গাজীপুরের কাসিমপুর হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী সুমাইয়া ফিরোজ জেলার একটি বেসরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম বর্ষে পড়ছে। তার এসএসসি পরীক্ষার সনদে বয়স এক বছর কম দেওয়া হয়েছে। আবার মায়ের নাম ‘শাহিদা আক্তার’-এর জায়গায় হয়ে গেছে ‘শাহনাজ বেগম’। বয়স ও মায়ের নাম সংশোধনে গত আগস্টে সে অনলাইনে দুটি আলাদা আবেদন করে। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি তাকে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের এ-সংক্রান্ত সভায় ডাকা হয়। বলা হয়, আগে মায়ের নাম সংশোধন করতে হবে। এরপর সাড়ে ৫ মাস এবং আবেদনের ১০ মাস পেরোলেও মায়ের নাম সংশোধন হয়নি।
বোর্ড থেকেও কোনো সাড়া পাচ্ছেন না জানিয়ে সুমাইয়া ফিরোজের বড় বোন ফৌজিয়া ইসলাম কালবেলাকে বলেন, আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে অনলাইনে আবেদন করি। এরপর জানুয়ারিতে সভায় ডাকা হলে সেখানে মায়ের নাম আগে সংশোধন করতে বলা হয়। কিন্তু এরপর এখন পর্যন্ত বোর্ড থেকে কিছু জানানো হয়নি। স্কুলে গেলে বলে আমাদের কিছু করার নেই। নিরুপায় হয়ে অপেক্ষায় আছি।
এভাবে শিক্ষা বোর্ডগুলোতে নিজের বা অভিভাবকদের নাম ও বয়স সংশোধনের আবেদন করে মাসের পর মাস ঘুরছে অনেক শিক্ষার্থী। ক্ষেত্রবিশেষে সেটি বছরও পেরোচ্ছে। এ কারণে নাম ও বয়স সংশোধন অনেকের কাছেই দুর্ভোগের নাম। তবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ বোর্ডে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেকেই প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে আবেদন করেন না।
বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, নামের ছোটখাটো সংশোধনের ক্ষেত্রে দ্রুত কাজ হয়ে যাচ্ছে। বড় ধরনের পরিবর্তনে বা জন্ম তারিখের সমস্যার ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগছে।
রাজধানীর ব্রাইট স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছেন আলিফ হোসেন। তার জন্মনিবন্ধনে মায়ের নামে ভুল রয়েছে। তাই মায়ের এসএসসির সনদ সংশোধন করতে গত ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে যশোর শিক্ষা বোর্ডে আবেদন করেন। আবেদনে মায়ের বাংলা ও ইংরেজি দুটি নামই ব্যবহার করতে বলা হয়। দুটিই ব্যবহার করা হয়; কিন্তু বোর্ড কোনো সাড়া দিচ্ছে না। পরে তিনিই বোর্ডে যোগাযোগ করেন। মাঝে বোর্ডের কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়। নতুন কর্মকর্তার কাছে আবেদনের আপডেট জানতে চাইলে তিনি ইংরেজি নাম কেটে শুধু বাংলা নাম দিয়ে আবারও আবেদন সম্পাদন করতে বলেন। সে অনুযায়ী সম্পাদন করা হয়। কিন্তু কাজ হয় না। এর মাঝে আবারও সংশ্লিষ্ট পদে নতুন কর্মকর্তা আসেন। তার মোবাইলে কল করা হলে তিনি ফের তার মায়ের বাংলা ও ইংরেজি নাম দিতে বলেন। সে অনুযায়ী সম্পাদনা করে দিলেও এখন পর্যন্ত আবেদন ঝুলেই রয়েছে।
আলিফ হোসেনের বড় বোন স্মৃতি জাহান বলেন, বেশ কয়েকবার আবেদনে সম্পাদনা করতে হয়েছে। একেকবার একেকজন দায়িত্বে এসে তাদের মতো করে সম্পাদনা করতে বলেন। কিন্তু সম্পাদনা করে দিলেও কোনো সাড়া নেই। সংশ্লিষ্টরা কল ধরেন না। ফলে ৫ মাসেও আবেদন নিষ্পত্তি হয়নি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বড় সংশোধনের ক্ষেত্রে আবেদনের সময়ের ওপর ভিত্তি করে আবেদনকারীর মোবাইল নম্বরে এসএমএসের মাধ্যমে সভার তারিখ ও সময় জানানো হয়। পরে সব সনদপত্রের মূল কপি, জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম সনদ, প্রাথমিক সমাপনী সনদ, সিটি/পৌর মেয়র/কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র, বয়স সংশোধনের ক্ষেত্রে সিভিল সার্জন কর্তৃক বয়স প্রমাণের সনদ, আবেদনকারীর অভিভাবকসহ সভায় হাজির হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে কাগজপত্র প্রদর্শন করেও ফল পেতে মাসের পর মাস সময় গুনতে হচ্ছে আবেদনকারীদের। কখনো কখনো ছোট নাম সংশোধন করতেও সময় লাগছে এক বছর। ফলে উচ্চশিক্ষা ও প্রয়োজনীয় কাজে বিপাকে পড়ছেন আবেদনকারীরা।
এদিকে সংশোধনের দায়িত্বে থাকা বোর্ডগুলোর সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার সময় দীর্ঘদিন সংশোধনের কাজ বন্ধ থাকায় আবেদনের জট তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি উচ্চশিক্ষাসহ নানা প্রয়োজনে নাম ও বয়স সংশোধনের আবেদন আরও বেড়েছে। এফিডেভিট তুলে দেওয়ায় আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে। তবে সব বোর্ডেই এখন প্রতি সপ্তাহে নাম সংশোধনের সভা ডাকা হয়। এমনকি কোনো কোনো বোর্ডে শনিবার ছুটির দিনেও সভা ডাকা হচ্ছে। ছোটখাটো সংশোধন হলে অনলাইনেই সংশোধন করে দেওয়া হচ্ছে। তবে বড় পরিবর্তন বা জটিলতা থাকলে সভায় ডাকা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কিছুটা সময় লেগে যাচ্ছে। আবার অনেকে নির্ধারিত সাক্ষাতের তারিখে উপস্থিত হতে পারেন না। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে পারেন না। ফলে সেসব আবেদন সুরাহা করতে সময় বেশি লাগে।
গত সপ্তাহে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে শিক্ষার্থীর অভিভাবক পরিচয়ে নাম ও বয়স সংশোধনে কেমন সময় লাগে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, সর্বনিম্ন এক সপ্তাহ থেকে সর্বোচ্চ দেড় বছর লাগবে। বোর্ড সূত্রে জানা যায়, প্রতি মাসে এই বোর্ডে নাম ও বয়স সংশোধনের প্রায় ৫ হাজার আবেদন জমা পড়ে। এসব আবেদনের মধ্যে অনলাইন ও সরাসরি সভার মাধ্যমে ৩ থেকে ৪ হাজার আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়। তবে এখনো প্রায় ৬ হাজার আবেদন ঝুলে রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে দুই দিন সভা করে এসব আবেদন নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার কালবেলাকে বলেন, দ্রুত সময়ে আবেদন সুরাহা করতে আমরা জোর চেষ্টা চালাচ্ছি। আশা করছি আগামী ছয় মাসের মধ্যে ঝুলে থাকা আবেদন নিষ্পত্তি করতে পারব।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, নাম ও বয়স সংশোধনের জন্য বর্তমানে ঝুলে রয়েছে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার আবেদন। প্রতি মাসে অনলাইন ও সভার মাধ্যমে ৮০০ থেকে ৯০০ আবেদন নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। ছোটখাটো ভুলের জন্য মিটিং ছাড়াই চারশ থেকে পাঁচশ আবেদন নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, নাম ও বয়স সংশোধনের জন্য প্রতি মাসে ন্যূনতম চারটা সভা করা হয়। চেষ্টা করি যেন কোনো আবেদনই ঝুলে না থাকে।
রাজশাহী বোর্ড সূত্র জানায়, গত তিন মাসে মোট তিনটি সভায় ১ হাজার ৭৯৪ আবেদন নিষ্পত্তির জন্য তোলা হয়। এর মধ্যে সভার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে ৯৭৪টি আবেদন। বাকি ৮২০ আবেদনে কাগজপত্রসহ অন্য কোন বিষয়ে চাহিদা থাকায় তা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি।
শিক্ষা বোর্ডটির প্রধান মূল্যায়ন কর্মকর্তা এস এম গোলাম আজম জানান, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করলে আবেদন নিষ্পত্তির সময় কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে নাম ও বয়স দ্রুত সংশোধনের জন্য জাতীয় নীতিমালা প্রয়োজন।
ময়মনসিংহ বোর্ড সূত্রে জানা যায়, প্রতি মাসে বোর্ডটিতে ৪০০-৫০০ শিক্ষার্থী নাম ও বয়স সংশোধনের আবেদন করেন। যার মধ্যে থেকে ১৫০-২০০টি আবেদন নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে। বোর্ডের সচিব অধ্যাপক কিরিৎ কুমার দত্ত বলেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় কিছু আবেদন ঝুলে থাকে, সেটি খুব বেশি নয়। তবে যাদের উচ্চশিক্ষা বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ থাকে, তাদেরটা জরুরি ভিত্তিতে করা হয়।
কুমিল্লা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, প্রতি মাসে অনলাইন ও সরাসরি সভার মাধ্যমে নামের বানান সংশোধন হয় ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার। বয়সের ক্ষেত্রে সংশোধন কম হয়, সে কারণে প্রায় ৪ হাজার আবেদন ঝুলে রয়েছে।
(প্রতিবেদনে সহযোগিতা করেছেন রাজশাহী ব্যুরো, চট্টগ্রাম ব্যুরো ও কুমিল্লা প্রতিনিধি)