

বিভিন্ন কারণে দাম্পত্য জীবনে সন্দেহ বা ঈর্ষা স্বাভাবিক হলেও কখনো কখনো তা গুরুতর মানসিক সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। বিশেষ করে যদি সন্দেহের মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে যায় এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে আসে, তখন এটি ওথেলো সিনড্রোমের লক্ষণ হতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রোগ অল্পেও পারিবারিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং সহিংসতা বা আত্মহত্যার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। চলুন তাহলে ভয়াবহ এই রোগটি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই-
ওথেলো সিনড্রোম কী
ওথেলো সিনড্রোম (Othello Syndrome) হলো এক ধরনের ডিলিউশনাল ডিসঅর্ডার, যেখানে একজন ব্যক্তি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে তার জীবনসঙ্গী তাকে প্রতারণা করছেন বা পরকীয়ায় জড়াচ্ছেন। এটি সাধারণ ঈর্ষা বা সন্দেহ নয়, বরং একটি গুরুতর মানসিক সমস্যা, যা দাম্পত্য জীবনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কখনো কখনো এটি সহিংসতা বা আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। (মায়ো ক্লিনিক-২০২৩)
শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত ট্রাজেডি Othello’র নামানুসারেই রোগটির নামকরণ। নাটকে নায়ক ওথেলো ভিত্তিহীন সন্দেহে তার স্ত্রী ডেসডেমোনাকে হত্যা করেন এবং পরে সত্য উপলব্ধি হওয়ার পর গভীর অনুশোচনায় আত্মহত্যা করেন।
লক্ষণ
রোগী বারবার অকারণে সন্দেহ করেন, জীবনসঙ্গীর প্রতি অতিরিক্ত নজরদারি করেন এবং যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনের সময় ব্যস্ত থাকেন। তারা সঙ্গীর ফোন, ই-মেইল, সোশ্যাল মিডিয়া বা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র খুঁজতে থাকেন। সাধারণ ঘটনা, যেমন সঙ্গীর দেরি করা বা ফোন না তোলা, তারা বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ হিসেবে দেখেন। এই আচরণ কখনো পরিবার ভেঙে যাওয়ার উপক্রম করতে পারে এবং মানসিক চাপ, হতাশা ও ডিপ্রেশন সৃষ্টি করে। (কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস-২০২০)
কিছু নিউরো রোগে এ উপসর্গ দেখা দিতে পারে
ওথেলো সিনড্রোম কখনো অন্য মানসিক বা নিউরো-ডিজেনারেটিভ সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। যেমন : ডিলিউশনাল ডিসঅর্ডার (পারানয়েড টাইপ), সিজোফ্রেনিয়া, ডিমেনশিয়া (বিশেষ করে আলঝেইমার্স বা লিউই বডি), মস্তিষ্কের অর্গ্যানিক সমস্যা এবং মাদকাসক্তি।
চিকিৎসা
এন্টিসাইকোটিক (Antipsychotic) ওষুধ ডিলিউশনাল চিন্তা কমাতে সাহায্য করে। Cognitive Behavioral Therapy (CBT) রোগীর জন্য সহায়ক হতে পারে। যদি লক্ষণ অন্য কোনো রোগ থেকে উদ্ভূত হয়, যেমন ডিমেনশিয়া, তবে প্রথমে সেই রোগের চিকিৎসা প্রয়োজন।
পরিবারের ভূমিকা
এই রোগে পরিবারের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বোঝানো, সময় দেওয়া, আলোচনা করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং মানসিক সহায়তা দেওয়া জরুরি। রোগীকে দোষারোপ বা উপেক্ষা করা কোনো সমাধান নয়। পরিবারের সচেতনতা ও সঠিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ রোগীকে সহায়তা করতে পারে এবং পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষা করতে সাহায্য করে।
খেয়াল রাখার বিষয়
যদি সন্দেহের মাত্রা তীব্র না হয়, রোগী মাঝে মাঝে বুঝতে পারেন তার সন্দেহ অমূলক, তবে এটি হতে পারে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার (OCD)। উপহাস বা অবহেলা নয়, এ ক্ষেত্রেও সাইকিয়াট্রিস্ট বা সাইকোলজিস্টের পরামর্শ বাধ্যতামূলক।
শেষ কথা
ওথেলো সিনড্রোমকে সাধারণ ঈর্ষা বা সন্দেহ মনে করে উপেক্ষা করা উচিত নয়। আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণ ক্ষেত্রবিশেষে ভয়ঙ্কর বা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। দ্রুত চিকিৎসা ও মানসিক সহায়তা নিশ্চিত না হলে মারাত্মক ঘটনাও (সহিংসতা, হত্যা বা আত্মহত্যা) ঘটতে পারে। তাই রোগটিকে সর্বদা গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি), ইন্টারন্যাশনাল ফেলো আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন
মন্তব্য করুন