প্রায়ই ক্লাস নিই, সপ্তাহে অন্তত একবার; বেশিরভাগ সময় ক্লাস সিক্স ও সেভেন। সবসময় নয়, তবে কখনো কখনো অদ্ভুত সব আলোচনার সূত্রপাত হয়। যেমন—ক্লাস সিক্সের সুদর্শনা। অন্যদের চেয়ে বেশি সরব। কখনো কখনো অন্যের কথা কেড়ে নিজেই কথা বলে। তার সহপাঠীরা তাকে এক ধরনের বাধার মতো দিলেও, আবার সায়ও দেয়—চায় ও কথা বলুক, এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ততা জোগায়— ওরাও বোধহয় তার অংশ হয়ে যায়। এদের মধ্যে রয়েছে জাহরা, আনন্দ, প্রত্যুষ, ডোডো, বর্ণ, ইরা, অদ্বৈত—আসলে পুরো ক্লাসটাই।
একদিন সুদর্শনা আমাকে বলে, ‘শোনো একটা কথা বলি, মহাবিশ্বকে যদি সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে নির্ণয় করতে যাই তবে তা অসীম।’ আমি একটু চমকে উঠে বললাম কী রকম? সে বলল, দেখো, তার কারণ সংখ্যা গণনার কোনো সীমা নেই। যদি আমি শূন্য থেকে গণনা শুরু করি, তবে ধারাবাহিকভাবে আর শূন্যে ফিরতে পারব না। যদি আমি শূন্যে ফিরতে যাই, তবে আমাকে গণনার পেছনে আবার ফিরে আসতে হবে।’
মানসী, অদ্রি ও সোহা এর মধ্যে আবার বলে ওঠে, ‘আমরা গণনা কেন শূন্য থেকে শুরু করব?’
তবে হ্যাঁ, ইউক্লিডীয় সংখ্যাতত্ত্ব বলে ১, ২, ৩, ৪ এইভাবে অন্তহীন গোনা যায়, কখনো তা শূন্যে ফিরে আসে না। অতএব মহাবিশ্বের শেষ নেই, অন্তহীন ছুটে চলা যায়। এক ধরনের পিথাগোরীয় ধরন: সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্যে বিশ্বকে ব্যাখ্যা করা।
মানসী বিষয়টা সমর্থন করে রীতিমতো একটা ব্যাখ্যাও তৈরি করেছে দেখলাম। আমার মনে পড়ে গেল একটা কথা, ‘পিথাগোরীয়রাই বলতেন সংখ্যাই প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে, প্রকৃতিতে একটা ঐকতান আছে, বৈচিত্র্যে রয়েছে সমন্বয়। আর রয়েছে এর একটা ভাষা। সংখ্যাই প্রকৃতির ভাষা।’
আমি বললাম, কিন্তু বিশ্ব তো অসীম না, তার নির্দিষ্ট ভর আছে, ঘনত্ব রয়েছে। সে আমার কথায় সায় না দিলেও, চুপ করে থাকে।
আমার তখন একটা কথা মনে আসে, অভিজ্ঞতাটা অনেকটা গল্পের মতো। সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, গল্পটা কী?
আমিও মনে করতে থাকি—তারপর একসময় বলি শোনো। নালন্দারই একটা ঘটনা, এক যুগেরও বেশি আগে, প্রায় ১৫ বছর। একই ক্লাস, বয়স তোমাদের মতোই। সেই ক্লাসে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা বলো তো, যদি তোমাদের একটা দুরবিন দিয়ে বিশ্বের শেষ অবধি দেখতে বলা হয়, তাহলে কী দেখা যাবে?’
একেকজন একেক ধরনের কথা, ধারণা (প্রকল্প) বলছিল। বলছিল দূর, বহু দূর, অনেক দূর...। আমি বললাম, তারও তো শেষ রয়েছে, খুব বেশি না হলেও কেউ কেউ সায় দিল।
হ্যাঁ, বিশ্বটা তো বিশাল, বিশাল বড়—পিংপং বল নয়, পৃথিবীর মতো নয়, সৌরজগতের মতো নয়, গ্যালাক্সিও নয়, আরও বড়, আরও...।
হঠাৎ করেই বর্তমানে ফিরে আসলাম সুদর্শনার কথায়, হ্যাঁ বিশাল তো!
আমি বললাম, আগে শোনো—
জানিস, হঠাৎ করেই ওদের মধ্যে একজন বলে বসল, ‘আমার পেছনের দিকটা।’
মানুষের উন্মোচন প্রক্রিয়াটা হলো সংক্রামক একটা ব্যাপার, আমারও তাই মনে হয়।
অনেকটা সে কারণেই হয়তো অন্য একজন বলে বসল, কালো অবয়ব, তারই কথার রেশ ধরে সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন বলে বসল, ‘আমার মাথার চুলগুলো।’ আমি তাদের বললাম, ‘উত্তরটা কিন্তু দারুণ!’
বর্তমানে ফিরে আসলাম, এখনকার সিক্সের সবাই বিস্ময় সহকারে বলল—কে, কে, কে? আমি বললাম, সেটা কি খুব গুরুত্ববহন করে? কেননা ক্লাসের সবাই কোনো না কোনোভাবে অংশগ্রহণ করেছিল, যেমনটি এখানে ঘটেছে, পরিবেশ পরিস্থিতি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে, তবু হয়তো একজন প্রতিনিধিত্ব করে, নাম তারও ছিল, ‘লাবিবা’। এখনকার লাবিবা চমকে উঠল, এক দূরদৃষ্টি নিয়ে তাকাল!
বিশ্বকে অসীম ভাবার ক্লাসটা আমাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, বিষয়টা ক্লাস সেভেনের শিক্ষার্থীদের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। কোনো এক প্রসঙ্গ ধরে, বিশ্ব অসীম না সসীম—আলোচনাটায় আবার ফিরে এলো। আমি বললাম, বিশ্ব যদি অসীমতা দিয়ে ঘেরা থাকে, তাহলে তার সামগ্রিক প্রকৃতি, জন্মমৃত্যু বা নিয়তি কিছু বলতে পারব না। কিন্তু এটি যদি সসীম হয়, তাহলে একে আমরা বোঝার চেষ্টা করতে পারি। তারা হুম বলল।
তবে সপ্তম শ্রেণির ‘কথা’, একটু আনমনা থাকে, উত্তর দেওয়ার সময় ভীষণ সচেতন, আমার সঙ্গে একটু বাক-বিবাদও ঘটে। ও জিজ্ঞেস করে, ‘কীভাবে, পেছনের চুলগুলো দেখতে পাবে?’
বললাম, কেন? আলো যেমন করে বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসে আর আমরা দেখতে পাই তাকে, তেমন করে!
‘কথা’র সঙ্গে অনেকে বলল, আলো তো সোজা ছুটতে থাকবে। ও তো দূর থেকে দূরে হারিয়ে যাবে আকাশ হয়ে মহাকাশের দিগন্তে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, বুঝলি কেমন করে? যেমন ধর, খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকলে পৃথিবীকে কি তোর গোল মনে হয়?
ও বলল, ‘না, সমতলই মনে হয়।’ একজন মানুষ যদি কোনো বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা হাঁটতে থাকে, হেঁটে যেতে কোনো খাদে, নদীতে না ডুবে, সমুদ্রের ঢেউয়ের আঘাতে হারিয়ে না যায়, তাহলে সে একদিন ফিরে আসবে ওই বন্ধুর পেছনে, অন্য কোনো বেলায়ও (যেমন কোনো বিন্দু থেকে) যদি ফিরে আসে, তাহলে বুঝতে হবে তার পথটা বাঁকা, তাই ওই বিন্দুতে ফিরে আসা হয়েছে। তবে পথের শেষ নেই কারণ তার চলমানতায় কোনো বাধা নেই, পুরোনো রেখাতে প্রবেশ করে। গণিতের ভাষায় বলে রিইন্টারেন্ট।
এ ব্যাপারটা বুঝতে পিথাগোরাসকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল, অনেক কিছু অবলোকন করতে হয়েছিল, সমুদ্রপাড়ে দাঁড়িয়ে জাহাজের আসা-যাওয়া এবং দিগন্তের পাড়ে অদৃশ্য হওয়া, আবার দৃশ্যমান হওয়ার ঘটনা থেকে, চাঁদে পৃথিবীর ছায়া থেকেও বুঝেছিলেন পৃথিবীটা গোল আর পৃষ্ঠটা বক্র।
‘তাহলে আলো কি সোজা পথে চলে না?’ কথা ও দিব্য আবার বলল।
চললে কি সে ফিরে আসত? সে অনন্তে হারিয়ে যেত। তবে পৃথিবীর পথে পথিকের হেঁটে যাওয়াটা হচ্ছে দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠ দিয়ে, তবে আলো তা করেনি। সে ত্রিমাত্রিক পৃষ্ঠের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলে, সেই বক্রপথটা সসীম। বক্রপথটা এতটা বড় যে, তা সৌরজগতের প্রেক্ষাপটে, এমনকি হাবল টেলিস্কোপ দিয়েও, বোঝা দুষ্কর। তবে এটাকে আইনস্টাইনের ‘স্থির মহাবিশ্ব, প্রসারমাণ নয়’ হিসেবে বিবেচনা করাই সমচীন হবে। বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের ভর ও ঘনত্ব পরিমাণ থেকে এটার বক্রতার পরিমাণ বের করতে পারেন। এখনো পর্যন্ত আমরা তাই জানি।
তবে চতুর্মাত্রিক জগৎ থেকে বিশ্বটাকে দেখা যেত। তাহলে যে দেখত সে আসলে একটা ত্রিমাত্রিক পৃষ্ঠ দেখতে পাচ্ছে। মূলত মহাবিশ্বে আলোর চলাচলের পথ মহাবিশ্বের পৃষ্ঠ দিয়ে এক ধরনের চলাচল। যদিও বিশ্বের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই বা এ কথার কোনো অর্থও নেই। তারপরও যদি বাইরে থেকে আমাদের বিশ্বটাকে দেখা যেত, বিশ্বটাকে কৃষ্ণবিবরের মতোই মনে হতো। দর্শকরা ঘটনার দিগন্তের মাধ্যমে কৃষ্ণবিবরের বৈশিষ্ট্য নিরূপণের চেষ্টা করত। তাহলে কৃষ্ণবিবরেও কি গোটা একটা বিশ্বই থাকতে পারে?
সোজা চলা আলোর হারিয়ে যাওয়া পথটা হলো ইউক্লিডীয় সরলরেখা, যার বিন্দুগুলো সমভাবে আনত, সরলতায় প্রবাহিত, কখনো ফিরে আসে না। আর বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে ফিরে আসা পথটা ‘রিম্যানীয় সরলরেখা’, ঘোরপ্যাঁচে প্রতি পদক্ষেপে বিন্দুসমূহ আবর্তিত, একে ‘জিওডেসিক’ বলা হয়। বর্তমানে দুটি ঘটনা বিন্দুর মধ্যকার দূরত্বকে জিওডেসিক (দূরত্ব) বলে। যাকে ব্যবহার করে আইনস্টাইন মহাবিশ্বের মৌলিক সমীকরণ আবিষ্কার করেছিলেন।
ইতিহাসের বিচারে যুক্তির সরলতায় পিথাগোরাসের কাছাকাছি কেউ অবস্থান করেন না। তবুও দুয়েকজনের নাম এলে তাতে আইনস্টাইনও থাকেন, যিনি তোদের মতো বয়সে প্যাভিয়ার রাস্তায় একাকী হেঁটে বেড়াতেন, আর ঘটনা ও আলোক দ্রুতির মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতেন, যেমনটি পিথাগোরাস ‘প্রকৃতির মাঝে সংখ্যার মিলের ঐক্য খুঁজে ফিরতেন, শুধু শব্দ বা ধ্বনির ক্ষেত্রেই নয়, প্রকৃতির সব কাজ ও মাত্রায় নিশ্চয়ই সরল সংখ্যাতত্ত্ব আছে, যা সমগ্র ঐক্য প্রকাশ করে’।
পিথাগোরীয়রা বিশ্বাস করত, গ্রহ-নক্ষত্রের কক্ষপথও সংগীতের স্বরের বিরাম অনুযায়ী নির্ধারণ করা যেতে পারে। তারা অনুভব করত, প্রকৃতির সব নিয়মানুবর্তিতা সাংগীতিক ঐকতানময়। তাদের কাছে গ্রহ-নক্ষত্রের আবর্তনও ছিল এক ধরনের সংগীত, যা মানুষের অ-শ্রুত এক মহা ঐকতান!
স্বরের সুরময় এই ঐকতানে কেপলার নিজেকে ভাসিয়েছিলেন আর গ্রহদের গতিপথ নির্ণয় করে ভেবেছিলেন যে, প্রত্যেক গ্রহের দ্রুতি তার সময়কার জনপ্রিয় লাতিন মিউজিক্যাল স্কেল—ডো, রে, মি, ফা, সোল, লা, সি-এর অনুরূপ হয়। এগুলোকে ভারতীয় কন্টিনেন্টের মিউজিক্যাল স্কেলের স্বরগুলোর মতোই সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি বলা যায়।
জোহানস কেপলার দাবি করেছিলেন যে, গোলকের ঐকতানে পৃথিবীর সুরগুলো হলো ফা, মি; যে পৃথিবী ফা বা মা, মি বা গা বলে চিরকাল ডেকে চলেছে!
এ স্বরগুলো সরাসরি ফ্যামাইন বা দুর্ভিক্ষ শব্দের লাতিন রূপে দাঁড়িয়ে আছে। নিষ্পেষণ আর বঞ্চনার আবর্তে থাকা কেপলার প্রাসঙ্গিকতা না হারিয়ে বললেন, ওই বেদনাময় শব্দগুচ্ছ দিয়ে পৃথিবীকে সবচেয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করা যায়, ‘আহা দুঃখী পৃথিবী’!
যে পৃথিবীর শতকোটি বছরের প্রাণের বিকাশে আমাদের উদ্ভব, যে পৃথিবীর প্রাণময়তায় আমরা বড় হয়ে উঠছি, সাদা বকের মতো ওড়া উন্মোচনরত এক জীবন, তাকে কেন বিচ্ছিন্ন করছি, আলাদা করে সজীবতা নষ্ট করছি? আমরা তো গাছ, পাখি, তিমি এবং মানুষ সবাই এই পৃথিবীবাসী।
মানে, আমরা সবাই হলাম আর্দিয়ান (Earthian)। আমাদের বার্তা নিয়ে ছুটে চলেছে মহাকাশযান ভয়েজার।
চলো, সেই সুরময় ঐকতানে জীবনকে মহাজাগতিক প্রান্তরে ছড়িয়ে দিই!
উৎস: নালন্দা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির মতবিনিময়ের প্রতিফলন, ২০২১
মন্তব্য করুন