত করা হয়েছে। মজার দেশ না?

পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি জামিল হাসান গত কয়েক বছরে যে সম্পদ গড়ে তুলেছেন তার তালিকা দেখলে যে কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তিই ঈর্ষাকাতর হবেন। তার সম্পদ গড়ে তোলার সংবাদের পর তাকে হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি হিসেবে বদলি করা হয়েছে। তবে ধারণা করি, সামান্য বিচার বোধ কর্তৃপক্ষের থাকলে তারা হয়তো অ্যাকশনে যাবেন। তবে বাংলাদেশে আবার ‘ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশন’ বলে একটি আইওয়াশ ব্যবস্থা আছে। অ্যাকশন কথাটি শুনতে বড় কঠিন শোনা যায়। এরকম অ্যাকশন আমরা বহু যুগ ধরে দেখে আসছি। পাঠক, আপনি কখনো ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশনের কথা শুনেছেন? নিশ্চিত শোনেননি। এ ধরনের অপরাধে সেসব দেশে সরাসরি ফৌজদারি মামলার সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশন হয় আসলে ওই ফৌজদারি অপরাধীকে রক্ষার জন্য। এই বাঁচিয়ে দেওয়ার তাগিদ থাকে অন্য কারণে। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশে প্রায় সব অধিদপ্তর পরিদপ্তরে, সব মন্ত্রণালয়েই মাঠপর্যায় থেকে অর্থ আসে। কোনো কোনো ডিপার্টমেন্টে রীতিমতো পার্সেন্টিজ হিসাব করা আছে কে কত পাবেন, যাতে নিজেদের মধ্যে অর্থের পরিমাণ নিয়ে অসন্তোষ দেখা না দেয়। এ কাজটিই শুধু সিস্টেম মেইনটেইন করে চলে। ক্রয়সংক্রান্ত সরকারের বিধিমালা রয়েছে। রয়েছে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি আইন। কিন্তু একটি পর্দা কিনতে যখন ৩৭ হাজার টাকা নির্ধারিত হয়, তখন সেই ফাইল নির্বাহী কর্মকর্তা হয়ে এমনকি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় পর্যন্ত উঠে যায়। কেউই দেখে না যে ৩৭ হাজার টাকায় কয়েকশ গজ কাপড় পাওয়া যায়! দেখে, কিন্তু আন্ডারস্ট্যাডিংটা থাকে অন্যরকম। কেউ কেউ একটি খোঁড়া যুক্তি দিয়ে থাকেন যে, প্রকল্পের কেনাকাটায় দেখা যায় একটি জিনিসের মূল্য লাখ টাকা, কিন্তু তার মূল্য পাঁচ হাজার টাকা ধরা হয়েছে তখন পাঁচ হাজার টাকার জিনিস লাখ টাকা ধরে হিসাব করতে হয়। এটি সম্পূর্ণ খোঁড়া যুক্তি। আর এমনটি যদি সত্যিই হয়, তাহলে বুঝতে হবে প্রকল্পের পরিকল্পনার গোড়াতেই গলদ। যে দেশে একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার বেতনের টাকায় টায় টায় চলার কথা, সেখানে একজন পিয়ন কী করে দুই হাজার কোটি টাকার মালিক হন, একজন এলডি অ্যাসিস্ট্যান্ট কী করে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে ডুপ্লেক্স করে থাকে? মাথায় কিছু ধরে না!

মজার দেশে সবই মজার। ২১ জুন বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। সেখানে যা বলা হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হলো—মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধীরা চক্রান্ত করে কিছু সংবাদপত্রে সূত্রহীন সংবাদ পরিবেশন করে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। না, মূল ধারার দৈনিক পত্রিকাগুলো কোনো মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায়নি। বরং তারা বিভিন্ন কর্মকর্তার সম্পদের পরিমাণ কত, কোথায় অবস্থিত, দাগ নাম্বার কত, তা সহ প্রকাশ করেছে। এখন কথা হলো, পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন কেন ওই সব কর্মকর্তার দায় নিজেদের ঘাড়ে টেনে নিচ্ছেন? এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল কয়েক দিন আগে দেখা একটি দৃশ্য। পুরাতন ঢাকায় অবৈধভাবে বসবাসরত হরিজনদের উচ্ছেদ করতে গিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। হরিজনরা শুধু প্রতিবাদ করেনি, সেইসঙ্গে মুহুর্মুহু স্লোগান দিচ্ছিল, ‘জয় বাংলা!’ আর কি কর্তৃপক্ষের সাধ্য আছে ওদের উৎখাত করে? অবশ্য এ কথা ঠিক, ওই হরিজনদের পূর্বপুরুষরা হয়তো সবাই জয় বাংলারই লোক ছিলেন। কিন্তু বর্তমান পুলিশ যদি যত্রতত্র স্বাধীনতাবিরোধীদের দেখতে পায় তাহলে বড় মুশকিলের কথা!

সংসার চালাতে গিয়ে, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে কেউ কেউ একটু-আধটু অনিয়মের আশ্রয় নেন। আমার মাতৃকূলের এক নিকটাত্মীয় কলকাতায় ফুডের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি যৎসামান্য এদিক-ওদিক করে গ্রামের বাড়িতে একটি পাকা দালান করেছিলেন। গ্রামের কেউ যদি বলত সাহেব ঘুষের টাকায় বাড়িটি করেছে, তাহলে লজ্জায়, ক্ষোভে তার স্ত্রী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। মাথায় পানি ঢেলে তাকে সুস্থ করতে হতো। সেই রামও নেই, অযোধ্যাও নেই। এখন কেউ যদি চাকরির টাকায় সংসার চালিয়ে বাড়ি ঘর শানশওকাত দেখাতে না পারেন, তাহলে গ্রামের লোক অবজ্ঞার হাসি হেসে বলে, ‘চাকরি কইরা জীবনে কিছুই করতে পারলা না।’

সমাজ পচলে তা ধীরে ধীরে ঠিক করে আনতে পারেন নীতিনির্ধারক, আমলা ও রাজনীতিবিদরা। আর এরা পচলে সমাজ তাদের একটা না একটা সময় পথে নিয়ে আসতে পারে। যেখানে দুটোই পচে সেখানে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এ পরিস্থিতিতে একমাত্র বাকি থাকে সামাজিক বিপ্লব। আর সেটা হতে হয় দলমত নির্বিশেষে। কোনো একজনের হাল ধরতে হয়। সমাজ তখন সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপ্লবকে রাজনৈতিক বিপ্লবে রূপান্তর করতে পারে। যেমনটি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফরাসি বিপ্লব পচনশীল গোটা ইউরোপকে কীভাবে ঘুরিয়ে দিয়েছিল তা আরেক মহাকাব্য।

লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঈদে মিলাদুন্নবী কবে, জানা গেল

নেইমারের জন্য আবার দুঃসংবাদ!

পাচারের সময় সীমান্তে অস্ত্র উদ্ধার

যেভাবে বুঝবেন আপনার শরীরে কোলেস্টেরল বাড়ছে

‘রিট করার মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনকে বানচালের পাঁয়তারা চালাচ্ছে শিবির’

কুমিল্লায় একই পরিবারের চারজন নিহতের ঘটনায় সেই বাসটি জব্দ

অভিনেত্রীর বাড়ি থেকে কোটি টাকার গহনা উধাও

বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণে আরও সময় প্রয়োজন : ডিসিসিআই সভাপতি

‘অলৌকিকভাবে’ ঘরবাড়িতে ধরছে আগুন, আতঙ্কে গ্রামবাসী

দুবাইয়ে ওমান প্রবাসীর হাতে বাংলাদেশি যুবক খুন

১০

ঢাবিতে ফজলুর রহমানের কুশপুত্তলিকা দাহ

১১

ফজলুর রহমানকে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিল বিএনপি

১২

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল / ইন্টার্ন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. আল আমিন, সাধারণ সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত

১৩

রাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু

১৪

উপদেষ্টা আসিফের নামে ভুয়া ছবি প্রচার

১৫

নিজের চুল থেকে তৈরি টুথপেস্ট সুরক্ষা দেবে দাঁতকে : গবেষণা

১৬

খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে ফিরোজায় পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী

১৭

নখসহ মানুষের আঙুল পাওয়া গেল চিকেন রোলে, অতঃপর...

১৮

সাড়ে ৩১ কেজি ওজনের কষ্টি পাথরের মূর্তিসহ আটক ২

১৯

স্পাইডারম্যান সেজে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন যুবক, বড় জরিমানা করল পুলিশ

২০
X