সামাজিক সাম্যতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, নিরাপত্তা, টেকসই ভিত্তি, অংশীজনের সঙ্গে পার্টনারশিপ এবং মনুষ্যকেন্দ্রিক এআইয়ের ব্যবহার—এ ছয়টি বিষয়কে মূলনীতি হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) পলিসি করতে যাচ্ছে সরকার। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ এরই মধ্যে ‘জাতীয় আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স পলিসি-২০২৪’ এর খসড়া তৈরি করেছে। এর ওপর অংশীজনের মতামত নিয়ে চূড়ান্ত নীতিমালা তৈরি করবে সংস্থাটি। পাশাপাশি একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য নিয়েও কাজ করছে আইসিটি বিভাগ। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে আইনটির একটি খসড়া প্রণয়নের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে বলে জানা গেছে। পলিসি ও নীতিমালায় তথ্যের গোপনীয়তা, স্বচ্ছতা, কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে উৎসাহী করে— এমন বিধান চান দেশের তথ্যপ্রযুক্তি এবং সাইবার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা।
আইসিটি বিভাগের খসড়া এআই পলিসি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নাগরিকের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়নে এআই প্রযুক্তির সহায়তায় স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এবং এআই প্রযুক্তির সৃজনশীলতা ও গ্রহণে নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থান অর্জনই এ পলিসির মূল উদ্দেশ্য। পলিসিতে সামাজিক সাম্যতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, নিরাপত্তা, টেকসই ভিত্তি, অংশীজনের সঙ্গে পার্টনারশিপ এবং মনুষ্যকেন্দ্রিক এআইয়ের ব্যবহারকে মূল নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে স্মার্ট জনসেবা, গভর্ন্যান্স ও বিচারিক সেবা; টেলিযোগাযোগ, ডাটা গভর্ন্যান্স ও সার্ভেল্যান্স; কৃষি; পরিবেশ, জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন; স্মার্ট শহর ও যোগাযোগ ব্যবস্থা; বাণিজ্য ও অর্থনীতি; উৎপাদন ও শিল্পখাতে পরিবর্তন; শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মসংস্থান; স্বাস্থ্যসেবার মতো বিষয়গুলো এআইয়ের সঙ্গে যুক্তকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়া পলিসিতে। এ খসড়ার ওপর অংশীজনের মতামত সাপেক্ষে চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়ন করা হবে। পলিসি চূড়ান্ত হলে সেটিকে প্রতি তিন বছর পর পর রিভিউয়ের প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে খসড়ায়।
পাশাপাশি এআই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। তার পরিপ্রেক্ষিতে আইসিটি বিভাগ আইনের খসড়া প্রণয়নে কাজ করছে। জানা যায়, আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ এ আইনের একটি খসড়া প্রস্তুতের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে আইসিটি বিভাগের। এ লক্ষ্যে অংশীজনের মতামত নিতে বিভিন্ন সময় সভার আয়োজন করছে সংস্থাটি। পাশাপাশি আইনটি যেন বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বৈশ্বিকভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ম সে বিষয়েও খেয়াল রাখা হচ্ছে। আইসিটি বিভাগ এবং আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধা ও অসুবিধা বিবেচনায় এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সরকার। বিভিন্ন সময় জনসমক্ষে আইনটির বিষয়ে কথা বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
আইসিটি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এআই নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নে বিবেচনায় থাকবে পলিসিতে থাকা বিষয়গুলো। একই সঙ্গে আইনটি যেন অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক হয় সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে। যে কয়েকটি দেশে ও অঞ্চলে এআই সম্পর্কিত আইন বা বিধিমালা রয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখছে সংশ্লিষ্টমহল।
আইসিটি বিভাগের সচিব সামসুল আরেফিন কালবেলাকে বলেন, এআই নিয়ে বিশেষ একটি ‘স্ট্র্যাটেজি’ রয়েছে। সেটাকে আরও হালনাগাদ করা হচ্ছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে আইনের খসড়া চূড়ান্তের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এরই মধ্যে আইনমন্ত্রীকে নিয়ে অংশীজনের সভা করা হয়েছে। এআই আইনটি নতুন, কারণ প্রযুক্তিটাই নতুন। অন্যান্য দেশ কী করছে সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি আইন (খসড়া) করেছে। ফলে অন্যান্য দেশ বা অঞ্চলে এ ধরনের আইন থাকলে সেগুলোকে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। কারণ এককভাবে আইন করলে হবে না। প্রযুক্তিজগতে পুরো বিশ্বই একটি দেশ। তাই সবার সঙ্গে যেন সমন্বয় থাকে, সে বিষয়ে খেয়াল রেখেই আইন করা হবে। গুজব এবং অসত্য পরিচয়ের মতো বিষয় মোকাবিলায় আইনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে উল্লেখ করে আইসিটি সচিব আরও বলেন, এআইয়ের একটি ভয়ংকর দিক হচ্ছে অসত্য বা যা বাস্তবে নয় এমন জিনিসও সত্য করে উপস্থাপন করা হয়। কাজেই এই বিষয়গুলো আইনে গুরুত্ব দেওয়া হবে। আবার এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ সচেতনও হবে।
পূর্ণাঙ্গ আইনের আগ পর্যন্ত এআইবিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ে পলিসির আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে জানিয়ে আইসিটি সচিব সামসুল আরেফিন আরও বলেন, আইনের খসড়া সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রণয়নের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে আমাদের। এতেই কিন্তু আইন হয়ে যায় না। আইন হতে অনেক আনুষ্ঠানিকতা বাকি। কিন্তু পলিসি তৈরি তুলনামূলক সহজ। আইনের আগেই এআই বিভিন্ন বিষয় ‘অ্যাড্রেস’ করা যাবে এ পলিসির মাধ্যমে। অচিরেই চূড়ান্ত পলিসি প্রণয়ন করা হবে। আইন প্রণয়নে বর্তমানে এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) এবং আইসিটি অধিদপ্তর কাজ করছে উল্লেখ করে আইসিটি সচিব বলেন, আইন নিয়ে এখনো কোনো কমিটি হয়নি। এটুআই এবং আইসিটি অধিদপ্তর খসড়া আইনের ‘কনটেন্ট’ নিয়ে কাজ করছে। প্রথমে কিছু একটা থাকতে হবে যার ওপর কাজ করতে হয়। তাদের কনটেন্ট তৈরি শেষ হলে কমিটি প্রণয়ন করা হবে।
আইন প্রণয়নে চীনের প্রণীত এআই নীতিমালা বিবেচনায় রাখা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আব্দুল্লাহ আল জাবের। তিনি বলেন, চীনকেই ‘এআই সুপারপাওয়ার’ বলা হয়। চীনে এ বিষয়ে আইনও আছে। কাজেই আইন প্রণয়নে তাদের নীতিমালা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। চীনের আইনে এআইয়ের পরিধি, গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও বৈষম্যহীনতা, নিয়ন্ত্রণ ও লাইসেন্সিং, নৈতিক মানদণ্ড, পরীক্ষা ও যাচাইয়ের মতো বিষয়গুলো রয়েছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় উন্নয়ন ও গবেষণা, বিরোধ নিষ্পত্তি ও আইনগত সহায়তা, আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের মতো বিষয়গুলো আইনে থাকতে পারে। পাশাপাশি এআই পলিসি ও আইনে তথ্যের গোপনীয়তা, স্বচ্ছতা, কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে উৎসাহী করে এমন বিধান চান দেশের আইসিটি খাত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর কালবেলাকে বলেন, এআই প্রয়োগে নাগরিকের গোপনীয়তা যেন নষ্ট না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিতে আইনে জোর দিতে হবে। আর এআই যেন ধাপে ধাপে প্রয়োগ হয়, কারণ এতে অনেকেই কর্মসংস্থান হারাবেন। কাজেই বাংলাদেশে এআইয়ের বাস্তবিক প্রয়োগ ধাপে ধাপে করা উচিত। এ ক্ষেত্রে এআইতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করে এবং স্বচ্ছতা আনে এমন কোনো সৃজনশীল সমাধানে উৎসাহ জোগানোর জন্য কোনো ধরনের প্রণোদনার বিধান রাখা যেতে পারে আইনে।